এমন একটি চর্মরোগ নিয়ে আজ লিখছি যা অনেকেরই কমন সমস্যা, নামটি হলো একজিমা এবং এটি সাধারণত হাতে ও মুখে হয়। মেডিকেলের ভাষায় একে এটপিক ডার্মাটাইটিস (Atopic Dermatitis) বলে। স্থানীয় ভাষায় একজিমা চর্ম রোগটিকে পামা, বিখাউজ, কাউর ঘা-ও বলা হয়। ত্বককে অনেক শুষ্ক করে দেয় এটি। একজিমার আকার প্রকোপ হলে ত্বক এতোটাই শুষ্ক হয়ে যায় যে শরীর ফেটে রক্ত বের হয়। যাদের একজিমা আছে তাদের দরকার অনেক বেশি বাড়তি যত্ন। একজিমা হলে ত্বক জ্বলে, চুলকায়, ত্বকে শুষ্ক প্যাচেস দেখা দেয়। একজিমা মূলত শিশুদের হয়। সাধারণত ০-১০ বছরের বাচ্চাদের শরীরে, মুখের ত্বকে বেশি দেখা দেয়। বড়দের যেকোনো সময় দেখা দিতে পারে এটি। মুখের ত্বকে একজিমা দেখতে যতটা খারাপ লাগে, তার সাথে কমে যায় নিজের আত্মবিশ্বাস। একজিমা কী কারণে হয় সেটা এখনও সঠিকভাবে জানা যায় নি। কিন্তু কিছু কারণ ধারণা করা যায়। চলুন জেনে নেই একজিমা হওয়ার কারণ, কিছু ডায়েট ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত।
একজিমা হওয়ার কারণ, প্রাকৃতিক ট্রিটমেন্ট ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
একজিমা হওয়ার কারণ
১. মুখের ত্বক অনেক শুষ্ক হলে।
২. ওষুধের অথবা যেকোনো ধরনের কস্মেটিক্স এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যেমন এন্টিবাওটিক্স অথবা সানস্ক্রিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
৩. রোদে যারা দীর্ঘক্ষণ থাকে।
৪. যারা অতিরিক্ত অ্যালার্জি জাতীয় খাবার গ্রহণ করে।
৫. দেহের ভেতর ইমিউন সিস্টেম ঠিকমত কাজ না করলে।
একজিমা হলে ডাক্তাররা মূলত মেডিকেল পিল, ক্রিম অথবা স্টেরয়েড গ্রহণে পরামর্শ দান করেন। এসব মেডিসিন ত্বকের উপরের সারফেসকে ঠিক করে। কিন্তু সঠিক ডায়েট আর কিছু প্রাকৃতিক ট্রিটমেন্ট একজিমাকে ভেতর থেকে সেরে ওঠানোর জন্য সহায়ক।
একজিমার জন্য ডায়েট
১. আমরা খাবারের মাধ্যমে যেটাই গ্রহণ করি, তার প্রতিফলন ত্বকের বাইরের সারফেসে দেখতে পাই। অতিরিক্ত তেল, চর্বি যুক্ত খাবার খেলে মুখে যেমন ব্রন হয় ঠিক তেমনি একজিমা হলেও খাবারে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। এমন খাবার খেতে হবে যেটা আপনার লিভার ফাংশন ভালো রাখে।
২. প্রতিদিন খাবারের তালিকায় প্রচুর পরিমাণে সবজি রাখতে হবে। আজকাল বাজারে ফরমালিন এবং কীটনাশক স্প্রে দেওয়া শাক সবজিতে ভরে গিয়েছে। যেভাবেই হোক, এই ধরনের খাবার পরিহার করতে হবে।
৩. গরুর মাংস পুরোপুরি ভাবে পরিহার করতেই হবে। যদি খেতেই হয় সবুজ ঘাস খাওয়া এমন গরুর মাংস খাওয়া যেতে পারে, তাও অল্প পরিমাণে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আছে এমন খাবার যেমন রুই মাছ, বাদাম ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে।
