আনিকা: বৈশাখে মেয়েদের নিরাপত্তা … ও বাবা! তুই আবার এইগুলো নিয়ে কবে থেকে সচেতন?
সঞ্চা: ধুর! ফাজলামো বাদ দাও! আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু অনেক সিরিয়াস! দেখছো না কয়েক বছর ধরে পহেলা বৈশাখ মেয়েদের কী রকম হেনস্থা হতে হয়েছে? খবর কিছু রাখো?
আনিকা: উফফ! তুই কি দুষ্টুমিও বুঝিস না! তোর কি মনে হয়, আমি এইটা নিয়ে সিরিয়াস না? কী করা যায় একে নিয়ে বলতো?
সঞ্চা: হ্যাঁ, আমি জানি তুমি সিরিয়াস। কিন্তু কী করতে চাচ্ছো?
আনিকা: কেমন হয় যদি আমরা দুইজন মিলে বৈশাখে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে, ডিটেইল-এ কিছু লেখি? তোর কী মনে হয়?
সঞ্চা: বাহ! খুব ভালো আইডিয়া-তো! আসলে আমাদের সবারই আত্নরক্ষার জন্য মানসিক ও শারিরীকভাবে প্রস্তুত থাকা উচিত। কিভাবে প্রস্তুত থাকা যায়, এ বিষয়ে চলো দুইজন মিলে লিখে ফেলি!
আনিকা: এইতো এতক্ষণে একটা কাজের কথা বলেছিস! তবে হয়ে যাক?
বৈশাখে মেয়েদের নিরাপত্তা – মানসিকভাবে কিছু পূর্বপ্রস্তুতি
১. সব সময় সচেতন থাকুন
যে কোনো উৎসব মুখর দিনে, আনন্দে ভেসে যাই আমরা। কিন্তু আমাদের মেয়েদের শুধু আনন্দে ভাসলেই হবে না, চলার পথের চারপাশ লক্ষ্য রেখে নিজেকে বিপদ থেকে দূরে রাখতে হবে।
২. নিরাপদ জায়গা নিন
যখন দূর থেকে অপরিচিত কেউ আপনাকে আঙ্গুল তুলে অন্য কাউকে দেখাবে, তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদ জায়গায় চলে যান। যেমন: কোনো দোকান, যেখানে কোনো মানুষের সাহায্য চাইতে পারবেন, এমন জায়গায় চলে যাবেন। যদি রাস্তায় নিজের গাড়ি থামানো ও একা থাকা অবস্থায় আপনাকে অপরিচিত কেউ টার্গেট করে দেখায়, তখনও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নিন।
৩. ফোন সাবধানে রাখুন
সাধারণত আমরা কমবেশি সবাই ফোন হাতে রাখি। কিন্তু সাবধান! ভুলেও ভীড়ের সময় হাতে ফোন রাখবেন না। আর ব্যাগে রাখলেও তার চেইন-এর দিকটা যেন সব সময় ভিতরের দিকে থাকে।
৪. গাড়ির দরজা ভালোমত লক করুন
গাড়ির জানলার কাছে বসলে জানালা লক করুন কিংবা গাড়ির দরজা খুলে একা বসে থাকবেন না কখনো, এতে করে মোটর সাইকেল করে ব্যাগ বা ফোন ছিনতাই করতে সুবিধা হবে।
৫. জোরে চিৎকার করুন
কোনো দুষ্টচক্র দ্বারা বিপদে পড়লে আপনার স্বরের সর্বোচ্চ দিয়ে চিৎকার করুন। যদি আপনার চারপাশ ঘিরে ফেলে তবে হাত উঁচু করার চেষ্টা করুন যাতে অন্যরা সহজেই আপনার উপস্থিতি দেখতে পারে। আর কখনই অনেক ভিড়ের মধ্যে যাবেন না।
৬. দূরের পথে যেতে সাথে নোট রাখুন
যারা একা একা বাড়ি থেকে বের হন না, মানে যারা একা খানিক দূরে প্রথমবার যাচ্ছেন, তারা যেন রাস্তা না ভুলে যান, সে জন্য রাস্তায় যেতে যেতে সিরিয়ালি জায়গার নামের নোট রাখুন। আর হ্যাঁ, ফোনে নেট প্যাক নিয়ে বের হবেন। এতে করে গুগল ম্যাপ দেখেও আপনি রাস্তা ভুল করবেন না!
