আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোতে “বিশেষ দিন” বলতে সাধারণত কোন উৎসবের দিনে বা ছুটির দিনের বাড়তি কিছু আয়োজনকেই বুঝি। আচ্ছা! একটি “বিশেষ দিন” বলতেই আপনার মাথায় প্রথমেই কেমন ভাবনা এসেছিলো, বলুন তো? ছুটির দিন, পরিবারের সব প্রিয় মানুষগুলো একসাথে! সবার পরনে সুন্দর সুন্দর জামা। মায়ের হাতের মজার মজার রান্না! একে অন্যকে কাজে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আড্ডায় বাবার গম্ভীর জ্ঞানী জ্ঞানী কথার মাঝে হালকা দুই একটা মজার কথা! অনেক অনেক হাসাহাসি! এমনটি?
নাকি আপনার মাথায় এসেছিলো, নতুন পাঞ্জাবী বা শাড়িটা পরে, একদম ফিটফাট হয়ে, মায়ের বানানো খাবারগুলো সামনে নিয়ে কখন এগুলো সোশ্যাল মিডিয়া অর্থাৎ ফেইসবুক বা ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করবেন? আর ভাবছিলেন ক্যাপশন বা হ্যাশ ট্যাগ কী হবে তা নিয়ে! যদি আপনার ভাবনার পুরোটা জুড়েই থাকে সোশ্যাল মিডিয়া, তবে তা কিন্তু মোটেও আপনার জন্যে ইতিবাচক নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতি আসক্তি আমাদের ব্যক্তিগত এবং সাংসারিক জীবনে ফেলতে পারে বিরূপ প্রভাব। তাই, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে রাখুন সাংসারিক জীবনের খুঁটিনাটি ।
সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি
কীভাবে সংসার জীবনে এটি খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে?
সব কিছুরই যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে কোন কিছু শেয়ার করাটা অবশ্যই খারাপ না। তবে রিয়েল লাইফের চেয়ে বেশি ভার্চ্যুয়াল লাইফে নির্ভরশীল হয়ে যাওয়াটা ব্যক্তি এবং সাংসারিক জীবনের জন্যে খুবই নেতিবাচক। কীভাবে? চলুন অল্প করে একটু জেনে নেয়া যাক।
১) অনেক সময় ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের কাছে হেরে যায় প্রিয়জন
ধরুন, আপনার হাসব্যান্ড বা ওয়াইফ তার জমানো টাকা দিয়ে খুব কষ্ট করে আপনাকে একটি মোবাইল গিফট করলো। আপনি অনেক খুশি! কিন্তু গিফট-টা হাতে নিয়েই ভাবছেন সুন্দর একটা ক্যাপশন দিয়ে পোস্ট না করলে সবাইকে বুঝাতে পারবেন না আপনি কতটা খুশি! মোবাইল হাতে নিয়েই আপনি ছবি তোলায় আর কী ক্যাপশন দিবেন তা নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত। অথচ, অন্যদিকে আপনার প্রিয়জন হয়তো চাচ্ছিলো তার কষ্ট করে টাকা জমানোর কাহিনীটা আপনাকে শুনাতে অথবা আপনাকে দেয়া সারপ্রাইজ এর প্ল্যানটা আপনাকে বলতে। আপনি যখন এমন মানুষগুলোকে নিয়ে ব্যস্ত যারা আপনার হাতের ওই মুঠো ফোনটায় বন্দী। তখন হয়তো, আপনার প্রিয় মানুষটির “থাক পরে বলবো” গল্পটা আপনাকে আর কোনোদিন শোনানো হয় না। এভাবেই কাছের মানুষগুলো থেকে একটু একটু করে বাড়তে থাকে দূরত্ব!