৪. যদি সম্ভব হয় কার্বোহাইড্রেট খাবার একদমই কম খাবেন।
৫. গরুর দুধ একজিমা রোধে অন্যতম সহায়ক। সেটা খেয়ে নয় বরং না খেয়ে। পরীক্ষামূলক ভাবে ২ সপ্তাহ গরুর দুধ না খেয়ে দেখতে পারেন। পজিটিভ ফলাফল আপনিই দেখতে পারবেন। কেননা গরুর দুধ অনেক এসিডিক, যেটা নেগেটিভ ফলাফল দেয় ইমিউন সিস্টেম এবং একজিমার জন্য। যেকোনো দুধ জাতীয় খাবার পরিহার করুন। যেমন কেক, পায়েস ইত্যাদি।
গরুর দুধের পরিবর্তে মহিষের, পাঠা অথা ভেড়ার দুধ খেতে পারেন। তাছাড়া বাদাম, সয়া দুধ, রাইস দুধ গরুর দুধের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।
৬. কিছু সাপ্লিমেন্ট একজিমা প্রতিরোধে সহায়ক। তাই প্রতিদিন নিয়ম মাফিক কিছু সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে। ফ্যাটি অ্যাসিড ত্বকের শুষ্কতা এবং চুলকানি প্রতিরোধে সহায়ক। একজিমা প্রতিরোধে ওমেগা ৩,৬,৯ অনেক ভালো কাজ করবে। ভিটামিন এ, ডি, ই ত্বকের কোলাজেন সুরক্ষায় অনেক কার্যকর। এরা ত্বকের সারফেসকে ব্যালেন্সড রাখে।
৭. একজিমা প্রতিরোধে Gamma-linolenic acid (GLA) ফ্যাটি অ্যাসিড অনেক কার্যকর। তাই ফ্যাটি অ্যাসিড নির্বাচনের সময় এই উপাদানটি আছে কিনা সেটি দেখতে হবে।
একজিমার জন্য লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন
১. শরীরের একজিমা হলে কোন প্রকার সিল্ক, পলেস্টার জামা পরা যাবে না। সব সময় সুতি কাপড় পরতে হবে। কাপড় এমনভাবে ধুতে হবে যাতে করে কোন প্রকার ডিটারজেন্ট কাপড়ে না লেগে থাকে। কেননা ডিটারজেন্ট-এর কেমিক্যাল শরীরে চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে।
২. কাজের অথবা মানসিক স্ট্রেস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। প্রতিদিনের কাজের মধ্যে কিছু সময় বের করে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিন এবং মনে মনে বলতে থাকুন “ আমি শান্তিতে আছি” অথবা ইয়োগা করুন মানসিক শান্তির জন্য। নিয়মিত গান শুনুন। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমান।
৩. রোদে, ধুলোবালিতে যতটা কম সম্ভব যাবেন।
৪. যতটা কম সম্ভব রুমে এয়ার কন্ডিশন ব্যবহার করুন। গোসল করার সময় কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন।
৫. প্রাত্যহিক জীবনে যেসব প্রসাধনী ব্যবহার করছেন সেগুলোর দিকেও অনেক খেয়াল রাখতে হবে। এন্টিব্যাক্টেরিয়াল, ডিওডেরন্ট জাতীয় জিনিস ব্যবহার করা পরিহার করতে হবে। কেননা এরা ত্বককে আরও শুষ্ক করে দেয়।
৬. যেসব প্রসাধনীতে সোডিয়াম লরিয়েট সালফেট (sodium lauryl sulfate) উপাদানটি আছে সেসব সব ধরনের প্রসাধনী ব্যবহার করা বাদ দিতে হবে। এই উপদানটি প্রায় সব ধরনের সাবান এবং শ্যাম্পুতে আছে। এটি ফেনা উৎপাদনে সহায়তা করে। কিন্তু এই উপাদান ত্বকের প্রোটিন ভেঙ্গে দেয় এবং ত্বককে সেন্সেটিভ এবং ড্রাই করে ফেলে।
৭. পেরাবেন যুক্ত প্রসাধনী ব্যবহার করা বাদ দিতে হবে। এই উপাদান আজকাল লিপস্টিক থেকে শুরু করে শ্যাম্পুতেও আছে। এটি ত্বকের জন্য এতোটাই ক্ষতিকর যে ক্যানসারও হতে পারে।
৮. কোকো বাটার, বাদাম তেল ক্রিমের পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারেন।
প্রাকৃতিক উপায়ে একজিমা প্রতিরোধ
১. বিশুদ্ধ নারিকেল তেল প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে মুখে এবং শরীরে দিয়ে ঘুমালে , যেকোনো মেডিসিনের থেকে ভালো কাজ করবে।
২. ভিটামিন ই অয়েল কিনে মুখে লাগালে খুব তাড়াতাড়ি একজিমার প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে পারেন। কিন্তু অবশ্যই মনে রাখতে হবে ভিটামিন ই অয়েল অবশ্যই ফার্মেসি থেকে কিনতে হবে। কখনই কসমেটিকস দোকানে কিনতে পাওয়া যায় এমন ক্যাপসুল ব্যবহার করা যাবে না।
৩. তাজা অ্যালোভেরার পাতা নিয়ে তার থেকে জেল বের করে সেটার সাথে ভিটামিন অয়েল, বাদাম তেল মিশিয়ে প্রতিদিন ব্যবহার করুন।
৪. শসার রস একজিমায় আক্রান্ত জায়গায় প্রতিদিন তুলা অথবা পরিষ্কার হাত দিয়ে লাগাতে পারেন।
৫. গাঁদা ফুলের সাথে ল্যাভেন্ডার অ্যাসেনশিয়াল অয়েল মিশিয়ে প্রতিদিন মুখে লাগাবেন, যতদিন পর্যন্ত না ঠিক হয়।
৬. গাজর সেদ্ধ করে, সেটা কে ব্লেন্ড করে মাস্কের মত বানিয়ে সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ বার মুখে লাগিয়ে ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
৭. কেমুমাইল অ্যাসেনশিয়াল অয়েল একজিমা প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। গোসল করার আগে সরাসরি অয়েল দিয়ে ত্বক মালিশ করলে প্রতিদিন, অনেক আরাম পাওয়া যাবে।
৮. একজিমার চুলকানির জন্য গোসল করার পানির মধ্যে নিম পাতার রস, বেকিং সোডা সামান্য দিয়ে গোসল করলে, ত্বকের চুলকানি অনেকটা কমবে।
৯. একজিমার জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধ অনেক ভালো কাজ দেয়।
লোশন, তেল যেগুলো একজিমা আক্রান্ত ত্বকের জন্য ক্ষতিকর নয়
১. CeraVE
২. Cetaphill
২. Bio oil
তাছাড়া যেকোনো ব্র্যান্ডের অর্গান অয়েল যেটা ১০০ ভাগ বিশুদ্ধ, সেটা ব্যবহার করতে পারবেন। ত্বকে একজিমার প্রকোপ অনেকাংশে কমে আসবে। একজিমা হলে একটা জিনিসই মনে রাখতে হবে। ত্বককে কখনই শুষ্ক হতে দেওয়া যাবে না। দিনে যতটা সম্ভব ত্বকে অয়েল যুক্ত ময়েশ্চারাইজার দিতে হবে। আশা করি আর্টিকেলটি ভালো লাগবে। ভালো থাকুন সবাই।
ছবিঃ সংগৃহীত – একজিমাট্রিটমেন্টসাইট.অর্গ, সাজগোজ.কম