লিভার মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। শরীরকে সুস্থ রাখতে প্রয়োজন সুস্থ লিভার। আর লিভারকে বলা হয় শরীরের পাওয়ার হাউজ। লিভারের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস লিভারের যে রোগগুলো সাধারণত দেখা দেয়, তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো-
- ভাইরাল হেপাটাইটিস (যা জন্ডিস নামে পরিচিত)
- ফ্যাটি লিভার
- লিভার সিরোসিস
- হেপাটিক কোমা
- লিভার ফেইলর
লিভারের এই সব সমস্যায় আমাদের করণীয় কী এবং এ সময় আমাদের ডায়েট কেমন হওয়া উচিত তা নিয়েই জানাবেন পুষ্টিবিদ সাদিয়া ইসরাত স্মৃতি।
লিভারের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের খাদ্যতালিকা
জন্ডিস
জন্ডিস কোনো রোগ নয়, বরং এটি হলো রোগের লক্ষণ। জন্ডিস এর মূল কারণ হচ্ছে শরীরে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। জন্ডিস হলে সাধারণত শরীরের ত্বক, চোখে হলুদাভ রঙ দেখা যায়।
লক্ষণ
জন্ডিস এর অন্যতম প্রধান লক্ষণ হচ্ছে চোখ ও প্রসাবের রং হলুদ হয়ে যাওয়া। জন্ডিস এর মাত্রা বেড়ে গেলে পুরো শরীর গাঢ় হলুদবর্ণ হয়ে যায়। স্টুল সাদা হয়ে যাওয়া, ডিসেন্ট্রি, পেটে ব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, জ্বর, বমি, পেটব্যথা, ক্ষুধা কমে যাওয়া- জন্ডিসের লক্ষণ।
জন্ডিস রোগীর ডায়েট ও করণীয়
১) সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, জীবাণুমুক্ত খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা উচিত।
২) রাস্তাঘাটে খোলা পানি, ফলের জুস, শরবত ইত্যাদি পানের ক্ষেত্রে সাবধান বা বিরত থাকতে হবে।
৩) জন্ডিস রোগীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে তাদের ডায়েট হবে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয়। ফ্যাট কম খেতে হয় বলে কার্ব থেকে খাদ্যচাহিদা পূরণ করতে হয়।
৪) ঘরে বানানো শরবত, গ্লুকোজ বা আখের রস খেতে হবে এ সময়।
৫) ক্যান বা প্যাজেটজাত জুস অ্যাভয়েড করতে হবে, ফ্রেশ ফলের রস খেতে হবে।
৬) জন্ডিস রোগীকে আক্রান্ত হওয়ার ২-৩ দিন পর থেকে সেদ্ধ শাক-সবজি দেওয়া যেতে পারে।
৭) ফ্যাটজাতীয় খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে। যেকোনো মসলাযুক্ত, ঝাল ঝাল তেলে ভাজা, চর্বিযুক্ত মাংস, কলিজা, মগজ খাওয়া যাবে না।
৮) ডিমের কুসুম না খেয়ে সাদা অংশ খেতে হবে। ৩-৪ দিন পর যখন কিছুটা ভালোর দিকে যাবে তখন স্কিম মিল্ক খেতে পারবেন।
৯) ঘি, মাখন, চকলেট, কেক, ফাস্ট ফুড, চা, কফি এড়িয়ে চলতে হবে।
১০) নিয়মিত গ্লুকোজের পানি, চিনি পানি, ফলের রস খেতে হবে।
১১) জাউ ভাত, ভাত, সুজি দিতে হবে ১ম ১-২ দিন সাথে আলু সেদ্ধ। পরে হালকা মসলায় রান্না মুরগি, মাছ তেল/চর্বি ছাড়া মাংস, সহজপাচ্য খাবার দিতে হবে। সঠিক ডায়েট জন্ডিস এর প্রধান চিকিৎসা।
ফ্যাটি লিভার
সাধারণত আমাদের লিভারে ৫% পর্যন্ত চর্বি জমা থাকে, যদি চর্বির পরিমাণ ৫% এর বেশি জমা হয়, তখন ফ্যাটি লিভার হয়। লিভার সিরোসিসের একটি অন্যতম কারণ ফ্যাটি লিভার।
ফ্যাটি লিভার কেন হয়?
ফাস্ট ফুড, চর্বিযুক্ত খাবার বেশি করে খেলে ফ্যাটি লিভার দেখা যায়। এছাড়াও, ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের প্রবলেম, অ্যালকোহল সেবনের ফলেও ফ্যাটি লিভার হয়ে থাকে।
ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হলে করণীয়
১) শরীরের ওজন কমাতে হবে, শারীরিক ব্যয়াম করতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
২) কম ক্যালরির ও আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে, সবুজ শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি।
৩) চর্বিযুক্ত খাবার যেমন- ঘি, মাখন, পনির, রেড মিট, মাছের ডিম, বড় মাছের মাথা এড়িয়ে চলতে হবে।
৪) ফাস্ট ফুড, কার্বোনেটেড ফুড, সফট ড্রিংকস, চকোলেট খাওয়া যাবে না।
৫) শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম শরীরের ওজন ও লিভারের চর্বি কমায়। প্রতিদিন কিছু সময় হাঁটার চেষ্টা করুন, ঝুঁকে এক্সারসাইজ করা যাবে না। টায়ার্ড হলে রেস্ট নিতে হবে, শরীর বেশি খারাপ লাগলে শুয়ে পড়তে হবে।
লিভার সিরোসিস
এ অবস্থায় লিভারের স্বাভাবিক গঠন এবং একটা পর্যায়ে কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। লিভার সিরোসিস হলে পেটে পানি চলে আসে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করা এবং চিকিৎসক এর পরামর্শ মতো চলা অতি আবশ্যক।
লিভার সিরোসিসে খাবার
১) লিভার সিরোসিসের রোগীদের বাইরের খাবার টোটালি অ্যাভয়েড করতে হবে।
২) ফুটানো নয় বা বিশুদ্ধ নয় এমন পানি খাওয়া যাবে না।
৩) রোগীদের তরলজাতীয় খাবার হিসেব করে খেতে হবে।
৪) তরকারিতে লবণ পরিমাণমতো দিতে হবে, এর বাইরে লবণ খাওয়া যাবে না। খাবারে বেকিং পাউডার দেওয়া যাবে না।
৫) বেকারী আইটেমস যেমন বিস্কুট, কেক, ড্রিংকস যেমন: কোক, পেপসি ইত্যাদি এড়িয়ে চলা উচিত।
৬) রোগীরা যদি বেশি বেশি তরল পান করেন বা সোডিয়ামযুক্ত খাবার খান, তাহলে তাদের পেটের পানি বেড়ে বড় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।
৭) প্রাণীজ প্রোটিন যেমন মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি খুব বেশি পরিমাণে খাওয়া যাবে না। প্ল্যান্ট প্রোটিন যেমন ডাল সামান্য পরিমাণে খেতে পারবে।
লিভারের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডায়েট কেমন হওয়া উচিত, সেটা আমাদের জানা হয়ে গেলো। আশা করি, লিভারের এই অসুখগুলো নিয়ে সবাই সচেতন হবেন। যেকোনো সমস্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অথবা এক্সপার্টের পরামর্শ মতো চলবেন।
লিখেছেন,
সাদিয়া ইসরাত স্মৃতি, নিউট্রিশনিস্ট, ডক্টর সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হসপিটাল
ছবিঃ সাটারস্টক