আমরা প্রতিদিন সকালে উঠে সাধারণত কী করি, নিজেকে একবার প্রশ্ন করুন তো? হয় মোবাইলটা হাতে নিয়ে আপডেট দেখি, না হয় আয়নাতে নিজের মুখমন্ডল দেখি! তারপর শুরু হয় আমাদের বেসিক মর্নিং স্কিন কেয়ার রুটিন। দৈনন্দিন কাজ শেষে যখন রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেই, তখনও আবার আমাদের চোখ পড়ে আয়নাতে। আর দেখি সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে চেহারাটার কী হাল হলো! তারপর টুকটাক নাইট স্কিন কেয়ার শেষে ঘুম, এই তো। এভাবে দিন কেটে যায়, কিন্তু আমাদের নজর কি কখনো শুষ্ক হাত বা নখের দিকে যায়? ত্বকের যত্ন নিয়ে যতটা না চিন্তিত থাকি আমরা, হাত বা নখের যত্ন নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন থাকি না! আজকে শেয়ার করবো দারুণ কিছু নেইল কেয়ার হ্যাকস, যাতে পারফেক্টলি মেনিকিওর করে নিতে পারবেন ঘরে বসেই।
হাত ও নখের যত্ন নেওয়া কেন জরুরী?
বাইরে বের হই অথবা ঘরে থাকি, আমাদের সারাদিনই অনেক কাজ করতে হয়। আর আপনি যদি নখের যত্ন না নেন, তাহলে নখের ভেতরে জমে থাকা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা জীবাণু আপনার মুখেও প্রবেশ করতে পারে। যা খুব সহজেই শরীরের ক্ষতি করবে। আর সুন্দর হাত এবং পরিষ্কার নখ আপনার সারাদিনের স্ট্রেস কমায়, মন ভালো রাখে এবং আপনার কনফিডেন্স লেভেলও বাড়ায়। কিন্তু সবসময় তো পার্লারে যেয়ে মেনিকিওর করানো সম্ভব হয় না! তাতে কি, পারফেক্টলি মেনিকিওর করে নিতে পারবেন ঘরে বসেই। কীভাবে? সেটাই দেখে নিন এখন।
মেনিকিওর নিয়ে যত কথা
শুরু করার আগে কয়েকটি মজার তথ্য না দিলেই নয়। এই যে আমরা মেনিকিওর শব্দটি এত ব্যবহার করি, কিন্তু এর অর্থ জানি কি? এটি ল্যাটিন শব্দ ‘ম্যানুস’ অর্থ হাত এবং ‘কিউরা’ অর্থ যত্ন থেকে এসেছে। এক কথায় হাতের যত্ন। তবে বলা হয়ে থাকে প্রায় ৫০০০ হাজার বছর পূর্বে ইন্ডিয়াতে মেনিকিওর শুরু হয়েছিল যখন হেনা নেইল পলিশ হিসাবে ব্যবহার করা হতো।
নেইল কেয়ার হ্যাকস জানার আগে দেখে নিন হরেক রকম মেনিকিওরের নাম
হাতের যত্ন এ আর এমন কী! হালকা গরম পানি আর খানিকটা শাওয়ার জেলে ঘষে মেজে পরিষ্কার করা- এমন ধারণাটাই তো আসে মাথায়, তাই না? কিন্তু মেনিকিওরের এত প্রকারভেদ আছে, জানলে আপনি অবাক না হয়ে পারবেনই না।
১. বেসিক মেনিকিওর
যদি প্রথমবারের মতো করেন, তাহলে বেসিক মেনিকিওর আপনার জন্য পারফেক্ট। আর এটা ইজিলি কাস্টমাইজ করা যায়।
২. ফ্রেঞ্চ মেনিকিওর
এটা স্টাইলিশ এবং পশ লুক দেয়। মেনিকিওর শেষে নখের একদম শেষে একটা ক্রিসেন্ট শেইপে নেইল পলিশ করা হয়। সাধারণত এটা সাদা কালার রাখা হয়।
৩. রিভার্স ফ্রেঞ্চ মেনিকিওর
এখানে ক্রিসেন্ট শেইপ পলিশ নখের শুরুর দিকে দেওয়া হয়। এটাও বেশ স্টাইলিশ এবং সিম্পল।
৪. জেল মেনিকিওর
বেসিক প্রসেস শেষে দুইবার জেল পলিশ করা হয় ইউ ভি লাইটের নিচে। তারপর টপ কোট অ্যাড করা হয়।
৫. অ্যাক্রিলিক
এখানে লিকুইড মনোমার আর পাউডার পলিমারের কম্বিনেশন করা হয়। প্রথমে এটি ন্যাচারাল নেইলের উপর অ্যাপ্লাই করা হয়, তারপর পলিশ করে ইউ ভি লাইটের নিচে রাখা হয়।
৬. আমেরিকান মেনিকিওর
যদি আপনার কাছে ফ্রেঞ্চ মেনিকিউর বোরিং লেগে থাকে তাহলে এটি আপনার জন্য দারুণ একটি অপশন। এখানে নেইলটাকে ডিফারেন্টভাবে শেইপ করে এমনভাবে ব্লেন্ড করা হয় যেন ন্যাচারাল একটি লুক আসে। যথেষ্ট লাক্সারিয়াস বটে এটি!
