বেশ কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা, আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মাদকাসক্তি মানুষকে কোথায় নিয়ে নিয়ে যেতে পারে! সম্ভবত তখন তাকে আর মানুষ বলা যায় না। ঐশী-ই তার বড় প্রমান। এত বড় একটি ঘটনা ঘটে যাবার পর, আমরা কিছুদিন উহ-আহ করলাম, সংবাদ মাধ্যমগুলো আমাদের মতোই লাফালাফি করল। তারপর আমরা বেমালুম সব ভুলে গেলাম (এই আচারন আমাদের মজ্জাগত, যা আমরা সবসময়ই করে থাকি)।
তথ্য ঘাঁটতে গিয়ে আমি আঁতকে উঠলাম! আমি নিশ্চিত সব জানার পর আপনি বলবেন, আমাদের সত্যিই বসে থাকার মত সময় নেই।
মোট জনসংখ্যার ৫% অর্থাৎ ২৩০ মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন প্রকার ড্রাগে আসক্ত। আমেরিকাতে প্রতি তিন জন মাদকাসক্ত পুরুষে একজন মহিলা অবৈধ মাদকে আসক্ত যা ইন্ডিয়া বা ইন্দ্রনেশিয়া তে প্রতি দশ জন পুরুষে একজন। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী মাদকাসক্তির কারনে প্রতি বছর দু’লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশেও মাদকাসক্তের সংখ্যা ভয়ঙ্কর হারে বাড়ছে। এক জরিপে জানা গেছে, এই সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। জরিপে সঠিক সংখ্যা পাওয়াটা প্রায়শ কষ্টকর এবং মাদকাসক্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং ধরেই নেয়া যায় সংখ্যাটা মোটেই এখানে থেমে নেই।
মানুষ নানাবিধ মাদক, নেশার দ্রব্য গ্রহন করে থাকে সারা পৃথিবী জুড়ে যেমন, কোকেন, গাঁজা, ইয়াবা, অ্যালকোহল, হেলুসিনোজেন, আফিম ও ঘুমের ওষুধ ইত্যাদি। এর মধ্যে দেশে তরুণদের মধ্যে নানা কারনে ইয়াবা সবচেয়ে আকর্ষণীয়, এর সহজ বহন ক্ষমতা, সহজ লভ্যতা, ছোট ও আকর্ষণীয় সাইজ, কারন হিসেবে ধরা হয়।
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিঃ
মানুষের মাদকে আকৃষ্ট হওয়ার অনেক কারনের মধ্যে একটি বোধহয় এটি ‘একবার চেখে দেখি কেমন লাগে, একবার খেলে তো কিছু হয় না’। ক্ষতিকর দিকগুলো জানানোর মাধ্যমে মাদকের প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব। মাদক এতটাই ক্ষতিকর যে, এর ক্ষতির প্রভাব মানব শরীরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গেই পড়ে থাকে। আমাদের শরীরের বিপাকের মূল অঙ্গ লিভার। বিভিন্ন মাদক, অ্যালকোহল এই লিভারের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে থাকে। ফ্যাটি লিভার, জন্ডিস, এমনকি লিভার বৃহৎ আকার ধারন করা থেকে শুরু হয়ে লিভার সিরোসিস নামক কঠিন ও ভয়ঙ্কর রোগ হতে পারে। এই রোগ হলে অকাল মৃত্যু বরণের আসংখা বেড়ে যায় অনেকখানি। এমনকি হতে পারে লিভার ক্যান্সার যার ফলাফল একমাত্র মৃত্যু।
বুকজ্বালা, গ্যাস্ট্রিক আলসারের মত সমস্যা বেড়ে যায়, অগ্নাশয়ে হতে পারে প্যানক্রিয়াটাইটিস বা আগ্নাশয়ের প্রদাহ যা খুব মারাত্নক। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে এটা রোগীর জীবনাবসান করাতে পারে। শ্বাসনালী ও খাদ্যনালি, মুখগহবর, কোলন বা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারেও মাদকের ভূমিকা আছে। কিডনির আকার বাড়িয়ে দেয়া, কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে কিডনির হরমোনের ব্যালান্স নস্ট করা, কিডনি বিকলে ভূমিকা রাখার মতো ক্ষতিকর কুপ্রভাবে মাদকের হাত রয়েছে।
হতে পারে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতি ভ্রষ্টতা, এমন কী মস্তিস্কে স্ট্রোক। বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, মানসিক অস্থিরতা, অনিদ্রা, কাজে একাগ্রতার অভাব সব কিছু মিলিয়ে একজন মাদকাসক্ত মানুষ মনের দিক থেকে খুবই অশান্তিতে থাকেন।
