মিসেস খালেদা তার ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছেন, কিন্তু পাত্রী খোঁজা নিয়ে তিনি বেশ বিপাকে। ছেলের বউ হতে হবে স্মার্ট, পারদর্শী, শিক্ষিতা। এবং যেই গুণটি অবশ্যই প্রয়োজন সেটি হচ্ছে সুন্দর গায়ের রং। ফর্সা বউ না হলে কমিউনিটিতে লোকে কি বলবে? পাশের বাসার রুমা আপার ছেলের বউ টা দেখার মত! বিয়ের পর সবাই কি যে প্রশংসা করেছে! তার ছেলে তারিক এর জন্য ঠিক এইরকম একটা বউ চাই। গুণ থাকুক আর না থাকুক, ফর্সা হতেই হবে!
না, গল্প লিখছি না। বাংলাদেশের সর্বস্তরের সমাজে এই ব্যাপারটি এখনো বেশ ভালোভাবে চালু আছে। সুন্দরী মেয়ে হলে তাদের প্রস্তাব ক্রমাগত আসতে থাকে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী আরো কত কি! কিন্তু গায়ের রং যদি একটু কালো হয়, তাহলে সেটা নিয়ে কত দুয়ো শুনতে হয়। একটা সময় আসে, যখন দেখতে কালো মেয়েটির আশে পাশে অন্যসব মেয়েরাও নিজেদের নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। আসলেই কি তারা সুন্দর? এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে বেশিরভাগ মেয়ে কিংবা নারীই নিজেকে সুন্দর বলতে দ্বিধাবোধ করেন। কিন্তু কেন করেন সেটা নিয়ে তাদের মনে অনেক প্রশ্ন জমা।
সম্প্রতি একটা জরিপে দেখা গেছে শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং বিশ্বের অন্যতম বড় বড় নারীবহুল শহরের নারীরাও নিজেদের কে সহজে সুন্দর বলে পরিচয় দিতে চান না। এমনই একটি জরিপ চালিয়েছিলো সম্প্রতি বিশ্বের জনপ্রিয় হেয়ার শ্যাম্পু নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডাভ (Dove)। এই জরিপ এর জন্য তারা বিশ্বের ৫টি বড় শহরে (সান ফ্রান্সিস্কো, সাংহাই, দিল্লি, লন্ডন, আর সাও পাওলো) নারীদের যাতায়াত ও অবস্থানের জায়গাগুলোর প্রধান দরজাকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলো। প্রথম প্রবেশ পথে উপরে সাইন বোর্ড টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছিলো “Beautiful” বা সুন্দর এবং অন্য প্রবেশ পথের উপরে সাইন বোর্ড টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছিলো “Average” বা সাধারণ।
টানা কয়েকদিন নারীদের প্রবেশ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেলো যে তারা সুন্দর প্রবেশ পথটি দিয়ে ঢুকতে বেশ দ্বিধা বোধ করেন। অনেকে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন কোন পথে ঢুকবেন। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেও আলোচনা করেও নিচ্ছিলেন। কিন্তু শেষমেশ সবাই ওই সাধারণ দরজা দিয়েই ঢুকছিলেন। কেন এমন করছিলেন তারা এমন প্রশ্নের উত্তরটাও তারা দিলেন একটু দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে, “আসলে আমি বুঝতে পারছিলাম না কোন দরজা দিয়ে ঢুকবো। আবার কখনো কিছু না ভেবেই সাধারণ দরজাটি দিয়ে ঢুকে পড়ছিলাম। কারণ সুন্দর ব্যাপারটা আমার মাঝে নেই বলেই আমার ধারণা। তাই সাধারণ দরজাটা বেছে নিয়েছি।”
আসলে ব্যাপারটি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সমাজের মতামত অনুসারে সেইসব নারী নিজেকে সাধারণ হিসেবেই বেছে নিয়েছেন। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে সুন্দর হওয়ার যোগ্যতা তাদের মাঝে নাই। এই আত্মতুষ্টিহীনতার সূত্রপাত মূলত হয়েছে সামাজিক এক চোখা চাহিদা থেকে। গায়ের রং ফর্সা হলেই সুন্দর, এটি একরকম নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের মাঝে। বিশেষ করে উন্নত দেশ গুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে এই প্রভাব বেশি বিস্তার করেছে, এবং এই প্রভাব ক্যান্সারের মত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পরিস্থিতি এমন, যে নারীরা নিজেদের সুন্দর ভাবা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের কাছে তারা নিজেরা কেবলই সাধারণ একজন নারী।
তবে এই জরিপের শেষদিকে একটু আশার ব্যাপার দেখা গেছে। যেসব নারী এতদিন নিজেদেরকে কেবল সাধারণ হিসেবে ভেবে আসছিলেন একদিন তারা সেই নিয়ম ভাঙ্গলেন। একবারের জন্য হলেও নিজেকে সুন্দর ভাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এবং সেই “সুন্দর” সাইনবোর্ড দেয়া প্রবেশ পথ দিয়ে ঢোকা শুরু করলেন। তারপর তাদের ধারণা বদলে গেলো। তারা বুঝতে পারলেন, সুন্দর ভাবার সিদ্ধান্তটা তাদের নিজের, সমাজের নয়!
নিজেদের ধারণা বদলে যাওয়া এইসব নারীরা ভাবেন, তাদের মত বিশ্বের সকল নারীরা ধীরে ধীরে নিজেদের দ্বিধাবোধ থেকে নিজেকে বের করে আনুক। নিজেদের সুন্দর ভাবতে শিখুক। এমন দিন তারা দেখতে চান, যেদিন সাধারণ নারীর দরজাটা একেবারে খালি হয়ে যাবে। এবং সুন্দরীদের দরজা দিয়ে সবার প্রবেশ করার হিড়িক পড়ে যাবে।
Dove এর জরিপের ভিডিওটি দেখুনঃ
কেবলমাত্র গায়ের ত্বক ফর্সা না হলেই কেউ নিজেকে অসুন্দর ভাবার কোন কারণ নেই। সৌন্দর্য্য গায়ের ত্বকে নয়, বরং আপনার নিজের আত্মবিশ্বাসে বিদ্যমান। যদি জরিপের এই নারীদের মত বাকিরাও সমাজের সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে নিজেকে সুন্দর বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাহলে সমাজটা বদলে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ নারী সুন্দর, এটা ভাবা কেবলমাত্র একটি বড় ধরণের আত্মবিশ্বাসের সূত্রপাত। এই আত্মবিশ্বাস ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে আপনার জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রে। নারীর অধিকার বাস্তবায়ন এবং সমাজে তাদের অবস্থান হবে আরো শক্ত, আরো সম্মান জনক।
সৌন্দর্য্য আসলে কিসে? সমাজের সিদ্ধান্তে নাকি আপনার নিজের আত্মবিশ্বাসে?
এই মুহুর্তে যে পাঠিকা আমার লেখাটি পড়ছেন, আপনি কি সুন্দর? নাকি সাধারণ?
সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার।
লিখেছেন – ফরহাদ রাকিব।