বেশ কিছুদিন ধরেই রাহেলা বেগমের হাতের আঙ্গুলের জয়েন্টে ব্যথা হচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ব্যথা যেন বেশি হতে থাকে। আবার সারাদিনের কাজকর্মে ব্যথা ধীরে ধীরে কমে আসে। কিন্তু কেন এই ব্যথা হচ্ছে কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না। চিকিৎসকের কাছে যেয়ে জানতে পারলেন তিনি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (RA) এ ভুগছেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত। কিন্তু এটি হওয়ার কারণ ও চিকিৎসা কী? রোগটি সম্পর্কে আজ আমরা বিস্তারিত জানবো ফিজিওথেরাপি কনসালট্যান্ট এর কাছ থেকে।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস কী?
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস সাধারণ মানুষের কাছে বাত রোগ হিসেবে পরিচিত। এটি একটি অটোইমিউন ডিজিজ, যার নির্দিষ্ট কোনো কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। এই রোগের ফলে রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলো ভুলক্রমে শরীরের টিস্যুগুলোকে আক্রমণ করে থাকে। হাড়ের সংযোগস্থলের আস্তরণের ক্ষতি করে এবং ব্যথা হওয়ার সাথে সাথে হাড়ের চারপাশের মাংসপেশি ফুলে যায়। যার ফলে হাড় ক্ষয় হতে শুরু করে এবং হাড়ের গঠনে বিকৃতি দেখা দেয়। হাড়ের সংযোগস্থল ছাড়াও এ রোগ দেহের অন্যান্য অঙ্গ, যেমন- ত্বক, চোখ, ফুসফুস ও রক্তনালীরও ক্ষতি করে থাকে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস যে কোনো বয়সেই হতে পারে। তবে এটি ৪০ বছর বয়সের পর বেশি হয়। মহিলারা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন।
উপসর্গ
১) প্রথমে হাত ও পায়ের ছোট ছোট জয়েন্টগুলোতে (যেমন – আঙ্গুল) ব্যথা করে, পরবর্তীতে শরীরের প্রত্যেকটি জয়েন্টে ব্যথা শুরু হয়।
২) জয়েন্টগুলো ফুলে যায়।
৩) সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় ব্যথা বেশি হয়, দিনের বেলা হাঁটাচলা ও কাজকর্মে ব্যথা কমে আসে।
৪) ব্যথার পাশাপাশি শরীরে জ্বর জ্বর অনুভূত হয়।
৫) ব্যথাক্রান্ত জয়েন্টের মাংসপেশিগুলো ক্ষয় হতে থাকে এবং চিকন হয়ে আসে।
৬) রিউম্যাটিক নডিউল (টিস্যুর ফোলাভাব) দেখা যায়।
৭) ওজন কমে যায়।
কাদের ক্ষেত্রে এ রোগের ঝুঁকি বেশি?
যে কেউই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে রোগটি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন-
১) যদি কোনো নিকটাত্মীয়ের রোগটি হয়ে থাকে, তবে আপনারও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
২) যে সব নারীদের ফ্যামিলি হিস্ট্রিতে এই রোগ আছে, সেই সব নারীদের রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা দুই থেকে তিনগুণ বেশি।
৩) ধূমপান ব্যক্তির রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ায় এবং রোগটিকে আরও গুরুতর করে তোলে।
৪) স্থূলতা থাকলে RA হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
রোগ নির্ণয়
রোগটি নির্ণয়ের জন্য একক কোনো পরীক্ষা নেই। ক্লিনিক্যাল অবজার্ভেশনের পাশাপাশি রোগ নির্ণয়ে কিছু প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়। অনেক সময় আক্রান্ত জয়েন্টগুলোর এক্স-রে বা আল্ট্রাসাউন্ড করারও প্রয়োজন হতে পারে।
চিকিৎসা
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস যেহেতু সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ নয়, তাই এর জন্য চিকিৎসকের নির্দেশিত কিছু ওষুধ রোগীকে নিয়মিত খেতে হবে। পাশাপাশি এই রোগের জটিলতা, যেমন- জয়েন্টগুলো শক্ত হয়ে যাওয়া ও বাঁকা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রতিরোধ করার জন্য নিয়মিত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে হবে এবং ফিজিওথেরাপিস্টের শেখানো ব্যায়াম করতে হবে।
ঘরোয়াভাবে ভালো থাকার উপায়
১) জয়েন্টে ব্যথা হলে এমন পোশাক পরুন যেগুলো পরলে শরীর উষ্ণ থাকবে। এতে ব্যথা অনেকটাই কমে আসবে।
২) পর্যাপ্ত পানি পান করুন। বডি ডিহাইড্রেটেড হলে ব্যথার সেনসিটিভিটি বেড়ে যায়।
৩) নিয়মিত এক্সারসাইজ করুন। সাধারণত ব্যথার কারণে আমাদের বডি মুভমেন্ট কমে যায়। এতে দেহের আড়ষ্টতা বেড়ে যায়। মনে রাখতে হবে, যত আপনি আপনার মুভমেন্ট বাড়াবেন, তত আপনার মাংসপেশির দুর্বলতা, জয়েন্ট স্টিভনেস কমবে।
৪) বিশ্রাম কিংবা ঘুমানোর সময় গরম সেঁক দিন। এক্ষেত্রে হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি নিয়ে সেটা ব্যবহার করতে পারেন। এতে দেহের জয়েন্টের ব্যথা অনেকটা কমে যাবে।
৫) গোসলের সময় গরম পানি ব্যবহার করুন। এতে শরীরের সব জয়েন্টের আড়ষ্টভাব দূর হয়ে মুভমেন্ট করার ক্যাপাবিলিটি বাড়বে।
৬) প্রতিদিন রোদে কিছুটা সময় কাটাবেন। এতে দেহের ভিটামিন ডি এর ঘাটতি পূরণ হবে। শরীরের ব্যথা বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি। এছাড়াও হাড়ের ক্ষয় পূরণ, অস্টিওপোরোসিস (এ রোগে হাড় দুর্বল হয়ে যায় এবং ভাঙার ঝুঁকি বেড়ে যায়) রোগে না ভুগতে চাইলে নিয়মিত সূর্যের আলো শরীরে লাগাতে হবে।
এই রোগ সম্পূর্ণ সারে না, তবে চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো থাকা যায়। তবে ঠিক সময়ে রোগের চিকিৎসা না হলে ফল হয় মারাত্মক। তাই কোনো জয়েন্টে হঠাৎ করে ব্যথা শুরু হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন। মনে রাখবেন, এই রোগ যতটা কন্ট্রোলে রাখবেন, ততই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন।
ছবিঃ সাটারস্টক