বর্তমানে সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেক বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুহারের কারণে এটি বাংলাদেশে একটি উল্লেখযোগ্য জনস্বাস্থ্য বিষয়ক উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর বর্ষায় ডেঙ্গু প্রকট আকার ধারণ করে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা কোন লক্ষণ দেখে বুঝবেন, এর চিকিৎসা কী এবং কী কী সাবধানতা মেনে চলতে হবে এসব নিয়েই বিস্তারিত জানাবো আজকের আর্টিকেলে।
ডেঙ্গু কী?
ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে। এই ভাইরাসবাহিত এডিস ইজিপ্টাই নামক স্ত্রী মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়ে থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয়দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা কীভাবে বুঝবেন?
ডেঙ্গুর সাধারণত তেমন আলাদা কোনো লক্ষণ থাকে না। তাই অনেকেই ভাইরাল জ্বর বলে এটি অবহেলা করেন। তবে কিছু লক্ষণ দেখে ভাইরাল জ্বর থেকে একে আলাদা করা যায়। যেমন-
- ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়
- জ্বর ১০২-১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে
- মাথা ও চোখের পিছনে ব্যথা হয়
- শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়
- জ্বর হওয়ার চার বা পাঁচদিনের সময় সারা শরীর জুড়ে লালচে র্যাশ দেখা যায়
- পাতলা পায়খানা, বমি বমি ভাব এমনকি বমি হতে পারে
- অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ হয় এবং রুচি কমে যায়
- অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় হাড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’ বা হাড়ভাঙা জ্বর।
জ্বরের পর্যায়
ডেঙ্গুর সাধারণত দুটি পর্যায় থাকে। সেগুলো হচ্ছে-
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার – এই জ্বরের সবথেকে জটিল অবস্থা হলো হেমোরেজিক পর্যায়। এ সময় ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণের পাশাপাশি আরো কিছু সমস্যা দেখা দেয়। শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে যেমন- দাঁতের গোড়া, নাক, মুখ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। অনেক সময় বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম – এই জ্বরের ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে এই সিনড্রোম হয়। এর ফলে হঠাৎ প্রেশার কমে যেতে পারে, পালস অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়ে যায়। শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। কিডনি ফাংশন ব্যাহত হয় এবং রোগীর প্রস্রাবের মাত্রা কমে যায়। অনেক সময় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
চিকিৎসা ও সাবধানতা
ডেঙ্গু জ্বরের কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই। ডেঙ্গু হলেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না। প্রাইমারি কেয়ার সেন্টার বা আপনার নিয়মিত চিকিৎসকের চেম্বারে গেলেই চলবে এবং লক্ষণ বা উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা চালাতে হবে। সেই সাথে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন-
- আক্রান্ত রোগীকে সবসময় মশারির ভেতরে বিশ্রামে রাখতে হবে
- স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি এবং তরল খাবার খেতে হবে
- জ্বর কমানোর জন্য পানি দিয়ে শরীর মুছিয়ে দেয়া যেতে পারে
- জ্বর বেশি হলে শুধুমাত্র প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে
- অ্যাসপিরিন বা কোনো প্রকার ব্যথানাশক ওষুধ দেয়া যাবে না
- রোগী যে পরিমাণ তরল খাবে সেই পরিমাণ প্রস্রাব করছে কি না খেয়াল রাখতে হবে
- জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুদিন শরীর অত্যন্ত দুর্বল থাকে। এই সময় প্রচুর তরল খাবার, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার, দুধ, ডিম, মাছ ও ফলমূল বেশি করে খাওয়া দরকার।
প্লাটিলেট কমে গেলে কি ভয়ের কিছু আছে?
ডেঙ্গু জ্বরে অনেক সময় প্লাটিলেট কাউন্ট কম থাকে। এতে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে যান। প্লাটিলেট কাউন্ট কম দেখে ব্লাড ট্রান্সফিউশন করা এতটা গুরুত্ব বহন করে না। কারণ প্লাটিলেট কাউন্ট কম থাকার পরও যদি ভাইটাল সাইন বা ব্লাড প্রেশার, পালস ইত্যাদি স্বাভাবিক থাকে, তাহলে শুধু শুধু ব্লাড ট্রান্সফিউশনের জন্য দৌড়াদৌড়ি করার কোনো দরকার নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্লিডিং না হয়, ততক্ষণ ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কাউন্ট এর পরিমাণের উপর ভিত্তি করে প্রতিদিন প্লাটিলেট কাউন্ট মনিটর করতে হবে। তবে প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারে নেমে আসলে ঝুঁকি এড়াতে প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন অথবা ব্লাড ট্রান্সফিউশন করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের নিবিড় মনিটরিং এ থাকতে হবে এবং পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
ডেঙ্গু হলেই আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকা উচিত। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগী সাধারণত ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু জ্বর কমে যাওয়ার পরই মূলত ক্রিটিক্যাল ফেইজ শুরু হয়। তাই জ্বর কমলেই সবকিছু ভালো হয়ে গেলো এটা মনে করবেন না। গুরুতর কোনো লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। নিজে থেকে ওষুধ খাওয়া যাবে না। কারণ ভুল ওষুধ স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তাই এই সময়ে জ্বর হলে টেস্ট করে নিশ্চিত হোন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা। যদি ডেঙ্গু হয় তাহলে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করুন। সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক