সম্প্রতি আবিষ্কৃত নভেল কভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা পৃথিবী তোলপাড়। এর আগে একই রকমের সার্স, মার্স রোগ দেখা দিলেও তা করোনার মতো এত ব্যাপ্তি পায় নি। এবারের ভীতির কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো, এই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে সংস্পর্শে আসা মানুষের শরীরে খুব দ্রুত ছড়ায়। দ্বিতীয়ত, কারো শরীরে এই ভাইরাস প্রবেশের পর ঐ ব্যক্তি কতটা আক্রান্ত হবেন তা প্রধানত নির্ভর করে তার দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর। একজন সুস্থ সবল রোগীর দেহে এই ভাইরাস প্রবেশ করলে দেখা যায় তার শরীরে সামান্য জ্বর বা কাশি হতে পারে, যা অনেকটা ঠাণ্ডা জ্বরের মতো। সমস্যা প্রকট হয় যখন আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রকট হয়। তাই আক্রান্ত রোগীর পাশাপাশি করোনা রোগীর সেবা করায় যারা থাকবেন তাদের সাবধানতার কথা চিন্তা করেই আজকের এই লেখা।
করোনা রোগীর সেবা নিয়ে যত কথা
করোনা রোগের লক্ষণসমূহ
এই রোগের সাধারণ লক্ষনসমূহ হলো জ্বর, ক্লান্তি এবং শুকনো কাশি। এছাড়াও কিছু রোগীর ক্ষেত্রে
গায়ে ব্যথা, সর্দি, নাক বন্ধ থাকা, গলা ব্যথা বা পাতলা পায়খানা থাকতে পারে। লক্ষণসমূহ সাধারণত মৃদু আকারে শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। আক্রান্ত রোগীদের শতকরা আশি ভাগই তেমন কোন চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তারা লক্ষণভিত্তিক ওষুধ যেমন- জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, সর্দি কাশির জন্য অ্যান্টি-হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ খেতে পারেন। আক্রান্ত প্রতি ছয় জনের মধ্যে একজনের অবস্থা জটিল হতে পারে এবং দেহে শ্বাসজনিত জটিলতা হতে পারে। বয়স্ক মানুষ কিংবা যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার জাতীয় অসুখ আছে তাদের ক্ষেত্রে এই রোগ জটিল হতে পারে।
করোনা ভাইরাস যেভাবে ছড়ায়
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে এলে, ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের হাঁচি-কাশিতে ছড়ানো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দানার সংস্পর্শে এলে, ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশি নিঃসৃত ড্রপলেট (Droplet) বা ক্ষুদ্র কণা কোন বস্তু বা পৃষ্ঠতলে লেগে থাকলে অন্য কোন ব্যক্তি যদি তা স্পর্শ করেন এবং পরবর্তিতে ভাইরাসযুক্ত সেই হাত দিয়ে যদি নিজের নাক, চোখ, মুখ স্পর্শ করেন তবে সে ক্ষেত্রে ভাইরাসটি ঐ ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
করোনা ভাইরাস রোগীর সেবা দেয়ার নির্দেশাবলী
১) বর্তমানে সুস্থ আছেন এবং যার জ্বর, কাশি, গায়ে ব্যথা, সর্দি, গলা ব্যথা ইত্যাদি রোগসমূহ নেই, এমন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে পরিচর্যাকারী হিসেবে নিয়োজিত হওয়া উচিত।
২) সন্দেহজনক রোগীর সাথে কোন অতিথিকে দেখা করতে দিবেন না।
৩) পরিচর্যাকারী নিম্নলিখিত যে কোন কাজ করার পর প্রতিবার নিয়মমতো দুই হাত পরিষ্কার করবেন-
