মানবদেহে জ্বর যেমন কোন স্পেসিফিক রোগ নয়, ঠিক তেমনি রক্তশূন্যতাও স্পেসিফিক কোন রোগ নয়। এনেমিয়া (Anemia) বা রক্তশূন্যতা হওয়ার জন্য অন্য কোন রোগ পিছনে থাকে। রক্তশূন্যতা মানে কিন্তু রক্ত কমে যাওয়া নয়। বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী রক্তের লোহিত কণিকায় উপস্থিত হিমোগ্লোবিন প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে কমে যাওয়ার অবস্থাকে রক্তশূন্যতা বা এনেমিয়া বলে।
বয়স ও লিঙ্গ অনুসারে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হয়। সাধারণত জন্মের সময় নবজাতক শিশুর শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ১৪ থেকে ২৪ গ্রাম/ডেসিলিটার। পরবর্তীকালে ৩ মাস বয়স থেকে তা কমতে শুরু করে এবং প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে হিমোগ্লোবিন কিছুটা বৃদ্ধি পায়। পুরুষদের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা ১৩.৮ থেকে ১৭.২ গ্রাম/ডেসিলিটার আর মহিলাদের ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৫.৫ গ্রাম/ডেসিলিটার। পুরুষ কিংবা মহিলা যে কারও ক্ষেত্রেই, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৭ গ্রাম/ডেসিলিটার-এর কম হয়, তবে এটা মারাত্মক এনেমিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়।
[picture]
মহিলাদের ক্ষেত্রে অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে তারা যখন সন্তান জন্মদানের উপযুক্ত বয়সে পৌছায়। আয়রনের অভাবে অ্যানিমিয়া একমাত্র কারণ নয়। নিম্নলিখিত কারণে অ্যানিমিয়া হতে পারে।
১) রক্তের লোহিত কণিকার উৎপাদনজনিত সমস্যার কারণে-
- আয়রনের ঘাটতিজনিত এনেমিয়া।
- ভিটামিন-বি, ফলিক এসিডের ঘাটতিজনিত এনেমিয়া।
- এপ্লাস্টিক এনেমিয়া (অস্থিমজ্জার উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হলে হয়)
- বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী অসুখ যেমন-কিডনি বিকল, লিভার বিকল, থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা ইত্যাদি কারণে এনেমিয়া।
- লিউকোমিয়া (Leukemia) বা রক্তের ক্যান্সারজনিত কারণে।
২) রক্তশূন্যতা রক্তের লোহিত কণিকা দ্রুত ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে-
- জন্মগত কারণে যেমন থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia)।
- বিশেষ কিছু ইনফেকশনের কারণে যেমন ম্যালেরিয়া।
- শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার জটিলতার কারণে।
রক্তক্ষরণজনিত কারণে-
- কৃমি, পেপটিক আলসার, দীর্ঘমেয়াদী ব্যথার ওষুধ, পাইলস, অতিরিক্ত ঋতুস্রাব।
- দূর্ঘটনাজনিত হঠাৎ রক্তক্ষরণ।
তবে শতকরা ৭৫-৯০ এনেমিয়া-এর কারণ আয়রনের অভাব। এছাড়াও আরো কিছু কারণেও এর ঝুঁকি বাড়তে পারে-
১. খাবারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণ লৌহের যোগান না পেলে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
২. প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাবার কম খেলে, হজমে সমস্যা, পাকস্থলীর বাইপাস অপারেশন ইত্যাদি কারণে পাকস্থলীর খাবার থেকে লৌহ শোষণের ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং এর ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
৩. ভিটামিন-সি জাতীয় খাবার কম খেলে।
৪. ডেইরি প্রোডাক্ট, চা, কফি বেশি খেলে। কারণ এসব খাবার আয়রন শোষণ বাধাগ্রস্ত করে।
- দুবার গর্ভধারণের মধে অল্প বিরতি থাকলে।
- ২০ বছরের নিচে গর্ভধারণ করলে।
- পূর্বে সন্তান জন্মদানের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঘটনা ঘটলে।
রক্তশূন্যতার লক্ষণ
