ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র খুবই পরিচিত একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। বর্তমানে এটি সব থেকে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া একটি ক্রনিক ডিজিজ। সারাবিশ্বে কয়েক মিলিয়ন মানুষ এটিতে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে চর্মরোগ বা ত্বকজনিত সমস্যা বেশ প্রকট। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রোগী বিভিন্ন চর্মরোগ বা ত্বকের সমস্যায় ভুগে থাকেন। এ সমস্যাগুলো সম্পর্কে না জানলে পরবর্তীতে আরো বড় আকার ধারণ করতে পারে। ডায়াবেটিসে ত্বকের সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত থাকছে আজকের ফিচারে।
ডায়াবেটিস সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র এমন একধরনের রোগ যে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তে গ্লুকোজ লেভেল স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি থাকে। এ রোগ হলে রোগীর শরীর নিজে থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা তৈরি হওয়া ইনসুলিন কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলেই মূলত রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়।
ইনসুলিন হলো মানব শরীরের অগ্ন্যাশয় থেকে উৎপন্ন প্রধান হরমোন। এটি অগ্ন্যাশয়ের নিঃসরণকারী কোষগুলো (আইল্যেটস অব ল্যাঙ্গারহেন্স-এর বিটা কোষ) থেকে নিঃসৃত হয়। এটি শরীরের কোষে শর্করার প্রবেশ ও মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ডায়াবেটিস রোগে শরীরে ইনসুলিনের তারতম্যের জন্য রক্তে শর্করার মাত্রার তারতম্য ঘটে। ফলে শরীরে বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।
ডায়াবেটিসে ত্বকের সমস্যা কোনগুলো?
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় ডায়াবেটিসে ত্বকের সমস্যা বেশি দেখা যায়৷ তাদের শরীরে ব্লাড ফ্লো বেশ কমে যাওয়ায় কোলাজেন প্রোডাকশন বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ আরো নানা ধরনের ত্বকের সমস্যা দৃশ্যমান হয়। ত্বকের যে উপসর্গগুলো ডায়াবেটিস রোগকে নির্দেশ করে সেগুলো হলো-
১. ত্বকের শুষ্কতা, র্যাশ ও চুলকানি
ডায়াবেটিস হলে ত্বক অনেক ড্রাই হয়ে থাকে,যার ফলে তাদের ত্বকে লালচে র্যাশ ও চুলকানি দেখা দেয়। ধারণা করা হয়, ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত রোগীদের ত্বকে আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায় বলেই এমন হয়।
২. ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশন
ত্বকে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দেখা দেয়। খুব সহজেই এ ধরনের ত্বকে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন ঘটে, যেমন: ত্বক লালচে হয়ে যাওয়া, ত্বকে ফোঁড়া, নখের ইনফেকশন, দেহের যেকোনো অংশে ইনফেকশন, সেলুলাইটিস, ত্বকে প্রদাহ, ব্যাথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।
৩. ডায়াবেটিক ডার্মোপ্যাথি
রোগীদের পায়ে হুট করেই দাগ পড়তে দেখা যায়। এ দাগগুলো কালো বা হালকা বাদামী রঙের গোলাকার অথবা ওভাল আকৃতির হয়ে থাকে। এই দাগগুলো হয় তাদের পায়ের ছোট ছোট রক্তনালিতে রক্ত প্রবাহে বিঘ্নতার ফলে। রক্তের জলীয় অংশ রক্তনালি থেকে বের হয়ে ঠিক ত্বকের নিচে জমা হয় এবং এর ফলেই ত্বকে কালচে ও বাদামী বিভিন্ন দাগ দেখা যায়। একেই বলা হয় ডায়াবেটিক ডার্মোপ্যাথি।