-রোগীর সংস্পর্শে এলে বা তার ঘরে ঢুকলে
-খাবার তৈরির আগে ও পরে
–খাবার আগে
-টয়লেট ব্যবহারের পরে
-গ্লভস পড়ার আগে ও খোলার পরে
– যখনই হাত দেখে নোংরা মনে হয়
৪) রোগী পরিচর্যার সময় এবং রোগীর মল-মূত্র বা অন্য আবর্জনা পরিষ্কারের সময় একবার ব্যবহারযোগ্য (ডিসপোজেবল) মেডিক্যাল মাস্ক ও গ্লভস ব্যবহার করুন। খালি হাতে রোগী বা ঐ ঘরের কোন কিছু স্পর্শ করবেন না।
৫) রোগীর ব্যবহৃত বা রোগীর পরিচর্যায় ব্যবহৃত মাস্ক, গ্লভস, টিস্যু ইত্যাদি অথবা অন্য আবর্জনা রোগীর রুমে রাখা ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে রাখুন। আবর্জনা উন্মুক্ত স্থানে না ফেলে পুড়িয়ে ফেলুন।
৬) ঘরের মেঝে, আসবাবপত্রের সকল পৃষ্ঠতল, টয়লেট ও বাথরুম প্রতিদিন অন্তত একবার পরিষ্কার করুন। পরিষ্কারের জন্য ১ লিটার পানির মধ্যে ২০ গ্রাম (২ টেবিল চামচ পরিমাণ) ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করুন ও ঐ দ্রবণ দিয়ে উক্ত সকল স্থান ভালোভাবে মুছে ফেলুন। তৈরিকৃত দ্রবণ সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে।
৭) রোগীর কাপড়, বিছানার চাদর, তোয়ালে ইত্যাদি ব্যবহৃত কাপড় গুড়া সাবান/ কাপড় কাচা সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফেলুন এবং পরে ভালোভাবে শুকিয়ে ফেলুন।
৮) নোংরা কাপড় একটি লন্ড্রি ব্যাগে আলাদা রাখুন। মল-মূত্র বা নোংরা লাগা কাপড় ঝাঁকাবেন না এবং নিজের শরীর বা কাপড়ে যেন না লাগে তা খেয়াল করুন।
৯) রোগীর ঘর/টয়লেট/বাথরুম/কাপড় ইত্যাদি পরিষ্কারের পূর্বে একবার ব্যবহারযোগ্য (ডিসপোজেবল) গ্লভস ও প্লাস্টিক এপ্রোন পরে নিন এবং এ সকল কাজ শেষে নিয়ম মতো দুই হাত পরিষ্কার করুন।
করোনা রোগীর সেবা করে হ্যান্ড ওয়াশ নাকি হ্যান্ড স্যানিটাইজার?
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে হাত পরিষ্কার রাখাটা জরুরি। এই ভাইরাস প্রতিরোধে যে কোন সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করলেই চলে। এমনকি ক্ষারযুক্ত কাপড় কাঁচার যে সাবান, সেই সাবানও এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর। যে কোন সাবান দিয়েই নিয়ম অনুযায়ী ধুয়ে ফেললেই হবে। পরিষ্কার রানিং ওয়াটারে হাতটা প্রথমে ধুয়ে নিন। যে কোন সাধারণ সাবানের সাহায্যে হাতে আঙ্গুলে ফেনা তৈরি করুন। অন্তত ২০ সেকেন্ড দুটো হাত ঘষাটা জরুরি। হাত ঘষে ধোয়া শেষ হলে ফের পরিষ্কার রানিং ওয়াটারে হাত ধুয়ে ফেলুন। পরিষ্কার টাওয়ালে হাতটা মুছে নিন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)- এর তথ্য মতে আমাদের শরীর নিজেই নিজস্ব প্রতিষেধক বানিয়ে নেয়। কিন্তু প্রাম্ভিক আক্রমণ সামাল দিতে পারে না বলেই এই আক্রমণ মহামারী রূপ নেয়। তাই আতংকিত নয়, সচেতন হোন। আপাতত মানুষের ভীড় এড়িয়ে চলুন। বেশি বেশি করে সাবান পানি দিয়ে ঠিকমতো হাত ধোন,আক্রান্ত ব্যক্তি এবং এলাকা এড়িয়ে চলুন। যতটা সম্ভব নিজের ঘরে থাকুন। যদি জ্বরের সাথে শুকনো কাশি এবং শ্বাসকষ্ট থাকে তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
ছবি সংগৃহীতঃ cloudfront.net