ক’দিন ধরেই নাহিদের মা বলছে তার পায়ের ব্যথাটা বেড়েছে। নাহিদের মনে হচ্ছে আবহাওয়ার জন্যই এমনটা হচ্ছে। চারদিকে মহা আয়োজনে সবাই শীত উৎসব পালনের জন্য ব্যস্ত। চলছে পিঠার আয়োজন, বেড়াতে যাবার আয়োজন, নতুন কী পোশাকের ট্রেন্ড চলছে সেসব নিয়ে উত্তেজনা। ঘরে ঘরে চলছে লেপ, কম্বল গুছিয়ে রাখার প্রস্তুতি। এইসব প্রস্তুতির সাথে সাথে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিয়েও ভাবনা কম না। কারণ শীত তাদের জন্য আনন্দ বয়ে আনে না। সর্দি, ঠান্ডা, হাঁপানি, বাতের ব্যথাটা খুব বেড়ে যায়। শীতে প্রবীণদের স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কিছু কারণ জড়িত। পরিবারের একজন মানুষও শীতে কষ্ট পেলে সেটা পুরো পরিবারের মানসিক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নাহিদের মতো আমরা সবসময় পরিবারের প্রতিটি মানুষকে সুস্থ রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকি। প্রবীণদের ব্যাপারে একটু সচেতন হলে এই শীতের সময়টা তাদের জন্যেও আনন্দময় করে তুলতে পারি।
আজকের আলোচ্য বিষয় শীতে প্রবীণদের স্বাস্থ্য সমস্যা এবং প্রতিকারের উপায়। এই সময় তাদের প্রয়োজন শরীরের প্রতি বাড়তি যত্ন ও সচেতনতা। প্রত্যেকের বাসাতেই বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য আছেন। আমরা চাই পরিবারের সকলেই যেন হাসি আনন্দে মেতে থাকুক। চলুন কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচনা শুরু করি।
শীতে প্রবীণদের স্বাস্থ্য সমস্যা ও প্রতিকার
১) হালকা ব্যায়ামে পাবেন সুস্থ শরীর
প্রবীণ বয়সে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও কর্মক্ষমতা কমে যায়। তাই এ সময়টায় তাদের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তীব্র শীতে অ্যালার্জি, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিসের মতো রোগ হয়ে থাকে। যদি কারো রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিস এই ধরনের সমস্যা থাকে, তবে শীতে সেটি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব রোগ প্রতিকারে এ সময় হালকা ব্যায়াম করতে হবে। ঠান্ডার কারণে যদি বাইরে নাও বের হন, তবে ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি, হাত-পা নাড়াচাড়া করুন। এতে শরীরে তাপ উৎপন্ন হবে। ব্যায়াম করলে সর্দি-কাশি-জ্বর ইত্যাদি রোগ কম হয়।
২) শীতে প্রবীণদের স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিকারে গরম কাপড়
শীতে প্রবীণদের শরীরের তাপমাত্রা কমে হাইপোথারমিয়া হতে পারে, যার ফলে অজ্ঞান হওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হয়। তাই শীতপোশাক পরার ক্ষেত্রেও সচেতন হওয়া দরকার। একটি মোটা কাপড় পরার চেয়ে কয়েকটি পাতলা কাপড় পরলে শীত কম লাগবে। রাতে গলা ও কানে পাতলা কাপড় জড়িয়ে ঘুমান, এতে ঠান্ডা লাগবে না।
৩) ফল, ফলের রস ও শাকসবজি খেতে ভুলবেন না
শীতে খাওয়া-দাওয়ায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ঠান্ডা খাবার অবশ্যই বাদ দিতে হবে। এ সময় শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তাই শীতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। এক্ষেত্রে গরম দুধ, ফলের রস, বিভিন্ন ধরনের স্যুপ খাওয়া যেতে পারে। নিয়মিত লেবু দিয়ে চা খাওয়া যেতে পারে। এটি শরীরে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের কাজ করবে। এ ছাড়া ফল ও ফলের রস খেতে হবে। এটি শরীরের নিস্তেজভাব দূর করবে। ফলে প্রচুর ভিটামিন-সি থাকে, যা শরীরে শক্তি যোগাতে সাহায্য করবে। এ সময় বাজারে প্রচুর শাকসবজি ওঠে, এগুলোও ডায়েট চার্টে রাখুন।
৪) শীতে ত্বকের যত্ন নিন
শীতে শরীরের অয়েল গ্ল্যান্ড থেকে তেল কম নিঃসৃত হয় বলে ত্বক খসখসে ও শুষ্ক হয়ে পড়ে। ত্বকের সুরক্ষায় ময়েশ্চারাইজার লোশন, ভ্যাসলিন, গ্লিসারিন, অলিভ অয়েল এগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। যখনই মুখ পানি দিয়ে পরিষ্কার করবেন, তখনই কোনো ক্রিম বা ময়েশ্চারাইজার মুখে ব্যবহার করুন।
৫) ভিটামিন ডি পেতে রোদে থাকুন কিছুক্ষণ
সূর্যের আলো ভিটামিন ডি-এর প্রধান উৎস। ভিটামিন ডি-এর অভাবে শ্বাসতন্ত্রে ঘন ঘন সংক্রমণ হতে পারে। হাড়ের গিঁটে গিঁটে ব্যথা ও আড়ষ্টতা অনুভব হতে পারে। এছাড়াও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এতে করে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ হওয়া বেড়ে যায়। তাই ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণের জন্য সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত ১০-২০ মিনিট রোদ গায়ে লাগাতে হবে। প্রবীণদের হালকা রোদে সামান্য ব্যায়ামও করতে উৎসাহ দিতে হবে।
৬) খেয়াল রাখুন মানসিক সুস্থতার দিকেও
প্রবীণদের মাঝে শতকরা আশি ভাগ ব্যক্তি বিষণ্নতা রোগে ভোগে। এই সময়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা বেড়ে যায়। শারীরিক কষ্টের সাথে সাথে তারা মনের দিক থেকেও সব কিছুর কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। এ সময় পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের মন ভালো রাখতে এক সাথে টিভি দেখতে পারে, গল্প করতে পারে। ঘরের ভেতর শীতের পিঠার আয়োজন করে আত্মীয়দের সাথে আড্ডার আয়োজন করতে পারে। লক্ষ্য রাখতে হবে প্রবীণেরা যেন একাকীত্বে না ভোগে। তাহলেই এই শীত তাদের জন্য হয়ে উঠবে আনন্দের, উৎসবের।
বয়স বেড়ে গেলে এমনিতেই জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হয়। পরিবারের অন্য সদস্যরা যদি একটু দায়িত্ব নিয়ে প্রবীণদের দেখাশোনা করেন, তাহলে পরিবারের এই প্রবীণ সদস্য জীবন-সায়াহ্নের দিনগুলো সুখেই কাটাবেন। শীতে প্রবীণদের স্বাস্থ্য সমস্যা ও প্রতিকার নিয়ে আমরা জেনে নিলাম। আসুন এবারের শীত উৎসব পালন করি পরিবারের সবাইকে নিয়ে।
লিখেছেন- মাহমুদা আক্তার রোজী, ফিজিওথেরাপি কনসালট্যান্ট এন্ড জেরোন্টলজিস্ট
ছবি- সাটারস্টক