গর্ভাবস্থায় শরীরে পানি আসার ব্যাপারটা স্বাভাবিক। সাধারণত ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারীর এই সমস্যা হয়ে থাকে। স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কারণেই এমনটা হয়। এ সময় অন্তঃসত্ত্বার শরীরে রক্ত এবং তরলের উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। রক্ত ও তরল পদার্থের এই অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণেই গর্ভাবস্থায় দেহের বিভিন্ন অংশ ফুলে ওঠে। গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে প্রায় ২৫ শতাংশ ওজন বাড়ে এই অতিরিক্ত তরলের কারণে। সেজন্যই হাত, মুখ, পা এবং গোড়ালি ফোলা ফোলা দেখায়। সাধারণত এটি হয়ে থাকে গর্ভাবস্থার শেষ কয়েক মাসে। অল্প পানি আসা স্বাভাবিক। কিন্তু এর সাথে হাতে মুখে পানি আসা, প্রেশার বেড়ে যাওয়া, ইউরিনে প্রোটিনের আধিক্য এই ধরনের সমস্যা থাকলে সেটা কিন্তু চিন্তার বিষয়, এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ! প্রেগনেন্সিতে বা গর্ভাবস্থায় পায়ে পানি আসা ও পা ফোলার কারণ এবং করণীয় সম্পর্কে জেনে নেই বিস্তারিতভাবে।
গর্ভাবস্থায় পায়ে পানি আসার কারণ
ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার বা প্রথম তিন মাসে প্রোজেস্ট্রেরন হরমোন লেভেল অতিরিক্ত বেড়ে যায়, সেই কারণে এ সময়ে পায়ে এবং শরীরে পানি আসতে পারে। পানি আসলে ঐ স্থান ফোলা দেখায়। গর্ভাবস্থায় শিশুর আকার আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রায় ৫০% বেশি রক্ত ও তরল উৎপাদিত হয়। চলুন জেনে নেই প্রেগনেন্সিতে পায়ে পানি আসা ও ফোলাভাবের কারণগুলো কী কী।
১) গর্ভাবস্থায় জরায়ুর আকার বাড়তে থাকা
সেকেন্ড ট্রাইমেস্টার বা চতুর্থ মাসের শুরু থেকে গর্ভাবস্থায় জরায়ুর আকার বাড়তে থাকে। গর্ভের শিশু যখন বড় হয়, তখন তার মাথার চাপে মায়ের নিম্নাঙ্গের যে শিরাগুলো দিয়ে রক্ত হার্টে প্রবাহিত হওয়ার কথা তাতে বিঘ্ন ঘটে। এর ফলে নিম্নাঙ্গ থেকে রক্ত প্রবাহ কমে যায়। ফলে শিরা থেকে তরল বের হয়ে শরীরের টিস্যুতে জমা হয়। যার ফলে পায়ে পানি আসে বা ফুলে যায়।
২) অন্যান্য কারণ
- গর্ভাবস্থার আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপ বা গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট বা কিডনিতে অসুখ থাকা ইত্যাদি থাকলেও পায়ে পানি আসতে পারে
- দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা বা একটানা অনেকক্ষণ কাজ করা
- কম পরিমাণে পটাশিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়া বা খাবারে পটাশিয়ামের পরিমাণ কম থাকা
- অতিরিক্ত ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় খাওয়া
- খাবার পাতে বাড়তি লবন খাওয়া
এই সময়ে পা ফুলে গেলে করণীয় কী?
- অনেকক্ষণ একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে বিরত থাকা
- দীর্ঘক্ষন পা ঝুলিয়ে না বসা, তবে বসার প্রয়োজন হলে পায়ের নিচে টুল ব্যবহার করা
- একইভাবে দীর্ঘ সময় ধরে শুয়ে না থাকা
- মাঝে মাঝে স্থান পরিবর্তন করা, আর পায়ের নিচে বালিশ রাখা
- সুষম খাদ্য গ্রহণ এবং নিয়মিত ক্যালসিয়াম ওষুধ সেবন করা (চিকিৎসকের পরামর্শে)
- পায়ে ম্যাসাজ করা ও গরম শেক দেয়া
- স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়া চালিয়ে যাওয়া
- পানি খাবেন পরিমিত পরিমাণে, শরীরে বেশি পানি জমা হচ্ছে ভেবে পানি কম খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই
- পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া
- প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন চিপস, চানাচুর, মিষ্টি, ক্যানড ফুড এগুলোতে লবন ও ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকে; এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে
- ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার, ফলমূল, ভেজিটেবল খেতে হবে
- যদি গর্ভাবস্থায় প্রেশার বেশি থাকে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রেশারের ওষুধ খেতে হবে এবং নিয়মিত চেকআপে থাকতে হবে
- হিল জুতো না পরে আরামদায়ক জুতো পরা
- যেসব কাপড় পা ও গোড়ালিতে চাপ সৃষ্টি করে এমন সব পোশাক এড়িয়ে চলা
- লবন খাওয়ার পরিমাণ কমানো
গর্ভাবস্থায় পায়ে পানি আসলে কখন সতর্ক হতে হবে?
১) হঠাত করে হাতে, মুখে পানি আসা, সাথে মাথা ব্যথা থাকা/না থাকা, দেখার সমস্যা মানে ঝাপসা দেখা।
২) বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অনেকদিন যাবত কাশি।
৩) এক পায়ে পানি আসা/ফুলে যাওয়া, সাথে ব্যথা।
৪) গর্ভের শিশুর নড়চড়া কমে যাওয়া (১২ ঘন্টায় অন্তত ১০-১২ বার নড়া স্বাভাবিক)।
৫) অতিরিক্ত বমি হয়ে শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়াও বিপদের লক্ষণ। এতে শরীর থেকে লবন ও পানি বের হয়ে যেয়ে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
কখন যাবেন চিকিৎসকের কাছে?
শরীরে খুব বেশি পানি এলে, পানি জমে জমে ত্বকে শক্তভাব চলে আসতে থাকলে, পানি জমার স্থানে ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কখনো কখনো এগুলো গর্ভকালীন জটিলতার লক্ষণও হতে পারে। তবে প্রস্রাবে সংক্রমণ কিংবা উচ্চ রক্তচাপ না হয়ে থাকলে পানি জমা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। তাই অস্বাভাবিক লক্ষণগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিন্ত হোন।
অতিরিক্ত পা ফোলা মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকির কারণ হতে পারে। যেকোনো জটিলতা ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শমতো নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন। এছাড়া গর্ভাবস্থায় নিয়ম অনুযায়ী শারীরিক পরীক্ষার জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, এতে এ ধরনের জটিলতার ভয় একেবারেই কেটে যাবে। গর্ভাবস্থায় পায়ে পানি আসা ও পা ফোলার কারণ এবং করণীয় সম্পর্কে জানা হয়ে গেল। আজ এই পর্যন্তই। মা ও অনাগত শিশুর জন্য শুভ কামনা। ভালো থাকবেন।
ছবি- আইস্টক, সাটারস্টক