ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায়, ফেসবুকে এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সময়ে সবথেকে বেশি আলোচ্য বিষয় হচ্ছে “করোনা ভাইরাস”। আপনারা অনেকেই জানেন যে চীনের উহান প্রদেশ থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। সম্প্রতি যারা চীন ভ্রমণ করে এসেছেন তাদের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাসটি। এটা অত্যন্ত ছোঁয়াচে হওয়ায় বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে এই মারণ ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এখন বাংলাদেশেও এই রোগে আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু এখন থেকেই আমাদের সচেতন থাকা উচিত যাতে এই ভাইরাস থেকে আমরা নিরাপদে থাকতে পারি। চলুন তাহলে জেনে নেই, করোনা ভাইরাস কী, কিভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, আক্রান্ত হলে মানুষের শরীরের লক্ষণসমূহ ও সচেতন থাকার উপায় সম্পর্কে।
করোনা ভাইরাস সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য
করোনা ভাইরাস কী?
হিউম্যান করোনা ভাইরাস এক ধরনের জুনোটিক (Zoonotic) রোগ এবং এই সংক্রমণটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ পশু-পাখি থেকে মানুষের শরীরে ট্র্যান্সফার হয়। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে এই ভাইরাসটি ক্রাউন বা মুকুটের মতো দেখতে হওয়ায় এর নাম হয়েছে ‘করোনা’। বিজ্ঞানীদের মতে, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতোমধ্যে মিউটেট (muted) করছে অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে।
ভাইরাসটির অনেক রকম প্রজাতি আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা প্রায় ছয়টি করোনা ভাইরাস শনাক্ত করেছেন, যা মানুষের শরীরে হালকা থেকে মারাত্মক লক্ষণ সৃষ্টি করে। যেমন- আলফা করোনা ভাইরাস (NL63 এবং 229E), বিটা করোনা ভাইরাস (HKU1 ও OC43) এবং বাকি দুটি সার্স ও মার্স তাদের প্রাণঘাতী লক্ষণগুলোর জন্য পরিচিত।
কীভাবে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস?
করোনা ভাইরাসের প্রথম খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল ১৯৬০ সালে একজন রোগীর মধ্যে। ২০১৯ এর শেষে আবার মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা হয়। ৩১ ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। আর তারপর থেকেই বিশ্ববাসীর টনক নড়ে। নতুন করে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়েছে। তবে ঠিক কীভাবে এর সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা হয় নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভবত কোনো সামুদ্রিক প্রাণী বাজার থেকে এই ভাইরাস ছড়ায়। আবার অনেকে বলেন যে, চীনের ল্যাব থেকে ছড়ায়। তবে এই নিয়ে এখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু নিশ্চিত করে নি। এই ভাইরাস সংক্রামিত ব্যক্তি মুখ না ঢেকে খোলা বাতাসে হাঁচি বা কাশি দিলে ভাইরাসটি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অন্যান্য কারণগুলো হচ্ছে সংক্রামিত ব্যক্তির সঙ্গে হ্যান্ডশেক, সংক্রামিত কোনো বস্তুর সাথে নাক বা মুখ স্পর্শ করা ইত্যাদি।
মানবদেহে লক্ষণসমূহ
অন্যান্য শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত রোগের লক্ষণের সাথে করোনা ভাইরাসের লক্ষণগুলোর মিল আছে। যেমন আক্রান্ত ব্যক্তির নাক দিয়ে সর্দি ঝরে, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথা ও জ্বর হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণ সর্দি-কাশির সাথে করোনা ভাইরাসের পার্থক্য বুঝতে পারে না। এসব লক্ষণের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
কিভাবে সচেতন থাকতে পারি?
বাংলাদেশে যাতে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে না পারে এজন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং করার মাধ্যমে সব যাত্রীদেরকে পরীক্ষা করে বিমানবন্দর ত্যাগ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি সরকারি উদ্যোগে চীন থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাদেরও সবকরম পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে এবং কিছুদিনের জন্য আলাদা স্থানে রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে কেউ জ্বর নিয়ে দেশে ঢুকছে কিনা তা শনাক্ত করতে বিমানবন্দরসহ দেশের প্রবেশ পথে ডিজিটাল থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকতে আমাদেরকেও সাবধান হতে হবে। চলুন জেনে নেই সচেতন থাকার উপায়গুলো সম্পর্কে।
১) সর্দি, জ্বর আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
২) সুরক্ষিত থাকতে অবশ্যই ফেইস মাস্ক ব্যবহার করুন।
৩) হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে রাখুন।
৪) গণপরিবহনে সাবধানে চলাফেরা করুন।
৫) প্রচুর ফলের রস এবং পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
৬) ডিম, মাছ কিংবা মাংস রান্নার সময় ভালো করে সেদ্ধ করুন।
৭) নিয়মিত থাকার ঘর এবং কাজের জায়গা পরিষ্কার করুন।
৮) বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করুন।
৯) ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার খেতে পারেন যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
তাহলে, জেনে নিলেন করোনা ভাইরাস সম্পর্কে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ চলছে যাতে ভাইরাসকে নির্মূল করা যায়। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. গ্যাব্রিয়েল লিউং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নির্দেশনায় বলছেন, ‘আপনি যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন তাহলে মাস্ক পরুন, আর নিজে অসুস্থ না হলেও অন্যের সংস্পর্শ এড়াতে মাস্ক পরুন’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে মানুষকে হাত ভালোভাবে ধোয়া নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে। আপাতত প্রতিকার হিসেবে এই সতর্কতাগুলো মেনে চললেই হবে। নিজে সচেতন হোন ও অপরকে সচেতন করুন।
ছবি- সংগৃহীত: এক্সপ্রেস.কো.ইউকে,উইকিপেডিয়া; সাজগোজ