আধুনিক সমাজের অনেককেই দেখি এসব ম্যাজিকাল আয়ুর্বেদিক সলিউসনকে বেশ নিচু চোখেই দেখেন। আবার অনেকে তো জানেনই না কিছু এসব সম্পর্কে। অবশ্য আমি আপনাদের দোষ দেবো না। আধুনিক আলোপ্যাঁথিক মেডিসিনের উপর আমাদের এমন অন্ধ এবং অগাধ বিশ্বাস যে আমরা আগে পিছে কিছু না ভেবেই নিশ্চিন্তে ট্যাবলেট খেতেই দিন দিন বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। একবার কি চিন্তা করেছেন কোন প্রেসক্রিপশন ছাড়াই খাওয়া প্যারাসিটামল বা পেইনকিলার ট্যাবলেটের সাইড এফেক্ট কত ভয়ানক হতে পারে? অথবা জানার চেষ্টা করেছেন এগুলোর মানবদেহে লং টার্ম এফেক্ট সম্পর্কে?
[picture]
জানি করেন নি, নয়ত আজকাল নিজের ছোট বাচ্চাদের হাতেও এত নিশ্চিন্তে নন প্রেস্ক্রাইবড ট্যাবলেট কীভাবে তুলে দেন আপনারা? আমি শুধু আপনাদের এতুকুই জানাতে চাই যে ছোট ছোট যে ঝামেলা গুলোকে এড়ানোর জন্য আপনারা নিজের ও নিজের সন্তানের পায়ে এত বড় কুড়াল মারছেন তা সামান্য কিছু ঘরোয়া উপায়ে কত সহজেই উপশম করা যায়। আজ আপনাদের জানাবো ত্রিফলা সম্পর্কে।
ত্রিফলা কি?
ত্রিফলা হল প্রাচীন আয়ুর্বেদের অন্যতম মূল্যবান ফর্মুলা বা concoction এবং আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় এটা এখনও প্রাচ্যের মেডিসিনের থেকে বেশি কার্যকরী। ‘ত্রিফলা’ নামের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘তিনটি ফল’ আর নামের সার্থকতা প্রমান করে এটা হরিতকী, বহেরা আর আমলকী এই তিনটি ফলের শুকনো গুঁড়া দিয়ে তৈরি। এই ফলগুলোর প্রত্যেকটিরই স্বাস্থ্য, ত্বক ও চুল রক্ষায় আছে অসামান্য ভূমিকা কিন্তু প্রাচীন আয়ুর্বেদের মতে যখন এদের একত্রে ব্যবহার করা যায় এদের গুণ হাজার গুনে বাড়ে, আর এই ধারণা থেকেই ত্রিফলার উতপত্তি।
স্বাস্থ্য রক্ষায় ত্রিফলাঃ
হয়ত আপনারা বুঝতেই পারছেন যে ত্রিফলায় আমলকীর প্রাচুর্য থাকার কারণে এটা খুব এফেক্টিভ ভাবে আপনাকে আপনার রোজকার প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি সরবরাহ করতে পারবে। এছাড়াও বহেরা আর হরিতকী মানবদেহে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলস সরবরাহ করে আপনাকে রাখে ভেতর থেকে সুস্থ এবং সেই সাথে বাড়ায় আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। সহজ কোথায় বলতে গেলে নিয়মিত ত্রিফলার সেবন আপনাকে সিসনাল ঠাণ্ডা, সর্দি, কাশি, জ্বরের হাত থেকে রাখবে অনেক দুরে। আসুন এক নজরে দেখে নেই আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ত্রিফলা কি কি করতে পারে-
– মানব দেহের বর্জ্য নিষ্কাশন করা আর ডিটক্সিফাই করায় ত্রিফলার মোকাবেলা আর কেউ করতে পারবে না।
– ত্রিফলা দেহের ভারসম্য বজায় রাখে, দেহ পরিষ্কার রাখে আর প্রয়োজনীয় ভিটামিন আর মিনারেলস দেয়।
– গবেষণায় দেখা গেছে হাই কোলেস্টেরল লেভেল আর আরথাইটিসের ঝুঁকি কমাতে ত্রিফলা ভূমিকা রাখে।
– ত্রিফলার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
– হজম প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে আর বদহজম জনিত সমস্যা দুর করে।
– শরীরে ফ্যাট সেল জমতে না দিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
– অন্ত্রের সব বর্জ্য দূর করে খাবার থেকে পুষ্টি গ্রহণ করার ক্ষমতা বাড়ায়।
