কলেজ পড়ুয়া রাইকার কিছুদিন ধরে পেটে ব্যথা হচ্ছিল। পরীক্ষার জন্য চিকিৎসকের কাছে না যেয়ে নিজেই কিছু পেইন কিলার খেয়ে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করছিল। একদিন ব্যথার তীব্রতা এত বেড়ে যায় যে হাসপাতালে নিতে হয়। সেখানে গিয়ে জানা গেলো রাইকা অ্যাপেন্ডিসাইটিসে ভুগছে। দ্রুত তার অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এমন সমস্যায় আমাদের আশেপাশে অনেকেই ভুগছেন। কিন্তু সঠিক তথ্য না জানায় অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর কারণে পেটে ব্যথা শুরু হলে কী করতে হবে সেটা বুঝে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। আজ আপনাদের জানাবো কেন এই ব্যথা হয় এবং এর চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য।
অ্যাপেন্ডিক্স এর ব্যথা কেন হয়?
আমাদের শরীরে বৃহদন্ত্রের সিকামের সাথে সংযুক্ত অনেকটা কনিষ্ঠ আঙুলের মতো একটি এক মুখ বন্ধ সরু থলি হলো ভার্মিফর্ম অ্যাপেন্ডিক্স। ‘ভার্মিফর্ম’ শব্দটির অর্থ কেঁচোসদৃশ। অ্যাপেন্ডিক্স অর্থ পরিশিষ্ট। অর্থাৎ ভার্মিফর্ম অ্যাপেন্ডিক্স হলো পরিপাকতন্ত্রের কেঁচোসদৃশ একটি পরিশিষ্ট ক্ষুদ্রাঙ্গ।
অ্যাপেন্ডিক্সের অবস্থান তলপেটের ডানদিকে। লম্বায় এটি ২ থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এর ব্যাস সাধারণত ৬ মি.মি. হয়। বিবর্তনের ধারায় মানবদেহে এটি এখন আপাতভাবে নিষ্ক্রিয় একটি অঙ্গ। এটির সঠিক কাজ নিয়ে এখনো রয়েছে অস্পষ্টতা। আমাদের পূর্ব পুরুষদের কোনো একসময় হয়তো খাদ্য পরিপাকে এর প্রয়োজনীয়তা ছিল, সময়ের সাথে সাথে এই অ্যাপেন্ডিক্স ছোট হয়ে তার কার্যক্ষমতা এখন হারিয়ে ফেলেছে। তবে ধারণা করা হয় যে, আন্ত্রিক (enteric) ইমিউনিটির মতো কিছু কাজ এখনো সম্পাদন করে অ্যাপেন্ডিক্স। এই ছোট্ট থলেতেই আকস্মিক প্রদাহ হলে দেখা দেয় অ্যাপেন্ডিসাইটিস।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস কী?
কোনো কারণে অ্যাপেন্ডিক্সে খাদ্যকণা, ময়লা, মল বা কৃমি ঢুকে গেলে কিংবা পাথর তৈরি হলে অথবা অসাবধানতাবশত খাদ্যদ্রব্যের সাথে গ্রহণকৃত কোনো মেটালিক বস্তু, পিন ইত্যাদি কোনোক্রমে অ্যাপেন্ডিক্সের নালীপথ বন্ধ করে দিলে, ক্ষুদ্রান্ত্র বা বৃহদান্ত্রের কোনো টিউমার বাইরে থেকে অ্যাপেন্ডিক্সের উপর চাপ প্রয়োগ করে অ্যাপেন্ডিক্সের নালীপথ বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে পর্যাপ্ত রক্তসঞ্চালন ও পুষ্টির অভাব দেখা দেয়। সিকাম আর অ্যাপেন্ডিক্সের সংযোগস্থলে একটি ছিদ্রসদৃশ অংশ রয়েছে। কোনো কারণে হঠাৎ করেই কিংবা ধীরে ধীরে যদি ছিদ্রটি বন্ধ হয়ে যায়, তখন ভেতরে থাকা কোনোকিছু আর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে অ্যানেরোবিক ব্যাকটেরিয়াসহ (অক্সিজেনহীন পরিবেশে বৃদ্ধি পায় এমন ব্যাকটেরিয়া) নানা ধরণের জীবাণুর আক্রমণে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে অ্যাপেন্ডিক্সে। এই সংক্রমণ থেকেই তৈরি হয় অ্যাপেন্ডিক্সের প্রদাহ বা অ্যাপেন্ডিসাইটিস।
প্রদাহের ফলে অ্যাপেন্ডিক্স অনেক ফুলে যায়, এর টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অ্যাপেন্ডিক্সে পচন ধরতে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৫% মানুষ জীবনের কখনো না কখনো এই সমস্যায় ভুগে থাকেন। কখনো কখনো সংক্রমণ অ্যাপেন্ডিক্স থেকে আশেপাশের বিভিন্ন অঙ্গে, পেরিটোনিয়াম নামক পেটের আবরণীতে এমনকি সমস্ত পেটজুড়েও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর ধরন
সাধারণত দুই ধরনের অ্যাপেন্ডিসাইটিস ক্লিনিক্যালি দেখা যায়।
১) একিউট অ্যাপেন্ডিসাইটিসঃ এই ধরনে রোগের লক্ষণ হঠাৎ করে কয়েক ঘন্টার মাঝেই তীব্রভাবে প্রকাশ পায়
২) ক্রনিক অ্যাপেন্ডিসাইটিসঃ এই ধরনে রোগের লক্ষণ দীর্ঘদিন ধরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ভোগাতে থাকে
সাধারণত ক্রনিক অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণগুলো দীর্ঘমেয়াদী ও মৃদু দুই ধরনের হয়। কিন্তু হঠাৎ করে কখনো কখনো এইসব লক্ষণের তীব্রতা বেড়ে যেতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে এই ধরনের অবস্থাকে বলা হয় একিউট অন ক্রনিক অ্যাপেন্ডিসাইটিস।
সে লক্ষণগুলো দেখলে সতর্ক হতে হবে
