ভাবুন তো ঘরের ছোট্ট নতুন অতিথি প্রচন্ড কান্নাকাটি করছে, কোনো কিছু দিয়েই তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না। এর থেকে বেশি অসহায় অবস্থা বাবা-মার জন্য আর কিছু হতে পারে না! কান্না সাধারণত সন্ধ্যাবেলায় বেড়ে যায়, রাতেও কান্নাকাটি করে। এমনভাবে কান্নাকাটি করে যে বাবা-মা চিন্তায় পড়ে যায়, আদরের শিশুর না জানি কী হয়েছে! অনেক বাবা-মা এই কান্নাকাটি বন্ধ করার জন্য এক ডাক্তারের পর আরেক ডাক্তার পরিবর্তন করে থাকে। কাজ হয় না কিছুতেই। শিশুদের এই সমস্যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় ইনফ্যান্টাইল কলিক বলে। কলিক বেবি কাকে বলে, লক্ষণগুলো কী আর কীভাবে এই অস্বাভাবিক কান্না সামাল দেওয়া যায়, আসুন জেনে নেই এ বিষয়ে বিস্তারিত।
কলিক বেবি কাদেরকে বলা হয়?
বই পত্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী ৬ সপ্তাহ থেকে ৬ মাস বয়সী শিশুদের প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটা সময় ৩ ঘন্টা করে সপ্তাহে ৩ দিনের অধিক এবং টানা ৩ সপ্তাহের অধিক কান্নাকাটি করাকে ইনফ্যান্টাইল কলিক বলে। তবে এর মাত্রা আরো অধিকও হতে পারে। আর এই সমস্যায় ভুক্তভোগী বাচ্চাদের কলিক বেবি বলে।
লক্ষণসমূহ কী কী?
১) সাধারণত ৬ সপ্তাহ থেকে ৬ মাসের শিশুদের এই সমস্যা দেখা যায়, তবে দুই সপ্তাহের এবং ৬ মাসের বেশি বয়সী শিশুদেরও হতে পারে।
২) প্রতিদিন টানা ৩ ঘন্টার বেশি সময় ধরে পর পর ৩ দিন কিংবা সপ্তাহে ৩ দিনের বেশি পর পর ৩ সপ্তাহ একটি নির্দিষ্ট সময় কান্নাকাটি করে, সাধারণত সন্ধ্যা থেকে রাতের মধ্যে।
৩) কান্নার সময় শিশু সাধারণত অস্থিরতা প্রকাশ করে। কান্না করতে করতে মুখ লাল হয়ে যায়। নাক চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যায়।
৪) অনেক সময় কান্না করতে করতে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
৫) এছাড়াও হাঁটু ভাজ করে পেটের দিকে রাখে, কপালে ভাজ দেখা যায় বা কুঁচকে থাকে এবং হাত শক্ত করে মুঠি করা থাকে।
৬) বাচ্চা মুখে দুধ নিতে চায় না, বিরতিহীনভাবে কান্না করতেই থাকে।
৭) কোলে নিয়ে হাঁটলে বা দোল দিয়ে অথবা অন্য পদ্ধতিতে বাচ্চাকে শান্ত করা যায় না।
যে সমস্ত কারণে হয়ে থাকে
১) পেট ব্যথা বোঝাতে কলিক পেইন শব্দটি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত ২০-২৫% শিশু জন্মের দেড় মাস পর ইনফ্যান্টাইল কলিকে আক্রান্ত হয়। তবে তার মধ্যে ৯৫% শিশুর এই অতিরিক্ত কান্নার কারণ নির্ণয় করা যায় না, কেবল ৫% ক্ষেত্রে কারণ জানা যায়।
২) ধারণা করা হয়ে থাকে অন্ত্রের মধ্যে অস্বাভাবিক সংকোচন এর ফলে পেট ব্যথা করে এবং বাচ্চা কান্নাকাটি শুরু করে।
৩) ৬ মাস বয়সের আগেই বাচ্চাকে গরুর দুধ কিংবা ফর্মুলা দুধ পান করানোর কারণেও ইনফ্যান্টাইল কলিক হতে পারে। অনেক সময় নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ফর্মুলা মিল্ক বাচ্চাকে স্যুট করে না।
৪) বাচ্চার কোষ্ঠকাঠিন্যতা থাকলে বাচ্চা পেট মুচড়ে কান্না করতে পারে।
৫) পেট ফাঁপা বা বদহজম বাচ্চার কান্নার কারণ হতে পারে।
৬) সঠিক নিয়মে এবং পজিশন ঠিক না করে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ালে, সে সময় বাচ্চার পেটে গ্যাস ঢুকে যায়। দুধ খাওয়ানোর পর এই গ্যাস ঠিকমতো বের করে না দিলে বাচ্চা অস্বস্তিতে ভোগে এবং কান্না করতে থাকে।
