গত পর্বে একটি নিপীড়নমূলক বা এ্যাবিউসিভ সম্পর্ক কি কি ধাপের মধ্য দিয়ে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম।একটি নিপীড়নমূলক সম্পর্কে কি কি বৈশিষ্ট্য দেখা যায় সেটিও সংক্ষেপে বলা হয়েছিল। এ পর্বে চেষ্টা করব একজন নিপীড়নকারী কিভাবে আপনার সমগ্র অস্তিত্বের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলে সেটি ব্যাখ্যা করতে।
শুরুতেই জানিয়ে রাখি, এ লেখাটি মৌলিক কিছু নয়। আমি থিওরিটিকাল দিকটি নিয়েছি খ্রিশ্চিয়ান এ্যান্ডারসনের “কাউন্সেলিং সারভাইভরস অফ ডমেস্টিক এ্যাবিউজ(২০০৮)” বইটি থেকে ; এ বই থেকে নেয়া ধারণাগুলো বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করতে নিজস্ব পুলিশি অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেছি।একাডেমিক গবেষণা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, নিপীড়িত মানুষগুলো যেন সচেতন হতে পারেন, সেজন্যেই এটি লিখেছি।
ডমেস্টিক ভায়োলেন্স সম্পর্কিত এ গবেষণাটি যদিও শুধুমাত্র নারী ভিকটিমদের স্টাডির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় নারী ছাড়িয়ে এটি পুরুষদের জন্যেও ব্যবহৃত হচ্ছে। মনে রাখবেন, একজন নিপীড়ক স্রেফ একজন নিপীড়ক, তার লিঙ্গপরিচয় এখানে মূখ্য নয়। বহু পুরুষ আমাদের সমাজে আছেন যাঁরা নির্যাতিত হন, লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারেন না।আশা করি এ লেখাটি তাঁদেরও কাজে আসবে।
চলুন দেখে নেয়া যাক কিভাবে একজন নিপীড়ক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেঃ
প্রথম ধাপ বিশ্বাস অর্জন (Building Trust)
শুরুতে আপনার পার্টনার হবে ইহজগতের শ্রেষ্ঠতম মানব সন্তান। কথা হবে চিনির চাইতেও মিষ্টি, ব্যবহার হবে মধুর চেয়েও মধুর।ভালবাসার তুফান বইয়ে দেবে সে, আপনাকে ছাড়া যে এই ধরাধামে আর কিছু আছে এটা আপনি বুঝতেই পারবেন না। আপনার ক্ষুদ্রতম কথাকেও এমনভাবে গুরুত্ব দেবে যেন আপনি সম্রাজ্ঞী বিলিকিস বা সম্রাট শাহজাহান।এভাবে মধুর আচরণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিশ্বাস অর্জন করবে আপনার, আপনি হবেন তার জন্যে পাগল| এমন অবস্থা হবে, সারা দুনিয়া তার জন্যে ছেড়ে আসতে এক মুহূর্ত দেরি করবেন না। কথায় বলে, “যার লাগি মজে মন, কিবা হরি কিবা ডোম!”