অ্যাপেন্ডিসাইটিসের প্রথম ও প্রধান লক্ষণ হল পেটে ব্যথা। এই ব্যথা সাধারণ পেট ব্যথার তুলনায় একটু আলাদা হয়। অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা সাধারণত নাভির চারপাশে বা নাভির একটু ওপর থেকে শুরু হয়। কয়েক ঘণ্টা পর তলপেটের ডান দিকের অংশে ব্যথাটা স্থায়ী হয়। থেমে থেমে ব্যথা ওঠে যা তীব্র ও হালকা- দুই রকমেরই হতে পারে। তবে শুরুর দিকে ব্যথা সাধারণত কম থাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে সময়ের সাথে ব্যথা বাড়তে থাকে।
যে যে সময়ে ব্যথা বাড়তে পারে-
- খাবার গ্রহণ করলে
- হাঁটাহাঁটি করলে
- বসা অবস্থা থেকে ওঠার সময়
- সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়
- নড়াচড়া করলে
- গভীরভাবে দম নিলে
- হাঁচি বা কাশি দিলে
তলপেটের ডানদিকে ব্যথার সাথে সাথে তলপেটের মাংসপেশিসমূহও বেশ আঁটোসাঁটো হয়ে পড়ে। এছাড়া বমি বমি ভাব বা দুই একবার বমিও হতে পারে। সঙ্গে ক্ষুধামন্দা ও হালকা জ্বর থাকতে পারে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। অনেক সময় তলপেট ফুলে উঠতেও দেখা যায়। ব্যথা তীব্র হলে রোগী হাসপাতালে আসতে বাধ্য হয়। তবে হালকা ব্যথা হলেও সতর্ক হতে হবে। কেননা পরবর্তী সময়ে রোগীর অ্যাপেন্ডিক্সের চারদিকে বিভিন্ন উপাদান জমা হয়ে পেটে একটি চাকা বা ফোঁড়ার মত তৈরি হতে পারে।
কী কী জটিলতা দেখা দিতে পারে?
অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর কারণে পেটে ব্যথা শুরু হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথায় সাধারণত অপারেশন করাতে হয়। কিন্তু অনেক সময়ই এ ব্যথাকে আমলে না দিয়ে কিংবা গ্যাসের ব্যথা তকমা দিয়ে নানা রকম ব্যথানাশক বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন অনেকে। এতে পরবর্তী সময়ে রোগীর শরীরে মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয়। সময়মতো চিকিৎসা না হলে অ্যাপেন্ডিক্স ছিদ্র হয়ে খাদ্যনালীর ভেতরের বিভিন্ন উপাদান, পরিপাক হয়ে যাওয়া খাবারের অংশ ও মল বের হয়ে পুরো পেটে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে পেটের ভেতরে, এমনকি রক্তেও ছড়িয়ে পড়তে পারে গুরুতর সংক্রমণ। এ ধরনের ঘটনায় রোগীর জীবননাশের আশঙ্কাও দেখা দেয়।
প্রতিরোধ করার উপায়
সাধারণত অ্যাপেন্ডিসাইটিস প্রতিরোধের শতভাগ কার্যকর কোনো উপায় নেই। তবে কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখলে রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। যেমন-
১) পরিমিত পরিমাণে পানি পান করা
২) নিয়মিত আঁশসমৃদ্ধ খাদ্যগ্রহণ করা
৩) মৌসুমি ফলমূল খাওয়া
৪) শিশুসহ প্রাপ্তবয়স্ক সকলেরই নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ সেবন করা
৫) খাবার গ্রহণের সময় খাদ্যদ্রব্যের সাথে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তু, যেমন- পিন, মেটালিক জিনিস, পাথর ইত্যাদি যেন ভেতরে প্রবেশ না করে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
চিকিৎসা
সময়মতো অস্ত্রোপচার করা না গেলে বা সমস্যা ধরা না পড়লে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের কারণে মৃত্যুও হতে পারে। এজন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে ‘সার্জিক্যাল ইমার্জেন্সি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। তাই অ্যাপেন্ডিসাইটিসের সমস্যা হেলাফেলা করা উচিত নয়। অ্যাপেন্ডিসাইটিসের চিকিৎসা হলো আক্রান্ত অংশ বা অ্যাপেন্ডিক্স যত দ্রুত সম্ভব অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে ফেলে দেওয়া। ল্যাপারোটোমি বা ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে এই অস্ত্রোপচার করা যায়।
দুঃখজনক বিষয় হলো অস্ত্রোপচারের ভয়ে অনেকেই হাসপাতালে যেতে চান না। আবার অনেক সময় শিশু বা বেশি বয়স্করা ব্যথার সঠিক বর্ণনাও দিতে পারে না। কিন্তু জটিলতা এড়াতে তলপেটে ব্যথা তীব্র ও স্থায়ী কিংবা থেমে থেমে হলে রোগীকে শক্ত খাবার দেওয়া থেকে বিরত থাকুন এবং দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর কারণে পেটে ব্যথা হলে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ করবেন না। সুস্থ থাকতে হলে হেলদি লাইফস্টাইল ফলো করুন। সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক, stuff.co.nz