বেশিরভাগ মেয়েরাই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে মাসিক সংক্রান্ত সমস্যায় ভোগে। স্বভাবগত কারণে হোক বা নিজের প্রতি অবহেলায়, অনেক মেয়েরা তাদের শারীরিক সমস্যাগুলোকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না। একসময় দেখা যায়, এই ছোটখাটো সমস্যাগুলোই পরবর্তীতে বড় কোনো রোগের সূত্রপাত করছে। বিশেষ করে, মাসিকের সময় অস্বাভাবিক স্রাব বা হেভি ফ্লো, অনিয়মিত মাসিক, অনেকদিন ধরে অতিরিক্ত ব্লাড যাওয়া- এই সমস্যাগুলোই বড় কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এগুলো কেনো হচ্ছে, কারণগুলো কী হতে পারে, চিকিৎসা না নিলে পরবর্তীতে কোনো শারীরিক সমস্যা হবে কি না সেগুলো সম্পর্কে জানা আছে কি? একজন সচেতন নারী হিসেবে কিন্তু অবশ্যই এ ব্যাপারে আপনার স্বচ্ছ ধারণা থাকা উচিত। পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত স্রাব বা হেভি ব্লিডিং এর কারণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে আজ আমরা জেনে নেই চলুন!
হেভি ব্লিডিং বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বলতে কী বোঝায়?
২১ দিনের কম সময়ে অথবা ৩৫ দিনের বেশি সময়ে রক্তক্ষরণ হওয়া অথবা ৭ দিনের বেশি সময় ধরে পিরিয়ড থাকলে সেটাকে কিছুটা অস্বাভাবিক বলা যেতে পারে। আর এই সময় অনেকেরই ফ্লো বেশি হয় এবং অনেকসময় ১ ঘন্টার মধ্যেই স্যানিটারি ন্যাপকিন বদলানোর প্রয়োজন হয়। আবার অনেকের ব্লাড ক্লট বা জমাট বাঁধা রক্ত যেতে পারে। এই অবস্থাকে হেভি ব্লিডিং বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বলা যায়। মেনোপজের আগেও অনেক নারী এই সমস্যায় ভোগেন।
এই সমস্যা হওয়ার কারণগুলো জেনে নিন
অস্বাভাবিক রক্তপাতের সাথে বেশ কয়েকটি কারণ জড়িত। নিজেকে সুস্থ রাখতে অবশ্যই আগে আপনাকে জানতে হবে কোন কারণগুলো থেকে এই ধরনের ব্লিডিং হতে পারে। চলুন সেই কারণগুলো আমরা জানার চেষ্টা করি।
১) ডিম্বস্ফোটন কর্মহীনতা (Ovarian dysfunction)
ওভারিতে যদি ডিম্বাণু ঠিকভাবে ম্যাচিউর না হতে পারে বা সময়মতো ওভারির ফলিকল থেকে নিঃসরণ না হয়, সেক্ষেত্রে ওভ্যুলেট ডিসফাংশন হতে পারে। তবে এটা নিয়মিতভাবে হয় না। থাইরয়েডের অসুখ, ওভারিয়ান সিস্ট, অতিরিক্ত স্ট্রেস, কম ওজন এগুলো থেকে এই সমস্যাটি হতে পারে।
২) রক্তক্ষরণ ব্যাধি (Bleeding disorder)
রক্ত জমাট বাঁধা ও রক্তপাত বন্ধের জন্য বিশেষ কিছু উপাদান সরাসরি কাজ করে। অনেকের শরীরে এই উপাদানগুলোর তারতম্য হতে পারে। এই কারণে অনেক মেয়ের ৭ দিনের বেশি সময় ধরে পিরিয়ড হয় এবং হেভি ফ্লো চলতে থাকে।
৩) হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
মেয়েদের শরীরে এস্ট্রোজেন (Estrogen) ও প্রজেস্টেরন (Progesterone) হরমোনের প্রভাবে মাসিকচক্র নিয়ন্ত্রিত হয়। কোনো কারণে হরমোনাল ব্যালেন্স নষ্ট হলে হেভি ব্লিডিং বা চাকা চাকা জমাট রক্ত যাওয়ার সমস্যা হতে পারে।
৪) জরায়ুতে টিউমার ও পলিপের উপস্থিতি
ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড (uterine fibroid) ও পলিপ থাকলে হেভি ফ্লো বা অতিরিক্ত রজস্রাব হতে পারে। জরায়ুর প্রাচীরে অনেকসময় ছোট ছোট প্রবৃদ্ধি বা স্ফীতি দেখা যায়। ফাইব্রয়েড হচ্ছে ইউটেরাসের একধরনের টিউমার, যেগুলো মাসেল ফাইবার দিয়ে গঠিত ও দেখতে গোলাকার। যাদের এই ধরনের সমস্যা আছে, তাদের অনিয়মিত মাসিক, হেভি ব্লিডিং, ভ্যাজাইনাল পেইন বা ব্যথা হয়ে থাকে।
৫) এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis)
ইউটেরাসের যে আস্তরণ বা পর্দা থাকে তাকে এন্ডোমেট্রিয়াম বলা হয়। এই আস্তরণ যখন ইউটেরাসের বাইরে বিকাশিত হয়, যেমন- দুটো ওভারির মধ্যে, ফেলোপিয়ান টিউবে, তখনই এন্ডোমেট্রিওসিস নামক সমস্যার সৃষ্টি হয়। ইউটেরাসের বাইরে গড়ে ওঠা এই পর্দার উপস্থিতি যন্ত্রণাময় মাসিকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই সাথে অতিরিক্ত রক্তপাত হতে থাকে।
৬) অন্যান্য
উপরে উল্লেখিত কারণগুলো ছাড়াও আরও কিছু বিষয় হেভি ব্লিডিং বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য দায়ী। গর্ভনিরোধক বড়ির ব্যবহার, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য জরায়ুতে কপার টি (IUCD) ধারণ, বংশগত কারণ এবং জরায়ুমুখে ক্যান্সার থাকলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।
হেভি ব্লিডিং থেকে শরীরে কোন কোন সমস্যাগুলো হতে পারে?
এই সময়ে অনেক মেয়েরাই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। অনেকের ক্ষেত্রেই মাসিক চলাকালীন যোনিপথে যন্ত্রণা, পেটে অস্বাভাবিক ব্যথা অথবা শরীরের পিছনের অংশে ব্যথা হয়। এছাড়া মানসিক অস্বস্তি তো আছেই! জরায়ুতে কোনো সমস্যা থাকলে কোষ্ঠকাঠিন্য, পীঠে ব্যথা, বার বার প্রসাবের চাপ এই ধরনের কিছু উপসর্গও দেখা যায়। আবার যাদের হেভি ব্লিডিং হয়, তাদের মধ্যে ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, খাবারে অরুচি, শরীরে ব্যথা এই ধরনের অনেক সমস্যাই হতে পারে। হরমোনের প্রভাবে মাসিকের সময় পেট ব্যথা হতে পারে, তবে সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করলে সেটা চিন্তার বিষয়। আপনার শরীরে বাসা বাঁধা বড় কোনো রোগের লক্ষণ হতে পারে এটি।
আগেই বলেছি, জরায়ুতে ক্যান্সার, টিউমার থাকলে এই ধরনের অস্বাভাবিক ফ্লো থাকে। ঠিকমতো চিকিৎসা না করালে এটা থেকে পরবর্তীতে ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত হতে পারে। ইউরেটাসে সমস্যা থাকলে অনেকের ক্ষেত্রে বাচ্চা গর্ভে আসার পর মিসক্যারেজ (Miscarriage) হয়ে যায়। তাই মাসিকের যেকোনো সমস্যাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে এবং এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের সাথে খোলামেলা কথা বলতে হবে।
তাহলে জেনে নিলেন, হেভি ব্লিডিং এর কারণ ও এর থেকে হওয়া সমস্যাগুলো সম্পর্কে! অনেকেই একে স্বাভাবিক বলে ধরে নেন, কিংবা ভয়ে বা সংকোচে মুখ খোলেন না! কিন্তু সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য একটু সচেতন তো থাকতেই হবে, তাই না? শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন, সুষম খাবার গ্রহণ করুন ও সেই সাথে শরীরকে সচল রাখুন। যেকোনো সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন!
ছবি- সংগৃহীত: ইরিসটাইম.কম; ইমেজেসবাজার.কম