– লিভার পরিষ্কার রাখে আর ডিটক্সিফাই করে।
– গলব্লাডার আর কিডনির পাথর হবার সম্ভবনা দূরে রাখে।
– এর উচ্চমাত্রার ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
-বাচ্চাদের সিসনাল রোগ দূরে রাখতে সহায়তা করে।
ত্বক, চুল ও চোখের জন্য ত্রিফলাঃ
নিশ্চয়ই জানেন যে শারীরিক সুস্থতাই আসলে উজ্জ্বল ত্বকের গোপন রহস্য? আপনার ত্বক আর চুল সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার মূল রয়েছে আসলে আপনার শারীরিক অসুস্থতার মাঝে। একারণেই আমরা রূপের যে ঠুনকো সমস্যা গুলোকে পাত্তা দেই না তাতে ডাক্তাররা খুঁজে পান বিভিন্ন রোগ ব্যাধির উপসর্গ।
আমি তো বলব আপনার পাতলা হতে থাকা চুল অথবা হঠাৎ উঠতে থাকা ব্রণ হচ্ছে আপনার দেহের আর্তচিৎকার! শরীর যখন প্রয়োজনীয় কিছু চেয়েও পায়না তখন দেখা দেয় এসব সমস্যা এবং যত শ্যাম্পু, সাবান বা ক্রিম ব্যবহার করুন না কেন যতক্ষণ পর্যন্ত মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে ততক্ষন আপনি এসবের হাত থেকে নিস্তার পাবেন না। তো এই আর্টিকেলের দ্বিতীয় ধাপে চলুন দেখি ত্রিফলা কীভাবে আপনাকে সুস্থ রেখে ভেতর থেকে দেয় উজ্জ্বল ত্বক, সুস্থ চুল-
– ডিটক্সিফাই করে আর শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভালো রেখে ত্রিফলা ত্বকের উজ্জলতা বাড়ায়। সুস্থ দেহের প্রতিফলন চেহারায় তো ফুটে উঠবেই।
– দেহে টক্সিন জমার কারণে হওয়া চর্মরোগ যেমন ব্রণ, হোয়াইট হেডস দূরে রাখে।
– কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ব্রণের সমস্যা কমিয়ে আনে এবং টিন এজের ব্রণের সমস্যা দূরে রাখে।
– এর বিভিন্ন এনজাইম আর অ্যান্টিঅক্সিডান্ট ত্বকের বার্ধক্য জনিত ভাঁজ পড়ার হার কমায়। আর তারুণ্য বজায় রাখে। ত্রিফলা ত্বককে ভেতর থেকে সুন্দর রাখে।
– ত্রিফলা চুলের প্রয়োজনীয় ভিটামিন আর মিনারেলস সরবরাহ করে।
– এতে থাকা আমলকী আর হরিতকী চুল পড়া কমায়। নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।
– ত্রিফলা আপনি হেয়ার প্যাকে মিশিয়ে ব্যবহার করেও ব্যবহার করতে পারবেন। এটা মাথার ত্বকের খুশকি আর বিভিন্ন দূষিত পদার্থ দুর করে ত্বক সুস্থ রাথে আর আপনাকে সিল্কি সুন্দর চুল দেয়।
– প্রাচীন আয়ুর্বেদ বিশ্বাস করে শরীরের ভেতর দূষিত পদার্থ থাকলে আর লিভার অপরিষ্কার থাকলে তা চোখের জ্যোতি কেড়ে নেয়। তাই নিয়মিত ত্রিফলা সেবনে চোখের ক্ষমতা দীর্ঘদিন বজায় রাখা যায়।
ত্রিফলা সেবনের উপায়ঃ
নিয়মিত সেবনের জন্য ত্রিফলার গুঁড়া ব্যবহার করাই ভালো। রোজ রাতে এক গ্লাস পানিতে এক চা চামচ ত্রিফলা গুঁড়া ভিজিয়ে রাখুন আর সকালে উঠে খালি পেটে পানিটা খেয়ে নিন। এর আধা ঘণ্টা পর সাধারণ খাওয়া দাওয়া শুরু করুন। এছাড়াও ত্রিফলার সাপ্লিমেনট পাওয়া যায় বাজারে। গুঁড়া ত্রিফলা না পেলে সাপ্লিমেনট ব্যবহার করতে পারেন। আগেই বলে রাখি, জিনিসটা খেতে কিন্তু ভয়ঙ্কর! প্রথম দিকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করবেন। পরে নিজে থেকেই অভ্যাস হয়ে যাবে।
কোথায় পাবেন ত্রিফলা?
যেকোনো আয়ুর্বেদিক বা হোমিয়প্যাথিক ফার্মেসিতে পেতে পারেন। ঢাকায় থাকলে নিউমার্কেটে পাবেন। আবার মিনা হারবালেরও একটা ত্রিফলা গুঁড়া প্রোডাক্ট আছে।
লিখেছেনঃ মীম তাবাসসুম
ছবিঃ স্বপ্নযাত্রা.কম