৭) শিশুকে সঠিক নিয়মে কোলে না নেওয়ার কারণে তার অস্বস্তি হতে পারে।
৮) শিশুর পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়াও একটি কারণ হতে পারে।
৯) পেটের সমস্যা যেমন গ্যাস্ট্রাইটিসজনিত সমস্যা।
১০) মায়ের যদি কোনো খাবারে অ্যালার্জি থাকে আর মা যদি সেই খাবার খায় যেমন গরুর মাংস, গরুর দুধ ইত্যাদি তখন সেই মায়ের দুধের মাধ্যমে বাচ্চার মধ্যেও অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হয়ে বাচ্চার ইনফ্যান্টাইল কলিক হতে পারে।
১১) ইনফেকশন যেমন ইউরিন ইনফেকশন, কানের ইনফেকশন, জ্বর ইত্যাদি হলে বাচ্চা অনেক কান্নাকাটি করে। এসব কারণেও বাচ্চা কান্নাকাটি করতে পারে, তবে তখন সঠিক কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে হবে। একে ইনফ্যান্টাইল কলিক এর সাথে তুলনা করা যাবে না।
কলিক বেবি বা বাচ্চার অস্বাভাবিক কান্না নিয়ন্ত্রণের উপায়
- বাবা ও মাকে বোঝাতে হবে যে এটা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই
- কান্নাকাটি করলে অস্থির না হয়ে শান্তভাবে বাচ্চাকে সামলানোর চেষ্টা করতে হবে
- পরিবারের সবাইকে এক্ষেত্রে মায়ের প্রতি সাপোর্টিভ হতে হবে
- পেট ব্যথা করলে ম্যাসাজ করে দিতে পারেন
- সাইকেল চালানোর মতো করে পায়ের ব্যায়াম করাতে পারেন
- দুধ খাওয়ানোর পর ঘাড়ের উপর বাচ্চাকে নিয়ে ঢেঁকুর তোলাবেন
যদি কোনো কারণ জানা থাকে যেমন ইনফেকশন, কোষ্ঠকাঠিন্যতা আছে কিনা, বাহিরের খাবার খায় কিনা, সঠিক নিয়মে দুধ পান করায় কিনা, যদি এসব জায়গায় সমস্যা থাকে তাহলে তা পরিহার করে চলতে হবে।
এটার জন্য চিকিৎসা আছে কী?
এই ক্ষেত্রে মা বাবাকে কাউন্সেলিং করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চিকিৎসা। কারণ বিভিন্ন গবেষণায় কলিক বেবি বা এই কান্নাকাটি করাকে শিশুদের সাধারণ শারীরিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। একটা সময়ে আপনাআপনি এই সমস্যা ঠিক হয়ে যায়।
বাচ্চাদের এ ধরনের সমস্যার সমাধানে মেডিসিনে তেমন একটা উপকার পাওয়া যায় না। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টি কলিক মেডিসিন ব্যবহার করা যায়, গ্যাসের মেডিসিনও অনেকে দেন, তবে তা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক মাত্রা অনুযায়ী দিতে হবে। আবার কিছু কিছু বাচ্চার অন্ত্রে উপকারী অণুজীব কম থাকার কারণে তাদের কলিক পেইন হয়, তাদের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট অনেক ভালো কাজ করে। তবে সর্বশেষ কথা হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে মূল চিকিৎসা হচ্ছে প্যারেন্ট কাউন্সেলিং। মা বাবাকে এই সিচুয়েশনে ধৈর্য ধরতে হবে।
কলিক বেবি সম্পর্কে আজ আমরা অনেক কিছুই জানলাম। নতুন মায়েদের জন্য কষ্টকর ব্যাপার এটি, কিন্তু নিজের মনোবলকে ঠিক রেখে বাচ্চার এই অস্বাভাবিক কান্নাকাটি সামাল দিতে হবে। এটি এমনিতেই কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যায়। চিন্তার কিছু নেই। আজ তাহলে এই পর্যন্তই, আবারও চলে আসবো নতুন কোনো বিষয় নিয়ে। হ্যাপি প্যারেন্টিং!
ছবি- সাটারস্টক