মানবশিশুর স্বনির্ভরতা, কতোটা প্রয়োজন আর কতোটা বাড়াবাড়ি তা নিয়ে কিছু কথা বলতে চলেছি। বাচ্চার লালনপালন কেমন হবে, আসলেই কেমন হওয়া উচিত সে নিয়ে ব্যক্তিভেদে একেক রকম মত মিলবে। কেউ হয়তো তিন বছরের শিশুকে নিজ হাতে খাবার খেতে শেখাতে চাইবে, স্বনির্ভর হবার প্রথম পাঠ দেবে। অন্যদিকে কোন কোন পরিবারে চার বছরের শিশুও এখনো ডায়পারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরিবারভেদে বিষয়টা একেক জায়গায় একেক রকম। সেভাবে দেখতে গেলে সব বিষয়ই স্থান, কাল ও পাত্রভেদে বিভিন্ন রকম হয়, হয় বিভিন্ন মতের। কিন্তু প্রতিটি জিনিষেরই উচিত ও অনুচিত বলে কিছু সার্বজনীন মাপকাঠি থাকে। কমবেশি সেগুলো মেনে চলাটা আমাদেরকে মঙ্গলের পথেই চালিত করতে পারে। শিশুর লালনপালনেও আছে তেমনই কিছু বিষয়, যা নির্ধারিত আছে শিশুর জন্য ভালো বা মন্দ হিসেবে।
[picture]
স্বনির্ভর করা এবং অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে দেয়া, দুটি অবশ্যই ভিন্ন বিষয়। মাথায় থাকুক এই ফারাকটা। বাচ্চাকে স্বনির্ভর করতে চাচ্ছেন মানে তাকে নিজের কিছু দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে চলেছেন। সে আপনার থেকে দূরে সরে গিয়ে একা চলতে যাচ্ছে না। আপনার ছোট বাচ্চাটার পক্ষে সেটা সম্ভবই নয়। অনেক অভিভাবক বিশেষত মায়েরা নিজের সন্তানকে অতিরিক্ত আগলে রাখতে গিয়ে স্বনির্ভরতার সামান্য শিক্ষাটুকুও দিচ্ছেন না। যা পরবর্তীতে বাচ্চার জন্যই অসুবিধার কারণ হয়।
বাচ্চাকে কোন কোন কাজ করতে দেবেন, কোনটা সে করতে পারবে তা আপনিই ভালো বুঝবেন। সে অনুযায়ী তাকে কাজ শেখানোর দায়িত্বটা বাবা এবং মায়ের সবচেয়ে বেশি। তবে দায়িত্ব নিতে হবে পরিবারের সব সদস্যকেই। কোন কাজটা আপনার বাচ্চা একদমই করতে পারবে না, করতে চাইবে না বা তার সমস্যা হবে, সেটাও বুঝে নিতে হবে আপনাকে। জোর করে নয় বরং স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষকে কিছু কাজকর্ম করতে হয়, এই ধারণাটার সাথে সন্তানকে যথাযথভাবে পরিচিত করানোটা অভিভাবকের কাজ।
বছর চারেক হবার মধ্যেই একটি মানবশিশু নিজের স্বাভাবিক চাহিদাগুলো বা প্রয়োজনের কাজ সম্পর্কে পরিবারের মানুষদের জানাতে সক্ষমতা লাভ করে। তার ক্ষুধা পেয়েছে, সে তার পুতুলটি দিয়ে খেলতে চাচ্ছে না বা সে টয়লেটে যাবে এমন কোন কথা সে অভিভাবককে বলার ক্ষমতা রাখে। যদি কোন বাচ্চার কথা বলতে বিশেষ কোন সীমাবদ্ধতা থাকে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। না হলে বাচ্চারা এই বয়সে পরিবারের মানুষদের কাছে নিজেকে কথার মাধ্যমে তুলে ধরতে পারে। এই শিক্ষাটা খুবই সহজাত, প্রকৃতি নিজেই প্রাণীদের এমন করে গড়ে তুলছে। কিন্তু প্রভাবক হিসেবে পরিবারের সদস্যদেরও কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। কোন কোন দম্পতিকে দেখা যায় চার বছরের বাচ্চাটাকেও নিজ হাতে খেতে দিতে অপারগ, সর্বক্ষণ তাকে ডায়পারে মুড়ে রেখে দিচ্ছে এবং সে বাচ্চা বয়সের