এইতো খুব বেশি দিন আগের কথা না! মেয়েরা চাকরি বা ব্যবসা করবে, কল্পনায়ও কেউ আনতে পারতো না, মেনে নেয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার! কিন্তু যুগ পাল্টেছে, সাথে আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছে সমাজের মানুষের চিন্তাধারা। মেয়েদের মধ্যেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সাথে বাড়ছে সুযোগ ও ক্ষেত্র। কিন্তু, ক্যারিয়ার গড়ার আগ্রহ ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা এখনও অনেকটাই পিছিয়ে আছে! কেন এত পিছিয়ে আছে, জানতে হলে পড়তে হবে আমার আজকে লেখা এই ফিচারটি!
পিছিয়ে থাকার পেছনে বেশ কিছু কারণ
২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হওয়া সত্ত্বেও এমপ্লয়মেন্ট রেট মাত্র ৩৬.৪ পারসেন্ট নারী দেশের ওয়ার্কফোর্সে অংশগ্রহণ করে। অথচ, এখন মেয়েদের ক্যারিয়ার গড়ার আগ্রহ এবং সুযোগ দুইটাই দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা প্রশংসনীয়! তবে, মেয়েরা তাও কেন পিছিয়ে আছে?
পারিবারিক চাপ
পড়াশুনা শেষে বিয়ে নাকি চাকরি? নাকি পড়াশুনা শেষ করার আগেই বিয়ে? অবাক করা কথা হলেও সত্য যে, এই একবিংশ শতাব্দিতে এসেও অধিকাংশ পরিবারের মেয়েদের এই ধরনের পারিবারিক চাপের মুখে পড়তে হয়। তাই আগ্রহ ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, এই বাঁধার কাছে হার মেনে অনেক নারীই আর ক্যারিয়ার গড়তে পারে না। এই ধরনের জীবন জটিলতা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই, ছেলেদের এসব নিয়ে তেমন ভাবতে হয় না।
সামাজিক বাঁধা
সমাজ ও সমাজের মানুষের চেতনা দিন দিন প্রগতিশীল হচ্ছে। তবে আমাদের সমাজ এখন পুরুষশাসিত সমাজ। তাই, স্রোতের অনুকূলে সাঁতার কাটতে পারা যতটা সহজ, প্রতিকূলে ঠিক ততটাই কঠিন। তেমনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রীতিনীতি কিংবা সংস্কারগুলোর বিপরীতমুখী চিন্তাগুলো থাকে ততটাই কঠিন। ফলে সামাজিক বাঁধার কারনে একজন নারীর ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ এখনো কিছুটা হলেও কম।
নিরাপত্তার অভাব
কথাটি তিতা হলেও সত্য যে, সমাজ এখনো অনেক প্রগতিশীল হলেও, রাস্তায়, যানবাহনে কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনো কিছুটা হলেও অনিরাপদ। ফলে, কাজের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামলেও এখনো নিরিবিলি রাস্তায় মেয়েরা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। এছাড়াও, নিজস্ব যানবাহন না থাকলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতে হয়। সেক্ষেত্রে, অনেকসময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়।
একারণে, অনেকসময় আমরা মেয়েরা ট্রমাটাইজড হয়ে যাই। ফলে, ক্যারিয়ার গড়ার আগ্রহ কমে যায়। চাকরি কিংবা ব্যবসা কোনটাই আর আগাতে পারে না। অনেকসময়, কর্মক্ষেত্রেও সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হয়। সবমিলিয়ে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা তাই পিছিয়ে।
জেন্ডার গ্যাপ
এটি খুবই প্রশংসনীয় দিক যে, দিন যত যাচ্ছে আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পূর্বের তুলনায় ছেলেমেয়ের ভেদাভেদ অনেকটা কমে এসেছে। তবুও আফসোস যে, কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার গ্যাপ বা ছেলেমেয়ে বৈষম্য এখনো কিছুটা রয়ে গেছে।
এই অবশিস্টাংশই মেয়েদের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ কমিয়ে এনেছে, সেই সাথে কমিয়েছে আগ্রহ। অনেকক্ষেত্রেই এখনো ধরে নেয়া হয় যে, কাজের জন্য মেয়েদের প্রোডাক্টিভিটি ছেলেদের থেকে কম। এই ধারণার পেছনে, আসলেই কোনো যৌক্তিক কারণ এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশ্য; অনেক চাকুরির সার্কুলারে উল্লেখ থাকে, “ Women are highly encouraged to apply.” একে সাধুবাদ জানাই। তবুও, এখনো মেয়েদের তাদের পছন্দমত চাকুরি খুঁজে পেতে কাঠখড় পোড়াতে হয়।
রিস্ক নিতে অনিহা
ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগের পাশাপাশি আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ মেয়েরা চাকুরি কিংবা ব্যবসায় নিজেকে জড়াতে ভয় পায়। বিজনেস শুরু করতে প্রয়োজন নিজের সাহস আর অন্যদের সাপোর্ট। রিস্ক নিতে চায় না অনেকেই, নিজেকে গুটিয়ে রাখে। তাই, ক্যারিয়ারের ক্ষেত্র ও কিছুটা সীমাবদ্ধ হয়ে আসে। তবে আশার কথা যে, দিন দিন মেয়েদের কাজে যোগদান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও, অনেকেই ফিন্যান্সিয়াল রিস্ক নিতে অনীহা প্রকাশ করে। এটিও মেয়েদের পিছিয়ে পরার একটি কারন!
