রফিক সাহেব উচ্চ রক্তচাপের রোগী। নিয়মিত তাকে প্রেশার মাপতে হয়। ফার্মেসিতে প্রতিদিন প্রেশার মাপতে যাওয়া হয়ে উঠে না জন্য নিয়মিত প্রেশারও মাপা হয়ে উঠে না। রক্তচাপ মাপার জন্য প্রতিনিয়ত ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কোন প্রয়োজনই নাই। কিছু নিয়ম জানলে যে কেউ বাড়িতেই প্রেশার মাপতে পারে। বাড়িতে প্রেশার মাপার যন্ত্র থাকলে নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের রোগীর প্রেশার মাপা যায়। আবার অনেকের উচ্চ রক্তচাপ ধরাও পড়ে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া যাদের বংশে উচ্চ রক্তচাপের রোগী আছে, যাদের স্বাভাবিকের তুলনায় ওজন বেশি, ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম কম করা হয়, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করেন তাদেরও মাঝে মাঝে প্রেশার মাপা উচিত। ভুলে গেলে চলবে না উচ্চ রক্তচাপ একটি নীরব ঘাতক। কোন লক্ষণ প্রকাশ না করেই উচ্চ রক্তচাপের কারণে হার্ট, ব্রেন, চোখ, কিডনিতে জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাহলে আসুন জেনে নেই বাড়িতেই ব্লাড প্রেশার মাপার নিয়ম!
ব্লাড প্রেশার মাপার সঠিক ও সহজ নিয়ম
রক্তচাপ নির্ণয় করার যন্ত্রকে ইংরেজিতে বলা হয় স্ফিগমোম্যানোমিটার (sphygmomanometer)। বাজারে ডিজিটাল ও অ্যানালগ দুই ধরনের যন্ত্র পাওয়া যায়। এছাড়া একটি স্টেথেস্কোপও লাগবে। বাজারে ওমরন (omron), এএলপিকে2 (ALPK2) ইত্যাদি অনেক ডিজিটাল ব্লাড প্রেশারের মেশিন পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক সময় ডিজিটাল মেশিনে ভুল রিডিং আসে। ডিজিটাল মেশিন ব্যবহার করলে ভালো মানের মেশিন ব্যবহার করবেন।
ব্লাড প্রেশার মাপার সঠিক নিয়ম ধাপে ধাপে
১) রোগী চেয়ারে পেছনে হেলান দিয়ে বসে, দুই হাত টেবিলের উপর থাকবে। রোগীর হাত এমনভাবে রাখতে হবে যেন হার্টের সমতলে থাকতে হবে। হাফ হাতা অথবা ঢিলা জামা পরা ভালো। জামার হাতা ভাজ করে উঠিয়ে রাখার সময় যেন টাইট হয়ে না যায়। রক্তচাপ মাপার কাপ এবার কনুই থেকে ২.৫ সে.মি উপরে বাঁধুন। খুব ঢিলা অথবা টাইট করে বাঁধা যাবে না। স্থূল ব্যক্তি ও বাচ্চাদের কাফের সাইজ ভিন্ন হয়।
২) কনুইয়ের উপরে হাত দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনির অবস্থান নির্ণয় করে স্টেথোস্কোপের ডায়াফ্রাম বসাতে হবে। ডায়াফ্রাম কাপড়ের উপরে রাখলে ডায়াফ্রাম ও কাপড়ের ঘর্ষণে শব্দ শুনতে অসুবিধা হয়।
৩) মিটার স্কেলটি হার্টের সমতলে রাখতে হবে।
৪) অনেক সময় দেখা যায় প্রেশার মাপতে গিয়ে প্রকৃত সিস্টোলিক প্রেশার এবং শব্দ শুনতে পাওয়ার মাঝে একটা গ্যাপ তৈরি হয়। এটাই অসকালটেটরি গ্যাপ। এটা এড়ানোর জন্য সব প্রথমে পালপেটরি মেথডে সিস্টোলিক প্রেশার দেখতে হবে। কিভাবে দেখবেন? রেডিয়াল ধমনির উপরে হাত রেখে ব্লাডার ফোলাতে হবে মানে পাম্পার দিয়ে পাম্প করে কাফ ফোলাতে হবে যতক্ষন না পালস বন্ধ হয়। কবজির (wrist joint) ২ সে.মি নিচে বৃদ্ধা আঙ্গুলের সাইডে আমরা তিন আঙ্গুলের সাহায্যে রেডিয়াল পালস অনুভব করি। রেডিয়াল পালস আর কিছুই না আমরা সচারচর হাতে যে পালস দেখে থাকি তাই। যেখানে বন্ধ হবে সেটাই সিস্টোলিক। এরপর আরও ৩০মি.মি উপরে মিটার উঠাতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে চাপ কমাতে হবে এবং ব্রাকিয়াল ধমনীতে রক্ত চলাচল করার কারণে সৃষ্ট শব্দ ( korotcoff sound) শুনতে হবে । শব্দ যেখানে শুরু হয় সেটা সিস্টোলিক প্রেশার এবং যেখানে শব্দ শেষ হবে তাকে ডায়াস্টলিক প্রেশার বলে।
ব্লাড প্রেশার সম্পর্কে সবার যা জেনে রাখা দরকার
১) সিস্টোলিক রক্তচাপ ১২০ মি.মি পারদ বা তার কম এবং ডায়াস্টলিক চাপ ৮০ মি.মি পারদ অথবা তার কম হলো স্বাভাবিক রক্ত চাপ।
২) সিস্টোলিক রক্তচাপ ১২০-১৩৯ মি.মি এবং ডায়াস্টলিক চাপ ৮০-৮৯ মি.মি পারদ হচ্ছে প্রি-হাইপারটেনশন। এ সমস্ত ব্যক্তি যে কোন সময় উচ্চ রক্তচাপের ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারে।
৩) সিস্টোলিক রক্তচাপ উভয় বাহুতে ১৪০ মি.মি পারদ অথবা উপরে থাকে বা ডায়াস্টলিক চাপ ৯০ মি.মি পারদ অথবা উপরে থাকে,তাহলে তার উচ্চ রক্ত চাপ বলে।
৪) সিস্টোলিক রক্তচাপ ৯০মি.মি পারদ অথবা কম থাকে বা ডায়াস্টলিক চাপ ৬০ মি.মি পারদ অথবা কম থাকে, তাহলে তাকে নিম্নরক্ত চাপ (Hypotension) বলে।
কিছু টিপস
১) কখনোই একবার মাত্র রক্তচাপ মেপে উচ্চ রক্তচাপ বলা যাবে না। প্রতিদিন কমপক্ষে দু’বার করে মোট ৭ দিন প্রথম দিনের প্রথম রিডিংটা বাদ দিয়ে বাকিগুলো গড় করে যদি ১৪০/৯০ মি.মি পারদ বা তার বেশি হয় তাহলে উচ্চ রক্তচাপ বলা যাবে।
২) চা-কফি পান করার পর, ব্যায়ামের পর, খাদ্যগ্রহণ বা ধূমপান করার পর বা খুব অস্থিরতার সময় রক্তচাপ না মাপাই ভালো।
৩) হোয়াইট কোট হাইপারটেনশন অর্থাৎ কিছু রোগীর হাসপাতালে কিংবা চেম্বারে আসলে দুঃচিন্তা বা উদ্বেগে প্রেশার বেশি পাওয়া যেতে পারে কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় প্রেশার স্বাভাবিক থাকে। এদের ক্ষেত্রেও বাসায় ৭ দিন প্রেশার মাপতে বলতে হবে। রোগী আসার পর সাথে সাথে প্রেশার না মেপে কিছুক্ষণ পর মাপতে হবে।
৪) প্রেশার মাপার সময় রোগী কোন কথা বলবে না। উত্তেজিত হওয়া যাবে না।
৫) প্রেশার মাপার সময় প্রসাব চেপে রাখা যাবে না এতে রিডিং ভুল আসবে।
আশা করি এই লেখাটি আপনাদের উপকারে আসবে। উপরের তথ্যগুলো আমাদের সবারই মাথায় রাখা উচিত। আর টিপসগুলো মেনে চললে সঠিক রক্তচাপ জানতে পারবেন। প্রেশার বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করুন এবং প্রয়োজনে ওষুধ খেতে হবে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন!
ছবি- সংগৃহীত: bu.edu