৭. কখনো একা হাটবেন না
অপরিচিত মানুষদের ভীড়ে কখনো একা হাটবেন না। এমন কোনো দল দেখলে তার থেকে অনেক দূরে থাকার চেষ্টা করুন। আর কোনো পরিবার বা মেয়েদের ভিড়ে মিশে যাওয়া ভালো হবে।
৮. অপরিচিত কাউকে বিশ্বাস করবেন না
ধরুন আপনার ব্যাগ বা ফোন ছিনতাই হয়ে গেল কিংবা আপনি কোনো রাস্তা চেনেন না, সেক্ষেত্রে কোনো অপরিচিত মানুষের কাছে সাহায্য চাবেন না। ফোন করতে হলে ফোনের দোকান খুঁজুন বা ট্রাফিক পুলিশের সাহায্য নিন রাস্তা হারিয়ে ফেললে।
৯. হিল এড়িয়ে চলুন
স্বাভাবিক যে শাড়ি পরলেই আমরা ভাবি- “শাড়ির সাথে একটু হিল না পড়লে কি হয়?” কিন্তু আপনি বিপদের সময় জোড়ে দৌড়াতে পারবেন না হিল-এর জন্যই। তাহলে নিজেকে নিরাপদ রাখতে হিল এড়িয়ে চলুন!
১০. যেকোনো বিপদে কল করুন ৯৯৯ নম্বরে
৯৯৯-এর কথা নতুন করে আসলে কিছু কি বলার আছে? আপনারা সবাই জানেন যে, ৯৯৯-এ কল করলে পুলিশের বিশেষ টিম যত দ্রুত সম্ভব বিপদগ্রস্থ ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে চলে যায়।
বৈশাখে মেয়েদের নিরাপত্তা – নিরাপত্তার অস্ত্র (Safety weapon)
স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে চাই নিরাপত্তা। এজন্য কিছু ক্ষতিকারক নয় অথচ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এমন অস্ত্র বা সেফটি উইপন সাথে রাখবেন সবসময় যাতে বিপদে কাজে লাগাতে পারেন। তেমনি কিছু জিনিসের সাথে আজ পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
১) পকেট স্টিক
একটা ০.৫ ইঞ্চি ব্যাসের এবং ৮ ইঞ্চি লম্বা ডাল (বা বাঁশের কঞ্চি) বা স্টিক নিয়ে সেটাকে সম্পূর্ণটা ডাক টেপ দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলুন। এতে কি হয় জানেন? ডাক টেপ স্টিক-টাকে ইভেনলি খুব হেভি করে দেয়। এই স্টিক দিয়ে যদি আক্রমণকারীকে সজোরে আঘাত করা যায় (হাতে, পিঠে বা পেটে), সেই ব্যক্তি খুব ব্যথা পাবে এবং চলে যাবে। বড় কোন ক্ষতিও হবে না।
২) পেপার স্প্রে
খুবই কার্যকর একটা অস্ত্র হতে পারে একটি মেয়ের নিরাপত্তার জন্য। দোকানে বা অনলাইনে কিনে নিতে পারেন অথবা ঘরেও বানিয়ে নিতে পারেন। একটা স্প্রে বোতল কিনবেন। একটি পাত্রে একে একে নিন-
- ৪ টে.চা. মরিচের গুঁড়া
- রাবিং অ্যালকোহল
- ২ টে.চা. বেবি অয়েল
- লেবু বা লিকুইড সোপ
সবগুলো উপকরণ একসাথে মিশিয়ে ঝাঁকান। সারারাত রেখে দিন। পরের দিন ছেঁকে স্প্রে বোতলে রসটা নিন। তৈরি হয়ে গেল আপনার নিজের বানানো পেপার স্প্রে। গুণ্ডাপাণ্ডা আসলেই চোখে স্প্রে করবেন।
৩) চোখা জিনিস
ব্যাগে সবসময় চোখা বা পয়েন্টি জিনিস রাখার চেষ্টা করবেন, যেমন-
- কলম,
- ফাউনটেইন পেন,
- সেফটি পিন,
- চোখা লেজের চিরুনি (Rat-tail comb),
- ড্রয়িং কম্পাস ইত্যাদি।
এই জিনিসগুলো আপনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদজনক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। যদি জীবনের জন্য ঝুঁকিমূলক আক্রমণের স্বীকার হন, তবে এই চোখা জিনিসগুলোর যেকোনোটা দিয়ে আক্রমণকারীর শরীরের নরম জায়গায় হিট করা যায়।
৪) পয়সা-মোজা