২) অন্যদের চিন্তা ভাবনা হতে পারে আপনার মানসিক অশান্তির কারণ
মানুষ হিসেবে আমাদের মেন্টালিটি এখনও খুব একটা আধুনিক নয়। পাশাপাশি জেনারেশন গ্যাপ বলেও একটা কথা আছে। আমার বা আপনার কাছে যে বিষয়টি খুব স্বাভাবিক, অনেকের কাছেই তা নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি করতে পারে। সেখান থেকে তৈরি হতে পারে হিংসা, কথা কানাকানি, এমনকি অনেকে আপনার দোষ ধরায় ব্যস্ত হয়ে যাবে। এর প্রভাব আপনার ব্যক্তিজীবন এবং সংসার জীবনে পরবেই। নেগেটিভ কমেন্ট অনেকেই সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না! আর সঠিকভাবে সামাল দিতে না পারলে এগুলোই হয়ে দাঁড়াবে আপনার মানসিক অশান্তির কারণ।
৩) আপনার খুশি বা আনন্দ সবাই পজিটিভভাবে নাও নিতে পারে
আমাদের জীবনে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা আসলেও আমাদের সুখ দেখে আনন্দ পায় এবং আমাদের খারাপ সময়ে আমাদের মতই কষ্ট পায়। তবে দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে, এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত-ই হাতে গোনা কয়েকজন। অপরদিকের সংখ্যাটাই কিন্তু বেশি। আপনি যখন আপনার কাছের কোন প্রিয়জন যেমন, হাসব্যান্ড, ওয়াইফ, বাবা-মা, ভাই-বোন বা বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে কোন সুন্দর সময়ের ছবি দিচ্ছেন, ঠিক একই সময় যে মানুষটি আপনাকে দেখছে সে হতে পারে তার ব্যক্তিগত জীবনে খুবই একা। আপনি না চাইলেও আপনার শেয়ার করা ওই পোস্টটি হতে পারে কারো শূন্যতা মনে করিয়ে দেয়ার কারণ। সে হয়তো চাইলেও আপনাকে ইতিবাচক ভাবে নিতে পারছেনা। এভাবেও কিন্তু তৈরি হতে পারে দূরত্ব।
৪) আপনার সাংসারিক কলহ অন্যের জন্য হতে পারে বিনোদন
আচ্ছা! ভেবে দেখুনতো? স্কুল কলেজে আপনার ক্লাশে যে কয়জন ক্লাশম্যাট ছিলো তারা সবাই কি আপনার বন্ধু ছিলো বা এখনও আছে? পড়া না পারার কারণে যেদিন টিচারের কাছে কড়া বেতের মারটি খেয়েছিলেন, আপনার ওই দুর্দশায় পুরো ক্লাশ কি আপনার জন্যে ব্যথিত হয়েছিলো? অবশ্যই না! তাই না? ফেইসবুকের ফ্রেন্ডলিস্ট-টাও একেবারেই সে রকম। এখানে যদিও বলা হয় “ফ্রেন্ডলিস্ট” তবে আসল বন্ধুদের নামের লিস্ট হাতে গোণা কয়টাই। আপনি যখন খুব কষ্ট পেয়ে সাংসারিক কলহ নিয়ে কোন একটা পোস্ট দিচ্ছেন তখন হয়তো অনেকেই তার স্ক্রিনশট কোন গ্রুপে দিয়ে “দেখছিস! বলছিলাম না? ভালো হইছে!” বলে আপনার পিছনে পিছনে তা নিয়ে খুশি হচ্ছে বা মজা নিচ্ছে।
তাহলে, এসব শেয়ার করা থেকে নিজেকে বিরত রাখার উপায় কী?
১) স্বামী- স্ত্রীর মধ্যকার বিষয় দুইজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখুন
আমরা অনেকেই সংসারের খুঁটিনাটি, এমন কী পান থেকে চুন খসলেও তা পরিবার বা বন্ধুদের বলতে ব্যস্ত হয়ে যাই। সবসময় এটা একদমই উচিৎ নয়। কারণ একসাথে থাকতে গেলে ভালো খারাপ এমন অনেক কিছুই ঘটবে। আজকে খারাপ কালকে ঠিকও হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি যাকে আপনার কথাগুলো শেয়ার করছেন তিনি হয়তো আপনার কাছের মানুষটিকে আর আগের চোখে দেখবে না বা সম্মান করবে না। এবং আপনি পরে চাইলেও তা আর পরিবর্তন করতে পারবেন না। তাই সংসারের ভালো মন্দ যেকোনো কিছুই চেষ্টা করুন স্বামী- স্ত্রীর দুইজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে। এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার না করে তা নিজেদের মধ্যে সময় নিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করতে। এতে আপনাদের মধ্যে বন্ডিং আরও মজবুত হবে!
২) সোশ্যাল মিডিয়াতে বেডরুম এবং বেডরুমে তোলা ঘনিষ্ঠ ছবি শেয়ার করবেন না
স্বামী- স্ত্রীর দুইজনের জন্যে বেডরুম খুবই ব্যাক্তিগত একটি জায়গা এবং একান্তই নিজেদের। রুচিশীল এবং আধুনিক মন মানসিকতা যাদের তারা কখনই আপনার শোওয়ার ঘর বা আপনার হাসব্যান্ডের সাথে আপনার পার্সোনাল সময়ের ছবি দেখতে চাইবে না! এবং আপনাদের জন্যে গোছানো ঘরে কী কী আছে, কীভাবে কী সাজিয়েছেন এটা একান্তই নিজের কাছে রাখাই শ্রেয়।
৩) সাংসারিক পার্সোনাল বিষয় সোশ্যাল মিডিয়াতে নয়
প্রত্যেকটা ফ্যামিলিতেই ভালো খারাপ একসাথে থাকে। আপনি আপনার বাবা মার বাড়িতে যেভাবে যে আদর্শে বড় হয়েছেন, তার তুলনায় শ্বশুর-শ্বাশুড়ির চিন্তা এবং ওই বাসার মানুষের চিন্তা ভাবনা বা লাইফ স্টাইল ভিন্ন হতেই পারে। আপনিও ভুল না আবার তারাও ভুল না। তবে একসাথে চলতে গেলে মিলেমিশে দুইদিকেই ব্যালেন্স করে চলতে হয়। এতে ছোট হয়ে যাওয়ার মত কিছু নেই। তাই অনেক সময় স্বামীর সংসারে নিয়ম কানুন বা বাকি সদস্যদের কোন কিছু মনমতো না হলে নিজেদের মধ্যে সমাধানে আসাই কিন্তু স্মার্টনেস এর পরিচয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করে আরও ১০ জনকে জানানোর মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা উল্টো আপনাকেই ভুল বুঝতে পারে।
৪) একে অন্যকে দেয়া প্রতিটি গিফটের ছবি শেয়ার করাটা খুব জরুরী নয়
আপনি একে অন্যকে দেয়া প্রতিটি গিফটের ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করছেন আর ভাবছেন “এবার বুঝবে সবাই, আমরা একজন অন্যজনকে কত ভালোবাসি”! প্রথমত, ভালোবাসা কখনই কে কাকে কতগুলো গিফট দিলো তা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। এবং আপনার এরূপ পোস্টের মাধ্যমে বাস্তবে মনে হতে পারে আপনি জাহির করতে চাচ্ছেন বা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন আপনারা কতটা সুখী দাম্পত্য জীবনে। যা এক ধরণের ইনসিকিউরিটিরও পরিচয় দেয়। তাই বলে কি কোন কিছুই শেয়ার করবেন না? অবশ্যই করবেন! কিন্তু তা যেন অন্যদের চোখে বাড়াবাড়ি না হয়ে যায়।
৫) পার্সোনাল সময়গুলোকে ব্যক্তিগতই রাখার চেষ্টা করুন
অনেকদিন পর কোথাও ঘুরতে গেলেন, ভালো কোন রেস্টুরেন্টে বসলেন! তা শেয়ার দেয়াই যায়। আবার হতে পারে জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীও। কিন্তু বাসায় বসে কারণে অকারণে পার্সোনাল মুহূর্তের ছবি শেয়ার করা, আজকে কোথায় ঘুরতে গেছেন, কালকে কোথায় খেতে যাবেন, হাসব্যান্ড বা ওয়াইফ আপনাকে কত দামী গিফট দিচ্ছে এগুলো নিয়মিত শেয়ার করাকে এক কথায় “শো-অফ” বলে যা আপনার সাংসারিক জীবনের ব্যাপারে অন্যদের ভালো বোধ করা পাশাপাশি নেগেটিভিটি সৃষ্টি করে। লাইক কমেন্টের আশায় এ মুহূর্তগুলো প্রতিনিয়ত শেয়ার না করে, নিজেদের একান্ত মুহূর্তুগুলো ব্যক্তিগত রাখতে চেষ্টা করুন।
বর্তমানে এই যুগের ছেলে-মেয়ে সবার মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হওয়ার ব্যপারটি লক্ষ্য করা যায়। খুশির ছলে বা এমনি এমনি একটি পোস্ট বা ছবি আমি বা আপনি দিতেই পারি। তবে আমাদের পার্সোনালিটি এবং রুচিবোধের সাথে তা কতটুকু যায় তাও অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে আমাদের সবাইকে হতে হবে আরও সচেতন। যেকোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আমরা আমাদের সুবিধার জন্যে ব্যবহার করতেই পারি। তবে যা যেন কোন ভাবেই আমাদের ব্যক্তিগত এবং সাংসারিক জীবনে ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সেটাও ইনশিওর করতে হবে আমাদেরকেই। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে আমরা আরও কেয়ারফুল হবো, এমনটাই আশা করি। ভালো থাকবেন।
ছবি- সাটারস্টক, সাজগোজ