এক কালে সকালে আমার ঘুম ভাঙতো মোরগের কুককুরুকু শব্দে, এখন ডিজিটাল এলার্মে সকালের ঘুম ভাঙ্গে; শেষ কবে কাকের ডাক শুনেছি মনে করতে পারছি না। ছেলেবেলায় মা-কে দেখতাম, বাবাকে বাজারের ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিতো, এখন বউয়ের কাছ থেকে ফরমায়েশ পাই কখনও ই-মেইলে কখনও টেক্সট মেসেজে। শৈশবে বাবা-মায়ের কাছে আমাদের বায়নাগুলি ছিল গ্যাস বেলুন, পুতুল, বা খেলনা গাড়ি (রিমোট দিয়ে চালানো গাড়ি আমার শৈশবে আমি চোখেও দেখিনি); এখনকার শিশুরা রিমোটচালিত হেলিকপ্টার চায়, প্লে-স্টেশন চায়, আইপ্যাডে তারা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলে।
তবে আমরাই হলাম প্রথম ডিজিটাল প্রজন্ম। আবার আমরাই সেই শেষ প্রজন্ম যাদের শৈশবের ছবি তুলতে ফিল্ম লাগতো, তারপর নেগেটিভ নামের এক কিম্ভূত বস্তু উৎপন্ন হতো, সেটাকে অন্ধকার ঘরে নিয়ে কী কী সব করার পর পানিতে ভেজানো কাগজে ছবি ফুটে উঠতো…। এখনকার মতো কথায় কথায় খসাৎ খসাৎ সেলফি তোলার কথা তখন কেউ কল্পনা করতে পারতো?
আমার ছোটবেলায় মা জোর করে দুপুরে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করতো, আমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে মা নিজেই যখন ঘুমিয়ে পড়তো, আমি চুপি চুপি উঠে এক দৌড়ে মাঠে! একটা বল নিয়ে বাড়ী থেকে বের হলে খেলার সঙ্গী জুটতে সময় লাগতো না। আর এখন ছুটির দুপুরে আমার ছেলেকে তার ঘরে ঘুমুতে আদেশ করে আমরা যখন নিজেদের ঘরে দিবানিদ্রায় মগ্ন, ছেলে তখন চুপি চুপি তার PSP-তে FIFA বা NFS নিয়ে মেতে ওঠে। আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখতো ‘ঠাকুমার ঝুলি’ আর ‘আরব্য রজনীর গল্প’; ওর কাছে ওসবের কোন মূ্ল্য নেই, ওর কাছে Doraemon অনেক বেশি মজার, Ben10 অনেক থ্রিলিং, Tom & Jerry অনেক বেশি আকর্ষণীয়। সেদিন তো মুখের ওপর বলেই বসলো, বাবা-মায়ের চেয়ে কার্টুন বেশি প্রিয় ওর কাছে!
এটা কি ওর দোষ? ওকে কে শিখিয়েছে টিভি দেখা? আমরা। ওর হাতে কে তুলে দিয়েছে গেমস আর গ্যাজেট? আমরা। কে ওকে ছেলেধরার ভয়ে বাড়ী থেকে বেরুতে নিষেধ করেছে? আমরা। আমরাই ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি খেলার মাঠ, আমরাই ওর মেধায়-মননে যান্ত্রিকতার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছি, আমরাই শিখিয়েছি বই পড়ার চেয়ে টিভি দেখায় অনেক বেশি বিনোদন। এই অনুধাবন আমার আজ নতুন নয়, ছেলে যখন ৪ বছর বয়স পেরিয়ে মাত্র দুয়েকটা শব্দ বলতে শিখেছে, তখনই বুঝেছি কী বিষবৃক্ষ রোপন করেছি নিজ হাতে। ওর বয়স এখন সাড়ে সাত। এখনও স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না, he is slightly Autistic। ডাক্তার বলেছেন, এর জন্য দায়ী আমরা, যারা ওকে টিভি-র প্রতি আসক্ত করে তুলেছিলাম ১ বছর বয়স থেকে। ফলে কথা বলার চেয়ে টিভির (কার্টুনের) প্রতি ওর আগ্রহ বেশি, আশেপাশের মানুষের কণ্ঠ ওকে ততটা আকৃষ্ট করে না, যতটা করে টিভির বিজ্ঞাপন বা কার্টুনের শব্দ।
কিছুদিন আগে এই পাপের একটা প্রায়শ্চিত্ত করলাম। সকালে উঠে টিভির কার্টুন চ্যানেলগুলো ব্লক করলাম। ছেলের ঘর থেকে সরিয়ে ফেললাম পি.এস.পি. আর ট্যাব। ওর প্রায় হারিয়ে ফেলা গল্পের বইগুলি বের করে ওকে কিছু গল্প পড়ে শোনালাম। বিকেলেই এর সুফল পেলাম, ছেলে আর কিছু করার না পেয়ে একের পর এক বই পড়ে ফেলছে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী-র “টুনটুনির গল্প” সে কয়েকবার পড়ে প্রায় মুখস্থ করে ফেললো। যে ছেলে দু’দিন আগে কার্টুন দেখা বাদ দিয়ে বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে নারাজ ছিল, সে কাল সন্ধ্যায় আমাকে ডেকে টুনুটনির গল্প অভিনয় করতে শুরু করল! বাহ, এই তো চাই! কে বলেছে এই ডিজিটাল প্রজন্ম বড্ড যান্ত্রিক? আমার এক আত্মীয় শিশুদের ডাক্তার। আমার ছেলেকে দেখার ফলে তিনি বাসায় তার শিশুকন্যাকে টিভি দেখার প্রতি পুরোপুরি অনাগ্রহী করে বড় করছেন। সেই মেয়ে ২ বছর বয়স থেকে কথা বলতে শুরু করেছে। এখন সাড়ে তিন বছরে সে প্রায় বড়দের মতো করে সব কথা বলে।
আসা যাক খাবারের প্রসঙ্গে। আমরাস্কুলে টিফিন খেতাম ১ টাকায় একটা সিঙ্গাড়া অথবা ২টা পুরি। স্পেশাল ছিল পাঁচ সিকির (১.২৫ টাকা) ক্রিম বন । কিছুদিন পর ৩ টাকার দামের বাটার নান (তিন কোনা রুটি, যার দুই পাশে ক্রিম লাগানো থাকতো) খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, যদিও দাম বেশি বলে রোজ খেতে পেতাম না।। বাড়ির কাছের মোড়ের দোকানে ১ টাকায় পাওয়া যেত ১০টা সুপার বিস্কুট (আকারে এখনকার Oreo বিস্কিটের সমান)। আমরা বাদাম কিনতাম ১ টাকায় এক ঠোঙ্গা, এখনকার প্রজন্ম কি এমনটা কল্পনা করতে পারে? আইসক্রিম বলতে চিনতাম পেতলের ঘণ্টা বাজিয়ে ঠুন ঠুন শব্দ আর টিনের চোঙ্গায় ফুঁ দিয়ে ফেরি করা “রনি সুপার মালাই। চার আনা, আট আনা এক টাকা”। এক টাকার সেই ললিতে দুধের ঘ্রাণ থাকতো, ওগুলো বড়লোকরা খেত, আমি কিনতাম স্যাকারিনের গন্ধওয়ালা আট আনা (৫০ পয়সা)-র মালাই। এখন তো অনেক দোকানে ১০০ টাকার নিচে আইসক্রিমই হয় না! আরো মনে পড়ছে, সন্ধ্যেবেলায় বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় যদি ১০ টাকার মোগলাই পরাটা বা ৫ টাকার শিক-কাবাব আর ১ টাকা দামের সেই ডাল পুরি নিয়ে আসতেন, ঘরে যেন ঈদ হয়ে যেতো। আর এখন তো হাজার টাকার Pizza অথবা Burger Combo ছাড়া বাচ্চাদের মন গলানো যায় না…।
ফাস্টফুডকে আসলে জাংকফুড বলা উচিত। অন্তত এই নামটা ব্যবহার করলে আমরা একটু হলেও চেষ্টা করব বাচ্চাকে এর থেকে দূরে রাখতে। গবেষণায় দেখা গেছে এখনকার চিকেন ফ্রাইগুলি যে মুরগি দিয়ে তৈরি হয়, সেগুলিকে বিশেষ ওষুধ খাইয়ে মোটা-তাজা করা হয়। সেই ওষুধের প্রভাব পড়ছে আমাদের সন্তানদের ওপরও। কম বয়সে মুটিয়ে যাওয়া বা অস্বাভাবিক গতিতে লম্বা হয়ে যাওয়া এর একটি বড় লক্ষণ। বেশিবেশি পনির বা ফ্যাট জাতীয় খাবার হৃৎযন্ত্রের জন্য মোটেও উপকারী নয়। আর দোকানের খাবার কোনটা বাসি, কোনটা সতেজ, তা চেনারও তো কোন উপায় নেই। প্রিজার্ভেটিভ দেওয়া খাবার গ্রহণ আমাদের প্রজন্ম থেকেই আশংকাজনক হারে বেড়েছে, ফলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার হারও বেড়েছে উন্নত বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে। ২০ বছর আগে কি এত বেশি মানুষ এই মরণ-রোগে আক্রান্ত হতো? এখন তো কান পাতলেই শোনা যায় প্রায় প্রতিটি পরিবারে (বা আত্মীয়মহলে) কেউ না কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত। এর জন্যে আমাদের খাদ্যাভ্যাস কিন্তু অনেকটাই দায়ী। এবং কোন কোন ক্ষেত্রে শৈশবের খাদ্যাভাস পরিণত বয়সে ক্যান্সারের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আমার সাড়ে সাত বছরের পুত্রকে আমি জীবনে মাত্র একবার পিজজা খাইয়েছি, বার্গার কবে খাইয়েছি, মনে পড়ছে না। আর স্যান্ডউইচ আমি ঘরেই বানিয়ে দিই; সেটাই ওর প্রিয় নাশতা। শিশুরা যেকোন কিছুর সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেয়। কাজেই ওদের যে অভ্যাস আমরা করাব, ওরা সেটাই রপ্ত করে নেবে। প্রয়োজন শুধু যত্ন নিয়ে ওদেরকে সঠিক পথ দেখানোর। আজকালকার কর্মব্যস্ত বাবা-মায়েরা বাচ্চাকে ঠিকমতো সময় দিতে না পারার গ্লানি ঢাকতে ওদেরকে জাংকফুড খাইয়ে তুষ্ট করার চেষ্টা করেন, এটা মনে হয় সঠিক সমাধান নয়।
আমরা যারা অ্যনালগ যুগ থেকে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি, তারা অনেকেই কিছুটা ভারসাম্যহীন জীবন যাপন করছি। প্রযুক্তিকে জীবনের কতটুকু অংশ দখল করতে দেওয়া উচিত, তা বোধ করি ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমি এমন অনেক দম্পতিকে চিনি, যাঁরা পরস্পরকে কাছে পান শুধুমাত্র রাতের বিছানায়। দেশে বা বিদেশে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের এই প্রজন্মের স্বামী-স্ত্রীরা দু’জনেই কর্মজীবি। ফলে দিন কাটে অফিসের ব্যস্ততায়, হয়তো কাজের ফাঁকে জরুরী আলাপ সারা হয় ফোনে বা টেক্সট মেসেজে। ফেসবুকের পোস্ট দেখে পরস্পর জেনে নেন কার মনের কী খবর, আর মান-অভিমান, ঝগড়া-খুনসুটি – এসব যেন ফ্রেমবন্দি হয়ে পড়েছে চ্যাটের চারকোনা বাক্সে। অনলাইনে আর যাই হোক, অনুভূতির সঠিক প্রকাশ হয় না, ফলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকেই যায়; সেই সাথে ক্ষীণ হয় বন্ধনের গাঢ়ত্ব। ব্যতিক্রম আছে, আমি শুধু সাধারণ চিত্রটায় আলো ফেলছি। রাতে বাড়ী ফিরে স্বামী বসেছে ল্যাপটপ খুলে, স্ত্রী টিভিতে সিরিয়াল দেখতে দেখতে মোবাইলে চ্যাট করছে কোন বন্ধু’র সাথে, সন্তানটি তার ঘরে টিউটরের কাছে পড়ছে, অথবা কম্পিউটারে গেমস খেলতে ব্যস্ত – এরকম দৃশ্য কি এখন প্রায় সব একক পরিবারে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি? এরকম একটি পরিবারের ভেতরের বন্ধনটি কি খুব সুস্থ? এই সন্তান যদি বড় হয়ে তার বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়, সেটা কি তার অন্যায় হবে? সমাজবিজ্ঞানীরা ভাল বলতে পারবেন, প্রযুক্তি আমাদের আবেগকে গত কয়েক দশকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। আমি এমন অনেক পরিবার দেখেছি, যারা মাসে কয়টি দিন এ সাথে খেতে বসেছে, তা তাদেরকে মনে করে বলতে হবে। পরস্পরকে প্রবোধ দিতে তারা হয়তো বছরে একবার সপরিবারে বিদেশ ভ্রমণে যান, একগাদা শপিং করেন, আর “Life is beautiful” বলে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস ছাপেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, তাঁরা ঠিক জীবনের আসল স্বাদটা পাচ্ছেন না। বরং প্রতিদিন পরিবারকে “কোয়ালিটি টাইম” দেওয়া জীবনকে আরো বেশি অর্থবহ করে। দামী রেস্টুরেন্টে খাওয়াটা জরুরী নয়, দামী রিসোর্টে থাকাটাও মূখ্য নয়। পরিবারের সকলে মিলে বাসার ছাদেও বনভোজন করা যায়, সেটাও অনেক উপভোগ্য ।
আমার স্ত্রী (মেডিক্যালের ছাত্রী ছিল বলে কি না জানি না) সম্পর্কের সুস্থতা বিষয়ে বেশ সাবধানী। সে কারণে সে তার ফেইসবুক অ্যাকাডন্ট Deactivate করে রেখেছে, আমাকেও প্রায় করতে বলে, আমি পারি না। তবে বাসায় ছুটির দিনে আমরা চেষ্টা করি টিভি কম দেখে ছেলেকে বেশি সময় দিতে, আমি লেখা-লেখির অভ্যেসটাও কমিয়ে ফেলেছি, বরং সেই সময়টা ওকে বই পড়ে শোনাই বা ওর সাথে খেলি। এছাড়া প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে ওকে আমি পড়াই, কোন টিউটর রাখি না ওর সাথে সময়টা কাটাব বলে। আমাদের কোন গৃহপরিচারিকা নেই। কাজেই রান্নাঘরে আমার স্ত্রীকে অনেক সময় দিতে হয়, সে সুকৌশলে আমাকে রান্নার কাজে involve করে, যাতে আমি ওর সাথে কিছু সময় কাটাই। ক্লান্ত লাগলেও বিষয়টা বেশ উপভোগ করি আমি।এগুলি তুচ্ছাতিতুচ্ছ উদাহরণ, কিন্তু দিন শেষে দেখা যায়, ওটুকু সময় ওর সাথে না কাটালে আমাদের জীবনটা হয়তো “যার-যার তার-তার” হয়ে যেতো।
প্রযুক্তির এই যুগে আমরা কেউই প্রযুক্তিবিমুখ হয়ে টিকে থাকতে পারব না। তবে মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতা আমাদেরকে যেন কাছের মানুষদের থেকে দূরে ঠেলে না দেয়, সেই ভারসাম্য বজায় রাখাটাই বোধ করি এই ডিজিটাল যুগের একটা বড় সামাজিক চ্যালেঞ্জ।
লিখেছেনঃ কাজী মিতুল
মডেলঃ নিধি
ছবিঃ Royena Rasnat