৭. শেলাক মেনিকিওর
এখানে জেল এবং রেগুলার নেইল পলিশের একটা কম্বিনেশন রাখা হয় এবং বেশ কয়েকদিন এটা থাকে।
৮. প্যারাফিন মেনিকিওর
নাম শুনে বুঝতেই পারছেন, প্যারাফিন ওয়াক্স মেল্ট করে ব্যবহার করা হয়। যদি আপনার হাত বেশি ড্রাই এবং শুষ্ক থাকে তাহলে এটা আপনার জন্য বেস্ট। এটা অনেকটা স্পেশালাইজড স্পা ট্রিটমেন্টের মতন।
৯. ডিপ পাউডার মেনিকিওর
একটা রেগুলার মেনিকিওর এবং ফেইক অ্যাক্রিলিক নেইলের মাঝামাঝি একটা কম্বিনেশন। পার্থক্য এটাই, ইউ ভি লাইটের পরিবর্তে পিগমেন্টেড পাউডার ব্যবহার করা হয়।
১০. হট স্টোন মেনিকিওর
যদি আপনি মনে করেন, আপনার হাতের একদমই যত্ন নেওয়া হচ্ছে না। তাহলে এই মেনিকিওর শুধু স্ট্রেস থেকে রিলিফ দিবে না বরং হাত এবং নখের সৌন্দর্য পুনরায় ফিরে পাবেন৷ এটা বেসিক মেনিকিওর এর সাথে হট স্টোন দিয়ে ম্যাসাজ করা হয়।
বেসিক মেনিকিওর ছাড়া বাকিগুলো বিউটি স্যালুন বা এক্সপার্ট হ্যান্ডে করাতে হয়! এখানে ১০টি প্রকারভেদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। তবে বাসায় বসে সিম্পলভাবে করতে চাইলে বেসিক বা স্ট্যান্ডার্ড মেনিকিওর বেস্ট অপশন। চলুন বিস্তারিতভাবে এর ধাপগুলি সম্পর্কে জেনে নেই।
স্ট্যান্ডার্ড বা বেসিক মেনিকিওর
হাতের সামনে সব উপকরণ নিয়ে নিয়ে বসে পড়ুন। সবার বাসায়ই ছোট ম্যাট এবং টি-টেবিল তো আছেই। টেবিলের উপর প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে চট করে শুরু করে ফেলুন বেসিক মেনিকিওর।
যা যা লাগবে
১. হালকা কুসুম গরম পানি (লেবুসহ)
২. পরিষ্কার টাওয়াল
৩. মেনিকিওর সোপ/ শাওয়ার জেল
৪. নেইল পলিশ রিমুভার
৫. তুলা
৬. মেনিকিওর সেট (নেইল কাটার, নেইল ট্রিমার, নেইল শেপার ইত্যাদি)
৭. হ্যান্ড ময়েশ্চারাইজার
৮. বেইজ কোট, নেইল পলিশ এবং টপ কোট
মেনিকিওরের পদ্ধতি
১) প্রথমে রিমুভার আর তুলার সাহায্যে পূর্বের নেইল পলিশ পরিষ্কার করে নেই। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন নখের কোণাগুলি পরিষ্কার হয়। তারপর হাত ভালো করে ভিজিয়ে নিন লেবু মিশ্রিত পানিতে।
২) নেইল কাটারের সাহায্যে নখ আপনার পছন্দ অনুসারে কেটে নিন। অনেকভাবে কাটা যায় যেমন- ওভাল, স্কয়ার, রাউন্ড, যেভাবে ইচ্ছে।
