আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই এখন গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির সমস্যা রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে আমরা অধিকাংশ মানুষই খাদ্যাভ্যাস এমনভাবে গড়ে তুলেছি যে, আমাদের সব সময় পেটে অ্যাসিডিটি তৈরি হয়ে থাকে। এই অ্যাসিডিটির মাত্রা এতই বেশি এবং স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে যে, অনেকে হার্ট অ্যাটাকের ব্যথাকেও অ্যাসিডিটির সমস্যা ভেবে ভুল করেন। অ্যাসিডিটির সমস্যায় দীর্ঘদিন ভুগতে থাকলে তা ধীরে ধীরে আলসারে রূপ নেয়, যা মারাত্নক ক্ষতিকর। অ্যাসিডিটি থেকে আলসার কেন হয় এবং কোন লক্ষণগুলো দেখলে সচেতন হতে হবে সেটাই জানাবো আজকের আর্টিকেলে।
আলসার কী ও কেন হয়?
আলসার শব্দের অর্থ ‘ক্ষত’। পরিপাকতন্ত্রের অ্যাসিড যখন পাকস্থলি ও ক্ষুদ্রান্তের ভেতরের দেয়ালে ক্ষত করে দেয়, মূলত তখনই আলসারের সৃষ্টি হয়। এই ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণও হতে পারে। পরিপাকতন্ত্রের দেয়াল এক ধরনের মিউকাস বা শ্লেষ্মা জাতীয় আবরণ দিয়ে আবৃত থাকে। এই মিউকাস লেয়ার অ্যাসিডের হাত থেকে পরিপাকতন্ত্রকে রক্ষা করে। কিন্তু অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি হলে বা মিউকাস লেয়ার কমে গেলে আলসার হয়। এছাড়াও কমন কিছু কারণ আছে। যেমন-
১) হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে পরিপাকতন্ত্রের মিউকাস লেয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আলসার সৃষ্টি করে।
২) রেগুলার বিভিন্ন রকম ব্যথার ঔষধ এবং এন এস এ আই ডি (NSAID) জাতীয় ঔষধ যেমন- অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন ইত্যাদি প্রেসক্রিপশন বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বেশি পরিমাণে সেবন করলে তা পরিপাকতন্ত্রের মিউকাস লেয়ার ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেকেই আছেন সামান্য সমস্যায় এসব ঔষধ বেশি পরিমাণে খেয়ে থাকেন। যা মোটেও ঠিক নয়।
৩) এছাড়াও স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ নিয়ম না মেনে সেবন করলেও পাকস্থলীর মিউকাস লেয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৪) অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে পেটে আলসার দেখা দেয়।
৫) মদ্যপানের কারণে আলসারের সমস্যা হতে পারে। কারণ অ্যালকোহল পাকস্থলীর মিউকাস লেয়ার ক্ষয় করে এবং অতিরিক্ত অ্যাসিড উৎপাদন করে।
৬) অতিরিক্ত স্ট্রেসে থাকলে অ্যাসিডিটির পরিমাণ বেড়ে যায় যা পরবর্তীতে আলসারে রূপ নেয়।
৭) অতিরিক্ত ঝাল ও তেল মশলাযুক্ত খাবার খেলে অ্যাসিডিটি বাড়ে।
তবে উপরোক্ত কারণেই যে শুধু আলসার হয় তা নয়। এই কারণগুলো আলসার হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় এবং নিরাময় করা কঠিন করে। এই লক্ষণগুলো যদি বেশ কিছুদিন ধরে দেখা যায় তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আলসার এর প্রকারভেদ
অ্যাসিডিটির কারণে সৃষ্ট আলসার মূলত দুই রকম।
১) গ্যাস্ট্রিক আলসার- এটি সাধারণত পাকস্থলীর ভেতরের দিকে হয়ে থাকে।
২) ডিওডেনাল আলসার- এ ধরনের আলসার ক্ষুদ্রান্তের উপরের অংশে ভেতরের দিকে হয়ে থাকে।
কোন লক্ষণগুলো দেখলে বুঝবেন আলসারে ভুগছেন কিনা?