৪.ছত্রাক বা ফাংগাল ইনফেকশন
আক্রান্ত রোগীরা ছত্রাক বা ফাংগাসের আক্রমণে ভুগে থাকেন। তাদের ত্বকে ছত্রাক বা দাদের আক্রমণ হতে পারে। তারা বিভিন্ন ধরনের ফাংগাল ইনফেকশন,যেমন: রিং ওয়ার্ম বা ইস্ট,ক্যান্ডিডা নামক ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
৫.ডায়াবেটিক ব্লিস্টার
গ্রীষ্মের সময় ডায়াবেটিস রোগীদের ত্বকের সমস্যা হলো বিভিন্ন ধরনের পানিসহ ফুসকুড়ি বা ব্লিস্টার দেখা যাওয়া। এগুলো চুলকায় এবং পুঁজ ভর্তি হতে পারে। এগুলো থেকে ক্ষতেরও সৃষ্টি হয়।
৬. নেক্রোবায়োসিস লিপোইডিকা ডায়াবেটিকোরাম
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের একটি বিশেষ ধরণের ক্ষত যা পায়ে বেশি হতে দেখা যায়। এগুলো সাধারণত লালচে বাদামি রঙের হয় এবং ছোট ছোট গুটি আকারের হয়ে থাকে। এই গুটিগুলো খুব চুলকায় এবং ব্যথাযুক্ত হয়, যার ফলে ত্বকে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে সাধারণত এ সমস্যাটি বেশি দেখা যায়।
৭. ত্বকের চুলকানি
ধারণা করা হয় যেহেতু ত্বকে রক্ত সঞ্চালন খুব ধীর গতিতে হয় তাই ত্বকের শুষ্কতা বাড়তে থাকে। এই শুষ্কতা থেকে ত্বকে চুলকানি দেখা দেয়।
৮. ইরাপ্টিভ জ্যান্থোম্যাটসিস
এটি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে আরেকটি ত্বকের সমস্যা, যা সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হয়ে থাকে। এটি মূলত একধরনের শক্ত হলুদাভ বর্ণের গোটা যা হাত,পা,পিঠের ত্বকে দেখা দিতে পারে।
৯.ত্বকের রঙ পরিবর্তন
ডায়াবেটিক রোগীদের ত্বকের রঙ পরিবর্তন বা শরীরের বিভিন্ন অংশে কালো বা বাদামী দাগ ছোপ দেখা দিতে পারে। সাধারণত গলায়,হাতে-পায়ে,পিঠে এ ধরনের দাগ ছোপ হতে পারে।
১০. ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি
অনেক সময় ডায়াবেটিস রোগীর স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষমতা হ্রাস পায়। যার ফলে রোগীর ব্যথার বা ত্বক সমস্যার অনুভূতি হ্রাস পায়। তাই রোগী ব্যথা বা আঘাতের কথা সঠিকভাবে বলতেও পারেনা।
ত্বকের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে করনীয়
ডায়াবেটিসের কারণে ত্বকের সাধারণ সমস্যাও বেশ জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাই সঠিকভাবে ত্বকের যত্ন নেওয়া খুবই জরুরি। সাধারণত আক্রান্ত রোগীর ত্বক খুবই শুষ্ক হয়ে যায় এবং শুষ্কতা থেকেই বেশিরভাগ সমস্যার সৃষ্টি হয়, তাই ত্বক খুব ভালোভাবে ময়েশ্চারাইজড রাখতে হবে। অবশ্যই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে ত্বকের ধরন অনুযায়ী। এর পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, যাতে করে ত্বকে কোনো জীবাণুর আক্রমণ না ঘটে। যাদের ইনসুলিন নিতে হয়, তারা সতর্কতার সাথে নিবেন, যাতে করে নিডল থেকে ত্বকে কোনো আঘাত না লাগে।
আশা করি ডায়াবেটিসে ত্বকের সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। পরিশেষে বলবো, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে ত্বক সমস্যা অনেকখানিই কমে আসবে। তাই নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করুন৷ দেখবেন সুস্থ থাকতে পারবেন।
ছবিঃ সাটারস্টক