৩) এবার নেইলগুলোকে ফাইল করে নিন। যে শেইপে নেইল কেটেছেন, সেই শেইপে একই ডিরেকশনে নেইল ফাইল করবেন, যাতে করে সমান হয়। এতে নখের শেইপটা আরো সুন্দর হয়।
৪) এরপর মেনিকিওর সেট থেক নেইল ট্রিমার নিয়ে নেইল কিউটিকলের চারপাশে ট্রিম করে নিন। তাড়াহুড়ো করবেন না, এতে করে কেটে যেতে পারে। নেইল ট্রিমার না থাকলে নেইল ব্রাশ দিয়ে নখের এরিয়া ইজিলি পরিষ্কার করে নিতে পারেন।
৫) এবার রাবার কিউটিকল পুশার বা উডেন কিউটিকল স্টিক দিয়ে নেইলের চারপাশের কিউটিকলগুলো পিছনের দিকে আলতোভাবে পুশ করবেন। নখের চারপাশে জমে থাকা ডেড সেলস রিমুভ হবে।
৬) তারপর মাঝারি সাইজের বোলে হালকা কুসুম গরম পানিতে মাইল্ড সোপ বা শাওয়ার জেল মিক্স করে সোপ ওয়াটার তৈরি করে নিতে হবে।
৭) এবার হাত ভিজিয়ে রাখুন কিছুক্ষণ। এবার লেবুর স্লাইস দিয়ে নখ পরিষ্কার করুন, এতে নখ উজ্জ্বল হবে। নখে যদি হলদেটে ভাব থাকে, সেটাও দূর হবে নিমিষেই!
৮) হাত ধুয়ে টাওয়াল দিয়ে মুছে নিন। তারপর হাতে ভালোভাবে ময়েশ্চারাইজার অ্যাপ্লাই করুন। আপনার হাতের স্কিন যদি ড্রাই বা শুষ্ক হয়ে থাকে, তাহলে অলিভ অয়েল বা জোজোবা অয়েল দিয়ে ম্যাসাজ করে নিন।
৯) এবার বেইজ কোট অ্যাপ্লাই করুন, এক লেয়ারই দিবেন। নেইল কালার যাতে লং লাস্টিং করে, সেজন্য বেইজ কোট দেওয়া হয়। সাধারণত ট্রান্সপারেন্ট রঙ বেইজ কালার হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
১০) এই স্টেপে আপনি পছন্দসই নেইল কালার বেছে নিন। সেই সাথে নেইলে ডিফারেন্ট ডিজাইন করে নিতে পারেন।
১১) লাস্ট স্টেপ হচ্ছে টপ কোটিং৷ নেইল পলিশের ফিনিশিং যাতে ভালো হয়, সেজন্য টপ কোট দেওয়া হয়।
নেইল কেয়ার হ্যাকস
লাইফকে একটু ইজি করতে বিউটি হ্যাকস দারুণ কাজ করে। নখের যত্ন নিতেও এমন অনেক ট্রিকস ও হ্যাকস আছে, যেগুলো আসলেই ইউজফুল। চলুন নেইল কেয়ার হ্যাকস জেনে নেই এখনই।
১. ব্রোকেন নেইল? এখনই ফিক্স করুন। শেইপ করে ভাঙা নখের উপর খালি টি-ব্যাগ ছোট্ট করে কেটে লাগিয়ে ট্রান্সপারেন্ট নেইল পলিশ দিয়ে নিন। আঠার মতন কাজ করবে এটি আর কেউ বুঝতেই পারবে না!