- পেটের উপরের অংশে ব্যথা বা জ্বালাপোড়া ভাব হওয়া
- সবসময় পেটে ভরা ভরা ভাব থাকা, পেট ফাঁপা থাকা বা অতিরিক্ত ঢেঁকুর তোলা
- তৈলাক্ত খাবার হজম না হওয়া
- বুক জ্বালাপোড়া করা
- বমি বমি ভাব
- কালচে রঙয়ের পায়খানা হওয়া
- রক্ত বমি হওয়া (আলসারের সমস্যা অতিরিক্ত হয়ে গেলে)
- ক্ষুধামন্দা দেখা দেওয়া
- শ্বাসকষ্ট হওয়া
- ওজন কমে যাওয়া
কীভাবে শনাক্ত করা যায়?
আলসার শনাক্ত করার জন্য চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি কিছু ক্লিনিক্যাল ডায়াগনস্টিক পরীক্ষাও দিয়ে থাকেন। যেমন-
ব্রেথ টেস্ট: হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি ব্যাকটেরিয়া আছে কি না সেটি নির্ণয়ের জন্য ব্রেথ টেস্ট করা হয়।
এন্ডোস্কোপি: এ পদ্ধতিতে চিকিৎসক একটি ফাঁপা টিউবের মাথায় ক্যামেরা বসিয়ে মুখ ও গলার ভেতর দিয়ে সম্পূর্ণ পরিপাকতন্ত্র পর্যবেক্ষণ করেন। আলসার পাওয়া গেলে প্রয়োজন বুঝে এ সময় বায়োপসি করে আলসার থেকে টিস্যু নিয়ে পরবর্তী চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ণয় করা হয়।
বেরিয়াম সোয়ালো (Barium swallow) এক্স রে: এই এক্স রে করার সময় বেরিয়াম নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ পানির সাথে মিশিয়ে খেতে দেওয়া হয়। সেই পানীয় পরিপাকতন্ত্রের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় এক্স-রে তে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় এবং তা রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে।
চিকিৎসা পদ্ধতি
আলসারের চিকিৎসা সাধারণত এর কারণের উপর ভিত্তি করে করা হয়। তাই চিকিৎসা শুরুর পূর্বে আলসারের কারণ নির্ণয় করতে হবে। এই চিকিৎসা মূলত তিন ধাপে করা হয়।
- হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরির উপস্থিতি থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক এর মাধ্যমে নির্মূল করতে হয়
- অনিয়মিতভাবে ব্যথার ঔষধ বা স্টেরয়েড ঔষধ সেবনের মাত্রা কমিয়ে ফেলতে হয় বা বন্ধ করতে হয়
- চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধ খাওয়ার মাধ্যমে নিরাময় করতে হয়
এছাড়াও কিছু কিছু ঔষধের মাধ্যমে অতিরিক্ত অ্যাসিড উৎপাদন কমিয়ে আলসার এর চিকিৎসা করা যায়। যেমন- অ্যান্টাসিড জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করে পাকস্থলীর অ্যাসিডের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়া যায়। আবার কিছু ঔষধের মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্রের মিউকাস লেয়ার সংরক্ষণ করা যায়।
কী কী জটিলতা হতে পারে?
সময়মত সঠিকভাবে আলসার এর চিকিৎসা না করালে বিভিন্নরকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন-
১) আলসার এর ফলে ক্ষয় হতে হতে পরিপাকতন্ত্রের দেয়াল থেকে রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যার ফলে রক্তশুন্যতা থেকে শুরু করে রক্তবমি বা কালচে পায়খানা হতে পারে।
২) আলসার এর মাত্রা বেশি হলে পরিপাকতন্ত্রের দেয়াল ছিদ্র হয়ে প্রাণনাশক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যাকে চিকিৎসাবিদ্যায় পারফোরেশন বলা হয়।
৩) পরিপাকতন্ত্রে আলসার হলে তা খাদ্যের যাত্রা পথে বাঁধার সৃষ্টি করে। ফলে অল্প খেলেই পেট ভরা বা ফাঁপা ভাব আসে। বমি ভাব হয় এবং ওজন কমে যায়।
৪) গবেষণায় দেখা গেছে, হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরির আক্রমণ গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
আলসার হওয়ার পূর্ব লক্ষণ অ্যাসিডিটি। তাই অ্যাসিডিটি হলে আগে থেকেই সাবধান হতে হবে। লাইফস্টাইল ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে চেষ্টা করতে হবে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করার। যদি অ্যাসিডিটির কারণে বেশি অস্বস্তি লাগে তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক