ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্ন কীভাবে নেওয়া উচিত?

ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্ন কীভাবে নেওয়া উচিত?

Untitled design (45)

আনিস আহমেদ নতুন এক জোড়া জুতা কিনেছেন। প্রথম দিন জুতা পায়ে অফিস করার পর থেকেই পায়ে ফোস্কা পড়েছে। তিনি ভাবলেন দিন কয়েকের মধ্যে সেরে যাবে। কিন্তু কয়েকদিন গেলেও ফোস্কা শুকাচ্ছে না, বরং ঘা বড় হয়েছে। ভাবনায় পরে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন তার এই সমস্যা ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা। ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্ন নিয়ে বিশেষভাবে সচেতন হতে হয়। অন্যথায় সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে।

ডায়াবেটিস এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত রাখে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এর প্রভাব ফেলে। ডায়াবেটিসের ক্ষতিকর প্রভাব পায়ের ওপরে বিশেষভাবে দেখা যায়। দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিসের কারণে পায়ের স্নায়ু ও রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে পায়ে সংবেদনশীলতার অভাব, রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা এবং সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। তাই ডায়াবেটিক রোগীদের পায়ের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্ন নেওয়া জরুরি কেন?

ডায়াবেটিসের কারণে পায়ের স্নায়ু ও রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এতে পায়ের স্নায়ুগুলো সংবেদনশীলতা হারাতে শুরু করে। এই অবস্থাটি নিউরোপ্যাথি নামে পরিচিত। নিউরোপ্যাথির কারণে রোগী অনেকসময় পায়ে আঘাত পেলে বা ক্ষত সৃষ্টি হলে অনুভব করতে পারে না। এ কারণে ছোটখাটো আঘাতও গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। তাছাড়া ডায়াবেটিসের কারণে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হলে পায়ের ক্ষত সহজে শুকায় না, এতে সংক্রমণ বা আলসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সময়মতো যত্ন না নিলে সংক্রমণ থেকে গ্যাংগ্রিনে রূপ নিতে পারে এবং সার্জারির মাধ্যমে পা কেটে বাদ দিতে হতে পারে। তাই এই ধরনের জটিলতা এড়াতে আলাদাভাবে ডায়াবেটিস রোগীর পায়ের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অবহেলার ঝুঁকি

ডায়াবেটিস রোগীরা পায়ের সঠিক যত্ন না নিলে বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতে পারেন। এই জটিলতাগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো:

১। নিউরোপ্যাথি: দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস পায়ের স্নায়ুগুলোর ক্ষতি করে পায়ের সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়। ফলে অনেক সময় আঘাত লাগলেও তা বোঝা যায় না। এই অবহেলার ফলে ক্ষত দ্রুত সংক্রমিত হয়ে গুরুতর রূপ নিতে পারে।

২। রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা: ডায়াবেটিস পায়ের রক্তনালীগুলোর উপর প্রভাব ফেলে, যা রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত করে। এ কারণে পায়ের ক্ষত শুকাতে দেরি হয় এবং সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

৩। সংক্রমণ ও আলসার: সামান্য ফোস্কা বা ক্ষতও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। পায়ের ক্ষত বা ফোস্কা যদি অবহেলা করা হয় তবে তা দ্রুত সংক্রমিত হয়ে আলসারে পরিণত হতে পারে এবং পরবর্তীতে এই সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে।

৪। গ্যাংগ্রিনঃ অবহেলার কারণে পায়ের ক্ষত বা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এলে তা গ্যাংগ্রিনে পরিণত হতে পারে। গ্যাংগ্রিন একটি মারাত্মক অবস্থা, যা পায়ের রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে দেয় এবং পায়ের টিস্যুগুলো মরে যেতে থাকে। এক্ষেত্রে কখনো কখনো পা কেটে বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

যেভাবে পায়ের যত্ন নিতে হবে

পায়ের যত্ন নেওয়ার জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত। উল্লেখযোগ্য কিছু নিয়ম হলোঃ

১। নিয়মিত পা পরীক্ষা করা: প্রতিদিন পায়ের তলা, আঙুল এবং পায়ের অন্যান্য অংশ ভালোভাবে পরীক্ষা করা উচিত। ক্ষত, ফোস্কা, ফাটা বা লালচেভাব দেখলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

২। পরিষ্কার রাখা: প্রতিদিন কুসুম গরম পানিতে সাবান দিয়ে পা ধুয়ে নিন। পা ভালোভাবে শুকিয়ে নিয়ে পায়ে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন। তবে আঙুলের ফাঁকে যেন লোশন বা ক্রিম লেগে না থাকে সেদিকে খেয়াল করুন।

৩। সঠিক জুতা ব্যবহার: আরামদায়ক, সঠিক মাপের এবং হিলবিহীন জুতা পরা উচিত। জুতা বেশি ঢিলেঢালা বা বেশি টাইট হলে পায়ে আঘাতের সম্ভাবনা বাড়ে। হিলযুক্ত বা খোলা জুতা এড়িয়ে চলা ভালো।

৪। পায়ের নখের যত্ন: পায়ের নখ কাটা ও পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি। নখ কাটার সময় খুব সাবধানে কাটতে হবে যাতে আঘাত না লাগে। সাধারণত নখ ইউ (U) আকৃতিতে না কেটে স্কয়ার (Square) আকৃতিতে কাটা উচিত। এতে নখের কোণার সাথে লেগে থাকা মাংসপেশি কেটে যাওয়ার ঝুঁকি এড়ানো যায়।

৫। রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি: পায়ের রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখার জন্য হালকা ব্যায়াম ও পায়ের আঙ্গুল নাড়ানোর অভ্যাস করুন। প্রয়োজনে একজন ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী কী ধরনের ব্যায়াম করতে হবে, সেটা জেনে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে রোগী যেন পা ক্রস করে না বসেন। এতে রক্ত সঞ্চলন বাধাগ্রস্থ হয়।

৬। ধূমপান পরিহার করা: ধূমপান রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত করে এবং ডায়াবেটিক রোগীদের পায়ের জটিলতা বাড়ায়। তাই ধূমপান পরিহার করুন।

সতর্কতা

১। পায়ের ক্ষত বা আঘাতকে কখনোই অবহেলা করবেন না।

২। গরম পানি বা বৈদ্যুতিক হিটিং প্যাড দিয়ে পা গরম করবেন না। যেহেতু ডায়াবেটিসের কারণে পায়ে সংবেদনশীলতা কম থাকে তাই অনেক সময় তাপের তারতম্য বোঝা যায় না। এতে পা পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

৩। জুতা বা মোজা পরার আগে ভালোভাবে দেখে নিন যেন কোনো কিছু দিয়ে পায়ে খোঁচা না লাগে।

৪। পায়ের কোনো সমস্যা হলে নিজে নিজে ওষুধ গ্রহণ না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

ডায়াবেটিক রোগীদের পায়ের সঠিক যত্ন নেওয়া তাদের স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সঠিকভাবে পায়ের যত্ন ও সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে ডায়াবেটিক রোগীরা অনেক গুরুতর জটিলতা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেন এবং দীর্ঘমেয়াদে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে পারেন। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের সঠিক যত্নের ব্যাপারে আরও সচেতন হওয়া।

লিখেছেন- মাহমুদা আক্তার রোজী
ফিজিওথেরাপি কনসালটেন্ট এন্ড জেরোন্টোলজিস্ট

ছবি- সাটারস্টক

0 I like it
0 I don't like it
পরবর্তী পোস্ট লোড করা হচ্ছে...

escort bayan adapazarı Eskişehir bayan escort