করোনা নিয়ে আমরা সবাই আতঙ্কিত। বহিঃবিশ্বের ন্যায় এখনো যদিও আমাদের দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক আকার ধারন করে নি, তবুও যে ২/৪ জন আক্রান্ত হয়েছে তাদের মাধ্যমে যেন অন্য কারো এই ভাইরাস না ছড়ায় এবং আক্রান্ত রোগী যেন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারে আসুন সবাই মিলে সেই চেষ্টা করি। তাহলে চলুন আজকের লেখায় জেনে নেয়া যাক করোনাতে আক্রান্ত রোগীর করণীয় কী?
করোনাতে আক্রান্ত রোগীর করণীয় নিয়ে কিছু কথা
কোন ব্যক্তির জ্বর (১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট/৩৮ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি) / কাশি/ সর্দি/ গলা ব্যথা/ শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি থাকে এবং তিনি বিগত ১৪ দিনের মধ্যে চীন বা অন্য কোন আক্রান্ত দেশ ( সিঙ্গাপুর, দঃ কোরিয়া, জাপান, ইটালী, ইরান ইত্যাদি) ভ্রমণ করে থাকেন অথবা এই সময়সীমার মধ্যে নিশ্চিত বা সম্ভাব্য কভিড-১৯ (COVID-19) আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসে থাকেন, তবে ঐ ব্যক্তি
কভিড-১৯ আক্রান্ত ‘সন্দেহজনক রোগী’ হিসেবে বিবেচিত হবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছে এমন সন্দেহকৃত রোগীদের পৃথকীকরণ, চিকিৎসা ও মনিটরিং হাসপাতালে হওয়া উচিত। কিন্তু, বিভিন্ন কারণে, যেমন- হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা যদি অপ্রতুল হয় অথবা রোগী যদি হাসপাতালে থাকতে রাজী না হয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ সকল রোগীদের বাড়ীতে স্বাস্থ্য সেবা/ পরিচর্যার বিষযটি বিবেচনা করা যেতে পারে।
WHO এর গাইডলাইন অনুযায়ী করোনাতে আক্রান্ত রোগীর করণীয় নির্দেশনা
আপনার উপসর্গগুলো সতর্কতার সাথে খেয়াল করুন। দেখুন নিম্নের উপসর্গের সাথে আপনার কোনো মিল খুজে পান কিনা!
১) জ্বর থাকলে নিয়মিত তাপমাত্রা পরিমাপ করুন।
২) যদি নতুন উপসর্গ দেখা দেয় বা আগের উপসর্গের অবনতি হয়, যেমন- শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তবে অতি দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৩) যদি নতুন উপসর্গ দেখা দেয় বা আগের উপসর্গের অবনতি হয়, তবে- চিকিৎসকের বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর কাছে যাওয়ার পূর্বে তাঁদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করুন এবং আপনি যে COVID-19 এ আক্রান্ত সন্দেহভাজন রোগী তা জানান। আপনি পূর্বেই জানালে অন্য সুস্থ ব্যক্তিরা যেন আক্রান্ত না হয়/সংস্পর্শে না আসে এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীর পক্ষে সাবধানতা অবলম্বন করা সম্ভব হবে।
৪) ভ্রমণের সময় এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রবেশের সময় মাস্ক ব্যবহার করুন। জনসমাগমে (ঘরে অথবা যানবাহনে) এবং কোন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে প্রবেশ করার পূর্বে মাস্ক ব্যবহার করুন। রোগীর মুখে মাস্ক পড়া সম্ভব না হলে (যদি মাস্কের কারণে শ্বাসকষ্ট হয়) বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা রোগীর ঘরে প্রবেশের পূর্বে মুখে মাস্ক ব্যবহার করবেন। আর মাস্ক পরে থাকাকালীন এটি হাত দিয়ে ধরা থেকে বিরত থাকুন। মাস্ক ব্যবহারের সময় প্রদাহের (সর্দি, থুতু, কাশি, বমি ইত্যাদি) সংস্পর্শে আসলে সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক খুলে ফেলুন এবং নতুন মাস্ক ব্যবহার করুন। মাস্ক ব্যবহারের পর ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে ফেলুন এবং সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন।
৫) গণপরিবহন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন এবং সম্ভব হলে অ্যাম্বুলেন্স/নিজস্ব পরিবহন ব্যবহার করে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাবেন এবং যাত্রাকালীন সময়ে পরিবহনের জানালা খোলা রাখুন।
৬) সর্বদা শ্বাসতন্ত্রের স্বাস্থ্যবিধি (বিশেষ করে- কাশি শিষ্টাচার) মেনে চলুন, হাত পরিচ্ছন্ন রাখুন এবং চলাচলের সময় ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবস্থানকালে অন্যদের থেকে ১ মিটার (৩ ফিট) দূরত্ব বজায় রাখুন।
৭) শ্বাসতন্ত্র বা অন্য কোন প্রদাহের (সর্দি, থুতু, কাশি, বমি ইত্যাদি) কারণে যদি যানবাহনের কোন অংশ নোংরা হয়, তবে সেই স্থান জীবাণুমুক্ত করুন।
৮) চিকিৎসা সেবা নেয়া ব্যতীত নিজ বাড়িতে থাকুন। হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেয়া ব্যতীত বাড়ির বাইরে যাবেন না। যদিও আমাদের দেশে এখনো স্কুল, কলেজ বন্ধের নির্দেশ দেয় নি, তবে নির্দেশনা পাবার সাথে সাথে তা যথাযথভাবে মেনে চলুন। তখন বাড়ির বাইরে কাজে, স্কুল, কলেজ অথবা জনসমাগমে যাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। আর যদি বের হতেই হয়, তবে গণপরিবহন ব্যবহার, অন্যদের সাথে একই যানবাহন অথবা ট্যাক্সি ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। এমনকি বাড়ির অন্য সদস্যদের থেকে আলাদা থাকুন।