দ্বিতীয় ধাপ মাত্রাতিরিক্ত জড়িয়ে পড়া (Overinvolvement)
এই ভালবাসার মায়াজাল পেতে নিপীড়ক আপনার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাবে।আপনি কি খান, কোথায় ঘুমান, কি মুভি দেখেন- সব কিছুতে সে তার উপস্থিতি জানান দেবে। আপনিও ভালবাসায় গদগদ হয়ে মনে করবেন, বাহ, আমার প্রতি এত কেয়ারিং ও! কল্পনাও করতে পারবেন না কি আসছে সামনে।
তৃতীয় ধাপ ছোটখাটো নিয়ম বানানো এবং অতিরিক্ত ঈর্ষা (Petty Rules and jealousy)
ভালবাসার নামে নিপীড়ক এবার আস্তে আস্তে আপনার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে।ছোট ছোট নিয়ম আদুরে গলায় বলবে-“প্লিজ দেরি কোর না, পাঁচটার পরে বাইরে থেকো না – আমার খারাপ লাগে( অথচ আপনার জীবিকার তাগিদেই হয়ত দীর্ঘ সময় বাইরে থাকা লাগে)। অথবা, “কি দরকার কষ্ট করে চাকুরি করার, আমি চাইনা তুমি এত কষ্ট কর- আমার সাথে বাসায় থাকলেই তো পারো”( অথচ আপনি চরম মেধাবী একজন মানুষ, কাজ আপনার কাছে আপন সত্তার মতই প্রয়োজনীয়)। এই ছোট ছোট নিয়ম বানানোর সাথে আসবে ঈর্ষা- অমুকের সাথে মেশা যাবেনা, তমুককে ফেসবুক থেকে ডিলিট করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। নিপীড়ক চেষ্টা করবে এগুলোকে তার “ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ” হিসেবে দেখাতে।
চতুর্থ ধাপ ম্যানিপুলেশন, ক্ষমতা প্রদর্শন এবং নিয়ন্ত্রণ( Manipulation, Power and Control)
এবার আসল খেলা শুরু, কারণ প্রথম তিন ধাপে আপনি মোটামুটি নিপীড়কের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। নিপীড়নকারী এবার ভেড়ার ছাল ছুঁরে ফেলে নেকড়ে হিসেবে বেরিয়ে আসবে, আপনার উপর চালাবে চরমতম ম্যানিপুলেশন ও ক্ষমতা প্রদর্শন। আপনার প্রতিটা পদক্ষেপকে রোবটের মত নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে সে।
পঞ্চম ধাপ ট্রমাটিক বন্ডিং বা পীড়ামূলক বন্ধন (Traumatic Bonding)
এ লেখাটি লিখতে গিয়ে একটি বিশাল উপকার হয়েছে আমার, গত তিন চার বছর ধরে খোঁজা একটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছি। গুলশান আর উত্তরায় অন্তত জনাপঞ্চাশেক নারী আমার সরকারী নম্বরে সহায়তা চেয়েছেন এ সময়কালে। এঁনাদের প্রত্যেকেই সুশিক্ষিতা, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং প্রতিষ্ঠিত পরিবার থেকে এসেছেন। এঁদের মধ্যে দুটো জায়গায় মিলঃ ১) এনাদের প্রত্যেকের স্বামী নেশা, পরনারী ইত্যাদি যাবতীয় অপকর্মের সাথে জড়িত এবং ২) এনারা কেউই প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হবার পরেও অপোগণ্ড স্বামীকে ছেড়ে যেতে রাজী নন।
স্ত্রীর টাকায় নেশা করে, স্ত্রীকে জোর করে অন্যের শয্যাশায়িনী করে টাকা নেয়, স্ত্রীর আয়ের পুরোটা খরচ করে অন্য মেয়ে আর মদের পেছনে, প্রতিনিয়ত স্ত্রীকে বেল্ট দিয়ে পেটায়- তার পরেও এই সতিসাধ্বী স্ত্রীগণ তাঁদের নরপশু স্বামীকে ছেড়ে যেতে রাজী নন। কারণটা যে সব সময় লোকলজ্জা বা পারিবারিক চাপ, তা নয়- এনাদের মগজে আসলে পচন ধরে গিয়েছে।