তুলনায় স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছেও না। বাবা বা মায়ের কাছে এই বিষয়টা খুবই আহ্লাদের, তারা তাদের বাচ্চাকে আদরে ভরিয়ে রাখছে বলে গর্বও করছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে নিজের বাচ্চার ক্ষতি করছে কতোটা তা বুঝতে যাচ্ছে না। চার বছর বয়সে যদি আপনার শিশু তার টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজনবোধ আপনাকে পরিষ্কার করে জানাতে ব্যর্থ হয় তবে দয়া করে বুঝে নিন তার বিকাশ স্বাভাবিক হচ্ছে না।
ছয়/সাত বছরের শিশুকে নিয়মিত নিজ হাতে বা দেখভালকারীর হাতে খাবার খাইয়ে আপনি যদি সন্তুষ্ট থাকেন, তবে জেনে নিন, ভবিষ্যৎকালে কখনো বাচ্চার অভুক্ত থাকার দায়ও আপনার কাঁধে বর্তাবে। এই বয়সে শিশু পুরোপুরিভাবে হাত দিয়ে খাবার মুখে তুলে খেতে সক্ষম থাকে। তাকে সেই কাজটা শিখতে না দিয়ে চরমভাবে পরনির্ভরতার শিক্ষা দিচ্ছেন আপনি। পরবর্তী জীবনে যদি একেবারেই হুট করে তাকে নিজ হাতে খাওয়ার অভ্যাস করে নিতে হয়, নতুন এই কাজের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে তার সময় লাগে, তবে সে কম অসুবিধা পোহাবে না। সময়ের পাঠ সময়ে দেয়া সবসময়ই ভালো। আদর দেখাতে যেয়ে প্রয়োজনের কাজগুলিও সন্তানকে শিখতে দিচ্ছেন না যে, তাতে ক্ষতি কেবল সন্তানেরই করছেন।
কিশোর বয়সের ছেলেমেয়ে আপনার গ্লাসে পানিটা ঢেলে খেতে পারে না, বন্ধু বা স্বজনদের কাছে আহ্লাদ করে গল্প করছেন। আপনি ভাবছেন খুব যত্নে বড় করছেন বাচ্চাদের, তারা আপনার রাজপুত্র আর রাজকন্যা।
সে হোক না, ক্ষতি নেই কারো, কিন্তু আপনি নিজে তাদের ক্ষতি করছেন কিনা তা ভেবেছেন? জীবনের যেকোন দরকারের মুহূর্তে যখন তাকে কাজের সামনে পড়তে হবে, নিজের কাজগুলো নিজে করার দায়িত্বটা নিতেই হবে, তখন সে আচমকা অকূল সাগরে পড়বে না? তার তো ওসব কাজের সাথে সামান্য পরিচিতিটাই হয়নি! অভিভাবক হিসেবে সে দায়িত্বটা আপনারা পালন করেননি। পরিণত বয়সে গিয়ে নতুন একটা কাজ নিয়মিত করার চর্চায় অভ্যস্ত হতে আপনার আদরের বাচ্চাটাই বিপর্যস্ত হবে, সেটা ভুলে যাবেন না।
নিজের খেলনাগুলো এক জায়গায় জড়ো করে রাখতে দিন ছোট্ট বাচ্চাটাকে। গুছিয়ে চলার প্রবণতা যেনো তার হয়, সেই বীজটা বপন করুন ছোট থাকতেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে হলেও নিজ হাতে খাবার খেতে দিন বাচ্চাকে। অন্তত দিনের কোন একটা খাবার সে নিজের হাতে খাক। পেট না ভরুক, অন্য বেলায় তো আপনিই খাইয়ে দেবেন কিন্তু এভাবে তার শিক্ষাটা হবে। কখনো নিজ হাতে খেতে পারে না বলে না খেয়ে থাকবে না সে।
শিশুর ছোট ছোট প্রয়োজন তাকেই মিটিয়ে নিতে দিন। তবে এই শিক্ষাও দিন যাতে কোন অসুবিধায় পড়লে আপনাকে জানায়। সমস্যা লুকিয়ে রাখাটা যাতে স্বনির্ভরতার পাঠ না হয়, সচেতন থাকুন। আপনার ভালোবাসা কখনো সন্তানের জীবনের দুর্বলতা না হোক, সকল শিশুর জন্য এটাই আমাদের চাওয়া।
ছবি – ফটোগ্রাফারস.ক্যানভেরা.কম
লিখেছেন – মুমতাহীনা মাহবুব