২. তাড়াতাড়ি নেইল পরিষ্কার করতে চান? পুরানা টুথব্রাশ আর একটু পেস্ট লাগিয়ে ঘষে নিন। একদম ক্লিয়ার হয়ে যাবে। রিমুভার দিয়েও যদি পুরানো নেইল পলিশ না যায়, তাহলেও এই টিপস কাজে লাগান।
৩. নেইলের একদম সাইডে ডেড সেলস ক্লিন করতে চান? মেকআপ ব্রাশ সেটের সবচেয়ে ফ্ল্যাট ও ছোট ব্রাশ দিয়ে ইজিলি কাজটি করতে পারেন।
৪. নখের সাইডে নরমাল গ্লু (যেটা রিমুভ করা যায় স্কিন থেকে) বা স্টিকার প্যাড লাগিয়ে নিলে নেইল পলিশ ছড়ানোর ভয় থাকে না, শেষে উঠিয়ে ফেলুন।
৫. আগের নেইল পলিশ একটা একটা করে আঙ্গুল থেকে তুলা দিয়ে রিমুভ করবেন, অনেক সময় লাগবে, তাই না? বাসায় ছোট্ট কাচের জার আছে কি? তাতে স্পঞ্জ গুজে দিয়ে রিমুভার ঢালুন একদম স্পঞ্জের মাঝ বরাবর। এবার নখ ঐটার মধ্যে রেখে একটু রাব করে নিলেই একদম পরিষ্কার হয়ে যাবে!
৬. নেইল পলিশের ক্যাপটা অনেক সময় শক্ত হয়ে আটকে থাকে, তাই না? গরম পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখুন, খুলে যাবে।
৭. উপরের টিপস্ যদি এড়াতে চান তাহলে বোতলে মুখের চারপাশে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে নিন তুলার সাহায্যে। এতে করে ইজিলি নেইল পলিশের লিড খুলতে পারবেন।
৮. সপ্তাহ জুড়ে মেনিকিওর টিপটপ রাখতে চান? বাসার কাজগুলো করার সময় হ্যান্ড গ্লভস ব্যবহার করুন। এতে করে নেইল ভাঙ্গারও সম্ভাবনা কম থাকে।
নেইল আর্ট করুন খুব সহজেই
কোনো নেইল আর্টই মাথায় আসছে না? ভিন্ন কালারের আরেকটি নেইল পলিশ দিয়ে টুথপিকের সাহায্যে পলকা ডট দিয়ে নিন ইজিলি। এখনকার সময়ে জনপ্রিয় একটি নেইল আর্ট হচ্ছে অম্ব্রে। একটি স্পঞ্জে দুই/তিনটি শেইড দিয়ে নখের উপর চাপ দিয়ে বসান। আর ইন্সট্যান্ট পেয়ে যাবেন এই দারুণ অম্ব্রে শেইড। ম্যাট শেইড পেতে চান? আইশ্যাডো আর নেইল পলিশ একত্রে লাগিয়ে উপরে টপ কোট দিলেই ম্যাট ইফেক্ট পেয়ে যাবেন। নেইলে স্টোন বসাবেন টুইজার দিয়ে।
তাহলে জেনে নিলেন দারুণ কিছু নেইল কেয়ার হ্যাকস আর বাসায় বসে মেনিকিওর করার বেসিক স্টেপস। হাত ও নখের যত্ন নিন, সুন্দরভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করুন। অথেনটিক প্রোডাক্ট কিনতে চাইলে আপনারা সাজগোজের ৪টি ফিজিক্যাল শপ ভিজিট করতে পারেন, যা যমুনা ফিউচার পার্ক, বেইলি রোডের ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টার, উত্তরার পদ্মনগর ও সীমান্ত সম্ভারে অবস্থিত। আর অনলাইনে কিনতে চাইলে শপ.সাজগোজ.কম থেকে কিনতে পারেন। সবাই ভালো থাকবেন।
ছবি- সাজগোজ, সাটারস্টক