স্বামী দুশ্চরিত্র হোক, মাতাল হয়ে প্রতিদিন মারধোর করুক, কিছুতেই আপত্তি নেই। আমার কাছে ছুটে আসতেন যে ড্রাগ সাপ্লাই দেয় তাকে ধরিয়ে দিতে। আমি বোঝাতাম, এটা করতে হলে সুনির্দিষ্ট প্রসিডিউর আছে, ড্রাগ ডীলারকে ধরার পাশাপাশি স্বামীকেও চিকিৎসা করাতে হবে, প্রয়োজনে তাকে পুলিশের কাছে আসতেও হতে পারে। কিছু কিছু ড্রাগ ডীলার ধরেছিলামও, কাজ হয়নি। একটা ধরা পড়ে, সাথে সাথে আরো দশটা গজায়- আর স্বামীও মহাসুখে স্ত্রীর টাকায় ড্রাগ কিনে সেই স্ত্রীকেই পেটায়।বিরক্ত হয়ে একবার বলেই ফেলেছিলাম- “দুনিয়ার যত ড্রাগখোর, হেরোইঞ্চি আর বদমায়েশগুলোর কপালেই মনে হয় সবচাইতে লয়াল স্ত্রীগুলো জোটে”।
এটা যে আসলে এক ধরণের ট্রমাটিক বন্ডিং, তা জাপান এসে আপনাদের জন্যে এই লেখাটি লিখতে গিয়ে শিখলাম! আপনাদের প্রতি প্রকাশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমার মাথায় অনেক দিন ধরে জমে থাকা এ প্রশ্নটির উত্তর পাইয়ে দেবার কারণে। অতিরিক্ত ট্রমায় পড়ে এঁনারা নিপীড়কের উপরেই ইমোশনালি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
আগামী পর্বে লিখব নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা প্রদর্শনচক্র(Power and Control Wheel) নিয়ে, যেটাকে এ্যাকাডেমিক পরিভাষায় বলে ডুলুথ মডেল(Duluth Model)।এই মডেলে একজন নিপীড়নকারী যতরকম ট্যাকটিকস ব্যবহার করে তার সবগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে আপনাদের।
প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, দর্শন/বিজ্ঞান ইত্যাদি মনগঙ্গার তোলা জল, এর সম্পূর্ণ স্রোত শুধুমাত্র সাহিত্যেই বিদ্যমান। আজকের লেখাটির সারাংশ বোঝাতে তাই সাহিত্যের আশ্রয় নিতে হচ্ছে।আমার খুব প্রিয় একটা বইয়ের নাম “শান্তারাম”(Shantaram)- জর্জ ডেভিড রবার্টস নামের এক প্রাক্তন ব্যাঙ্ক ডাকাতের লেখা। উক্তিটি এরকমঃ
“Most loves are like that, from what I can see. Your heart starts to feel like an overcrowded lifeboat. You throw your pride out to keep it afloat, and your self-respect and your independence. After a while you start throwing people out—your friends, everyone you used to know. And it’s still not enough. The lifeboat is still sinking, and you know it’s going to take you down with it. I’ve seen that happen to a lot of people here. I think that’s why I’m sick of love.”
প্রেম আপনাকে এমনভাবে গ্রাস করবে, নিজের হৃদয়টাকে মনে হবে অত্যাধিক ভীড়ে আক্রান্ত লাইফবোটের মত। এটাকে ভাসিয়ে রাখতে প্রথমে আপনি আপনার গর্ব বিসর্জন দেবেন, তারপর ছুঁড়ে ফেলবেন স্বাধীনতা আর আত্মসম্মান। কিছু সময় পর আপনি এটা থেকে মানুষজনকে ছুঁড়ে ফেলা শুরু করবেন- প্রথমে আপনার বন্ধুদের, তারপর আত্মীয়দের, তারপর যাদেরকে চেনেন সবাইকে। তবুও দেখবেন, প্রেম নামের তথাকত্থিত জীবনতরীটাকে ভাসিয়ে রাখতে আপনার সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারও যথেষ্ট না। তরী ডুবছে তো ডুবছেই, সেই সাথে ডোবাচ্ছে আপনাকে।
প্রিয় পাঠক, আজকের লেখাটি পড়ে মিলিয়ে নিন আপনি ঠিক কতটুকু ডুবেছেন- ভেসে উঠতে চাইলে ডোবার মাত্রাটা জানা খুব জরুরী কিনা!
সঙ্গে থাকুন, এই অধম আছে আপনাদের পাশে!
চলবে……
লিখেছেনঃ মাসরুফ হোসেন
ছবিঃ মাসরুফ হোসেন, dailyrecord.co.uk