নামটা শুনে একটু অবাক হওয়ার কথা! কিন্তু হবেন না। একটা পুরনো মোজায় অনেকগুলো পয়সা (Coin) বা ছোট ছোট ভারী কিছু (অনেকগুলো পাথর বা ব্যাটারি) ভরে ব্যাগে রাখবেন। মোজার খোলা প্রান্ত ধরে পয়সা রাখা ভারী প্রান্ত ছুড়ে ছুড়ে শত্রুকে আক্রমণ করবেন।
৫) শক টর্চ ফ্ল্যাশলাইট
২টা বাটন থাকে এর- একটা লাইটের আরেকটা শক দেয়ার। আক্রমণকারীর গায়ে ধরে সেকেন্ডে শক দিলে সে পরে যাবে। অল্প পরিমাণ কারেন্টের শক দেয় যেটা- ১১০০-৩০০০ কিলোভোল্ট, সাথে খুব ভালো টর্চ হিসেবেও কাজ করে। দারুণ এই টর্চটা আপনি সহজেই অনলাইন থেকে কিনতে পারবেন। খুব লাইট ওয়েট ও ট্র্যাভেল ফ্রেন্ডলি এই যন্ত্রটি ইজিলি ব্যাগে ক্যারি করা যায়।
বৈশাখে মেয়েদের নিরাপত্তা – আত্মরক্ষায় সুরক্ষা
সেলফ ডিফেন্স বা আত্মরক্ষার জন্য কতগুলো মুভমেন্ট প্রত্যেকটা মেয়েরই জেনে রাখা ভালো যেন হঠাৎ আক্রমণে কাবু না হয়ে সাহসের সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে। আর ক্রাভ মাগা (Krav Maga)শিখে রাখাটাও প্রত্যেক মেয়ের জন্য জরুরী। ৫টি সহজ মুভ দেয়া হল নিচে, আশা করি কাজে আসবে।
১) যখনি কেউ এসে অ্যাটাক করবে, কোনভাবেই প্যানিকড না হয়ে জোরে চিৎকার করে দু’হাত শক্ত করে সর্বশক্তি দিয়ে সজোরে ধাক্কা মারুন অ্যাটাকার-এর বুক বরাবর। ২টা কাজ হয় এতে-
- আশপাশ থেকে মানুষ শুনে দৌড়ে আসবে এবং
- অ্যাটাকার বুঝবে যে আপনি সহজে কাবু হওয়ার পাত্র নন।
২) একটা নিরাপদ দূরত্বে থাকবেন অ্যাটাকার থেকে যেন তাকে হিট করতে পারেন কিন্তু সে আপনাকে অ্যাটাক করতে কিছুতা অসমর্থ হবে। তর্জনী (Index finger) ও মধ্যমা (Middle finger) ব্যবহার করে চোখে গুঁতো (Poke) মারতে পারেন। আবার অ্যাটাকার-এর ডান হাত আপনার বাম হাত দিয়ে আটকে আপনার বাম হাতের তালু দিয়ে অ্যাটাকার-এর থুঁতনিতে আটকে সব আঙুলগুলো দিয়ে তার চোখে গুঁতো দিতে পারেন। নিচের ছবিটি খেয়াল করুন।
৩) অ্যাটাকার-এর ঘাড়ে সাইড থেকে আপনার আঙুল সোজা রেখে হাত দিয়ে হিট করতে পারেন। ওখানে ক্যারোটিড ধমনী ও ঘাড়ের সংযোগ থাকায় সে অনেক ব্যথায় কাবু হবে। এই মুভ-টাকে সাইড নাইফ (Side knife) বলে।
৪) যেকোনো পায়ের গোড়ালি দিয়ে (এক সাইড হয়ে) অ্যাটাকার-এর হাটুতে অনেক বেশি জোরে একটা লাথি (Kick) করবেন। এতে আক্রমণকারী প্রচণ্ড একটা ব্যথা পেয়ে কাবু হবে অথচ আপনার কিছুই হবে না।
৫) কনুই, হাঁটু ও মাথা দিয়ে গালে ঘুষিও দিতে পারেন। তবে ট্রাই করবেন সঠিকভাবে এই হিট-টা করতে। নিচের মুভ-গুলো দেখুন। ইউটিউব থেকে সহজেই এই মুভ-গুলো শিখে নেয়া যায়।
আনিকা: কী বুঝলি?
সঞ্চা: উফফ! লিখতে গিয়েও যে কত কিছু জানলাম।
আনিকা: আসলেই রে। ভালো লাগছে না? নিজেও জানলি অন্যকেও জানালি!
সঞ্চা: হ্যাঁ আপু, নিজে জানার সাথে সাথে অন্যকে জানানোতে আলাদা একটা আনন্দ কাজ করে।
আনিকা: বৈশাখে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়েতো লেখা হলো, চল তবে এবার আমরা আমাদের বৈশাখের প্ল্যান করি।
সঞ্চা: আচ্ছা চলো তবে!
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