সঠিক গাইডলাইনের অভাব
মেয়েদের এখন চাকুরী কিংবা ব্যবসা করার অনেক সুযোগ আছে; যা ২০ বছর আগেও কিন্তু ছিল না। তবুও তারা এক্ষেত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে। অনেক মেয়েরা এখনও ক্যারিয়ার গড়ার জন্য সঠিক গাইডলাইন পাচ্ছে না। পাচ্ছে না পরিবারের সাপোর্ট কিংবা বিয়ের পর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সাপোর্ট।
সঠিক গাইডলাইন ও সাপোর্টের অভাবে মেয়েদের আর ক্যারিয়ার গড়া হয় না কিংবা, মাঝপথে থেমে যায় ক্যারিয়ার এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন! লিন ইন এবং সার্ভে মাঙ্কির একটি সার্ভে অনুযায়ী; ৬২ শতাংশ নারী বিশ্বাস করে যে; তাদের ক্যারিয়ার থমকে যাওয়া কিংবা শেষ হয়ে যাবার পিছে মূল কারণ হচ্ছে, সঠিক গাইডলাইন ও সাপোর্টের অভাব।
সব বাঁধা পেরিয়ে তাহলে ক্যারিয়ার গড়বেন কীভাবে?
বাঁধা তো থাকবেই! তাই, আপনি যদি স্বাবলম্বী হতে চান, তবে বাঁধা পেরিয়ে গড়ে ক্যারিয়ার গড়তে হলে আপনাকে কিছু টিপস অনুসরণ করতে হবে-
- সবসময় আপনার মন কি চাচ্ছে আর কী চাচ্ছে না; সেটি শুনবেন। দরকার হলে;পরিবারকে বুঝিয়ে বলবেন ক্যারিয়ার গড়ার সুবিধাজনক দিকগুলো। বাবা-মা আমাদের সবচেয়ে আপন মানুষ। তাদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বললে তারা অবশ্যই বুঝবেন।
- ভীত হবেন না! সবসময় নিজের উপর ভরসা রাখবেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করবেন; “আমাকে পারতেই হবে!” সাহস নিয়ে এগিয়ে যাবেন।
- সঠিক দিকনির্দেশনা হন্য হয়ে খুঁজবেন, তবে হাল ছেড়ে দিবেন না। সব পরিস্থিতিতে কনফিডেন্টলি নিজেকে প্রেজেন্ট করতে শিখুন। তবেই সফলতা আসবে।
- হয়রানির শিকার হলে চুপ থাকবেন না। প্রতিবাদ করবেন। কারণ, চুপ থাকা কিন্তু কখনোই সমাধান নয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, দিন দিন মেয়েদের প্রতি পজিটিভিটি বাড়ছে, বাড়ছে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ। আমি মনে করি, সাহস আর আত্মবিশ্বাস; এই দুটি বিষয় থাকলে মেয়েরা যেকোনো ক্ষেত্রেই এগিয়ে যেতে পারবে। এছাড়াও; আমরা যদি সবাই মিলে সামাজিক সচেতনতা বাড়াই ও একটু উদার মনমানসিকতার হই; তবেই ক্যারিয়ার গড়ার আগ্রহ ও সুযোগ থাকা থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা আর পিছিয়ে থাকবে না! আজ এ পর্যন্তই। ভালো থাকবেন।
ছবি- সাটারস্টক, আইস্টক