মৃদু এনেমিয়া-এর ক্ষেত্রে তেমন কোন লক্ষণই দেখা যায় না। তবে রক্তশূন্যতা প্রকট হলে নিচের উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে-
- অবসাদ, দূর্বলতা, ক্লান্তি
- বুক ধড়ফড় করা
- স্বল্প পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট
- মাথা ঝিমঝিম করা
- চোখে ঝাপসা লাগা
- মাথা ব্যথা করা
- হাতে পায়ে ঝিনঝিন করা, অবশভাব হওয়া
- হাত, পা, সমস্ত শরীর ফ্যাকাসে হয়ে আসা
- অস্বাভাবিক খাদ্যের প্রতি আসক্তি জমায়
- মুখের কোণায় ঘা বা প্রদাহ
- খাদ্য গিলতে অসুবিধা
- নখের ভঙ্গুরতা ও চামচের মতো আকৃতির নখ হয়ে যাওয়া
এনিমিয়ার চিকিৎসা
রক্তের সিবিসি (CBC) পরীক্ষা করলেই রক্তশূন্যতা ধরা পড়ে। রক্তের সিবিসি পরীক্ষা করে রক্তে লোহিত রক্তকণিকা ও হিমোগ্লোবিনের মাত্রা দেখা হয়। আয়রনের মাত্রা দেখার জন্য সেরাম আয়রন ও সেরাম ফেরিটিন পরীক্ষা করা হয়।
যেকোনো ধরনের রক্তশূন্যতায় চিকিৎসা দেওয়া হয় রক্তশূন্যতার পেছনের কারণটিকে বিবেচনা করে। আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতায় কী কারণে আয়রনের ঘাটতি হলো তা আগে নিশ্চিত করতে হবে। অপুষ্টিজনিত কারণে হলে আয়রন সাপ্লিমেন্ট হিসেবে দেওয়াটাই মূল চিকিৎসা। সঙ্গে আয়রনসমৃদ্ধ খাবারের পরামর্শ দেওয়া হয়। কচু শাক, ডাঁটা শাক, পালং শাক, শিম ও শিমের বিচি, কাঁচা কলা, সামুদ্রিক মাছ, কলিজা, গিলা, গরু-খাসির মাংসে প্রচুর আয়রন থাকে। আয়রন সাপ্লিমেন্ট দু’ভাবে দেওয়া হয়- মুখে খাবার জন্য ট্যাবলেট আকারে এবং শিরায় ইনজেকশন হিসেবে। কোন উপায়ে রোগী এটা নেবেন তা রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসক পরামর্শ দেবেন। পেপটিক আলসার, অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, পাইলস থাকলে তার চিকিৎসা করতে হয়।
রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে করণীয়
এ রোগের প্রাথমিক অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে লৌহ সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন- কচু, ধনেপাতা, আটা, কালোজাম, চিড়া, শালগম, কলিজা চিংড়ি, ডাঁটা শাক, আমচুর, পাকা তেঁতুল, ফুলকপি, শুঁটকি মাছ এবং পালংশাক ইত্যাদি খেতে হবে। এর সাথে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ টক জাতীয় ফল খেতে হবে। ভিটামিন-সি জাতীয় খাবার রক্তে আয়রন শোষণে সাহায্য করে।
কিছু ওষুধ এবং খাবার যেমন-দুগ্ধজাতীয় খাবার, অ্যান্টাসিড ওষুধ, চা ও কফি ইত্যাদি মানুষের পাকস্থলীতে অন্যান্য খাবার হতে আয়রন শোষণের মাত্রা কমিয়ে দেয়। সুতরাং, আয়রনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের আগে ও পরে এসব ওষুধ অথবা খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
আয়রন সাপ্লিমেন্ট নেয়ার আগে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যাতে সাথে সাথে বেশি খাবার গ্রহণ না হয় এতে রক্তে আয়রন শোষণ ব্যাহত হয়।
অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা একটি প্রচলিত সমস্যা। সাধারণত মেয়েরাই এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেও রক্তশূন্যতা দূর করা যায়। শরীর দূর্বল বা ফ্যাকাসে হলেই অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজেরাই আয়রন সিরাপ বা ট্যাবলেট খেয়ে থাকেন। এতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি থাকে। যেমন- থ্যালাসেমিয়া রোগে রক্তশূন্যতা হয় ঠিকই কিন্তু শরীরে আয়রনের অভাব হয় না। বরং আয়রন জমা হয়ে সমস্যার সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে রোগীর দেহে বাইরে থেকে রক্তের প্রয়োজন হয়। নিয়মিত কৃমির ওষুধ খেতে হবে। তবে যেকোন ওষুধ প্রয়োজন হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে হবে।