৯) করোনাতে আক্রান্ত রোগীর করণীয় হবে আলো বাতাসের সুব্যবস্থা সম্পন্ন আলাদা ঘরে থাকা এবং অন্যান্য সদস্যদের থেকে আলাদাভাবে থাকা। তা সম্ভব না হলে, অন্যদের থেকে অন্তত ১ মিটার (৩ ফুট) দূরে থাকুন ও ঘুমানোর জন্য পৃথক বিছানা ব্যবহার করুন। যদি সম্ভব হয় তাহলে আলাদা গোসলখানা এবং টয়লেট ব্যবহার করুন। সম্ভব না হলে, অন্যদের সাথে ব্যবহার করতে হয় এমন স্থানের সংখ্যা কমান ও ঐ স্থানগুলোতে জানালা খুলে রেখে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করুন।
১০) করোনাতে আক্রান্ত রোগী মা বাচ্চাকে দুধ খাওয়া্তে পারবেন। বুকের দুধ থেকে ভাইরাস বাচ্চার দেহে ছড়াবে না। তবে হ্যাঁ, বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময় অবশ্যই যেন, হাঁচি, কাশি না ছড়ায়। তার জন্য মাস্ক পড়ে নিতে হবে এবং ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। আর তারপরও অতিরিক্ত সতর্কতা রক্ষার্থে বুকের দুধ ফিডারে ভরে কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে দিয়েও খাওয়াতে পারেন।
করোনাতে আক্রান্ত রোগীর করণীয় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
১) হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে অথবা সাবান ও পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুবেন (বিশেষ করে যদি হাত দেখতে নোংরা লাগে সাবান-পানি ব্যবহার করুন)। অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করবেন না। সাবান-পানি ব্যবহারের পর টিস্যু দিয়ে হাত শুকনো করে ফেলুন। টিস্যু না থাকলে শুধু হাত মোছার জন্য নির্দিষ্ট তোয়ালে/ গামছা ব্যবহার করুন এবং ভিজে গেলে বদলে ফেলুন।
২) মুখ ঢেকে হাঁচি কাশি দিন। হাঁচি কাশির সময় টিস্যু পেপার/ মেডিকেল মাস্ক/ কাপড়ের মাস্ক/ বাহুর ভাঁজে মুখ ও নাক ঢেকে রাখুন এবং উপরের নিয়মানুযায়ী হাত পরিষ্কার করুন। টিস্যু পেপার ও মেডিকেল মাস্ক ব্যবহারের পর ঢাকনাযুক্ত বিনে ফেলুন। কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করলে কাপড় কাঁচা সাবান/গুড়া সাবান দিয়ে কাপড়টি পরিষ্কার করে ফেলুন।
৩) ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী অন্য কারো সাথে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবেন না। আপনার খাওয়ার তৈজসপত্র- থালা, গ্লাস, কাপ ইত্যাদি, তোয়ালে, বিছানার চাদর অন্য কারো সাথে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবেন না। এ সকল জিনিসপত্র ব্যবহারের পর সাবান-পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফেলুন।
কখন করোনা আক্রান্ত রোগীর আইসোলেশন শেষ হবে?
কভিড-১৯ এ আক্রান্ত সন্দেহভাজন রোগী/ রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি ততদিন পর্যন্ত বাড়িতে আইসোলেশনে থাকবেন যতদিন তাদের থেকে অন্যদের সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে না যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার আইসোলেশন শেষ হবে। চিকিৎসকের সিদ্ধান্তমতে একজন হতে অন্যজনের আইসোলেশনের সময়সীমা আলাদা হতে পারে। তবে, এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ সময়সীমা ১৪ দিন।
আপনি আইসোলেশনে থাকাকালীন কী করবেন?
কভিড-১৯ সম্পর্কে জানতে পারেন আইসোলেশনে থাকার সময়। WHO, CDC, IEDCR এর ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য পেতে পারেন। পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে ফোন/মোবাইল/ ইন্টারনেটের সাহায্যে যোগাযোগ রাখুন।পরিবারের শিশুকে করোনা সম্পর্কে সতর্কে করতে তাই হাইজিং এর গুরুত্ব বুঝান। তাদেরকে পর্যাপ্ত খেলার সামগ্রী দিন এবং খেলনাগুলো পরে জীবাণুমুক্ত করুন।
এইতো এই ছিল আজকের আলোচনা। ভয় না পেয়ে আসুন ধৈর্য্য ধারন করে সবাই মিলে এই কঠিন সময় থেকে পরিত্রাণ পাই। আপনার দৈনন্দিন রুটিন, যেমন- খাওয়া, হালকা ব্যায়াম ইত্যাদি মেনেই চলুন। সম্ভব হলে বাসা থেকে অফিসের কাজ করতে থাকুন। মনকে প্রশান্ত করে এমন কাজ করুন। এই সময়কে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগান, সাধারণত যা করার অবসর হয় না- বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা অথবা উপর্যুক্ত নিয়মগুলোর সাথে পরিপন্থী নয় এমন যে কোন বিনোদনমূলক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করুন বা ব্যস্ত রাখুন। পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ছবি সংগৃহীত: ইমেজেসবাজার; সাজগোজ