বর্তমানে ইয়াবার বহুল ব্যবহারের ফলে এর সম্পর্কে আলাদা করে ক্ষতিকর প্রভাব লেখার দাবি রাখে। ইয়াবার প্রচণ্ড উত্তেজক ক্ষমতা আছে এবং তা অনেকক্ষণ থাকে এ কারনে কোকেনের চেয়ে অ্যাডিক্টরা এটা অনেক বেশি পছন্দ করে। ইয়াবা খেলে সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা, খিটখিটে ভাব, অনিদ্রা ও আগ্রাসী প্রবণতা বা মারামারি করার ইচ্ছা, ক্ষুধা কমে যাওয়া এবং বমি ভাব, ঘাম, কান-মুখ লাল হয়ে যাওয়া এবং শারীরিক সঙ্গের ইচ্ছা ইত্যাদি বেড়ে যায়। তবে এ সবই অল্প কয়েক দিনের বিষয়। বাড়ে হূৎস্পন্দনের গতি, শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্তচাপ এবং শরীরের তাপমাত্রা। মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলোর বহুল পরিমাণে ক্ষতি হতে থাকে এবং কারও কারও এগুলো ছিঁড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। কিছুদিন পর থেকে ইয়াবাসেবীর হাত-পা কাঁপে, পাগলামি ভাব দেখা দেয়, হ্যালুসিনেশন হয় ও প্যারানয়া হয়। হ্যালুসিনেশন হলে রোগী উল্টোপাল্টা দেখে, গায়েবি আওয়াজ শোনে। আর প্যারানয়াতে ভুগলে রোগী ভাবে, অনেকেই তার সঙ্গে শত্রুতা করছে। তারা অনেক সময় মারামারি ও সন্ত্রাস করতে পছন্দ করে। কারও কারও শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, খিঁচুনি হয়। খিটখিটে ভাব, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুর, নার্ভাসনেসে ভুগতে থাকে ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তিরা। স্ম্বরনশক্তি কমে যায়, সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয় এবং কারও কারও সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকে পাগল হয়ে যায়। লেখাপড়ায় খারাপ হয়ে একসময় ডিপ্রেশন বা হতাশাজনিত নানা রকম অপরাধ প্রবণতা, এমনকি আত্মহত্যাও করে থাকে। হার্টের ভেতরে ইনফেকশন হয়ে বা মস্তিষ্কের রক্তনালি ছিঁড়ে অনেকে মারা যায়। অনেকে মরে রাস্তায় দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে। কেউ কেউ টানা সাত থেকে ১০ দিন জেগে থাকে, তারপর ড্রাগ ওভার ডোজে সাধারণত মারা যায়।
আর্থ–সামাজিক ক্ষতিকর প্রভাবঃ
একজন মানুষ যখন মাদকে আসক্ত হয়, তখন তার দ্বারা অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক নানাবিধ ক্ষতি সাধিত হয়। বাংলাদেশের মতো হতদরিদ্র দেশে, যেখানে জনসংখ্যা ধারণ ক্ষমতার চাইতেও বেশি-দরিদ্র, বেকারত্ব, কমংসংস্থানের অভাব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক মন্দাভাব, হত্যা, সন্ত্রাসসহ হাজারো সমস্যা প্রতিনিয়িত মানুষের তাড়া করছে সেখানে মাদকের হিংস্র থাবা বিস্তার করলে পরিস্থিতি কেমন ভয়াবহ হবে তা চিন্তা করলে গা শিউরে উঠে। শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে করে তুলছে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের অবৈধ ব্যবহার রোধ করা গেলে প্রতি বৎসর জাতীয় বাজেটে সাশ্রয় হবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। মাদকাসক্তির ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করতে গিয়ে বের হয়ে আসে এমন একটি তথ্য, যা বদলে দিতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চেহারা। চাঙ্গা করতে পারে বিপর্যন্ত, ধ্বংসপ্রায় অর্থনীতিকে।
নেশার টাকা যোগার করতে গিয়ে মাদকাসক্ত চুরি, ডাকাতি, চোরাচালান ইত্যাদি খারাপ কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পারিবারিক অশান্তি, মারামারি, ভাঙচুর এসব পরিবারে নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনা। মাদকের এই ক্ষতিকর প্রভাব সামাজিক, রাষ্ট্রীও গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পড়েছে। এর আর্থ-সামাজিক প্রভাব সংক্ষিপ্ত আকারে বলতে গেলে বলতে হয়ঃ চোরাচালান, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারসাম্য বিনষ্ট, চিকিৎসাখাতে ব্যয় বৃদ্ধি, আর্থিক দেউলিয়াপনা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচনে অধিক ব্যয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও রপ্তানী ক্ষতিগ্রস্ত, আইন-শৃঙ্খলা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, কালো টাকার আধিক্য ও মুদ্রাস্ফীতি এরকম হাজারো সমস্যা নিয়ে কথা বলা যায়। একটু ঘাঁটলেই এ বিষয়ে কঠিন ও ভয়ঙ্কর অবস্থা পরিলক্ষিত হয়।
ভয়ঙ্কর মাদক চক্রঃ
সারাবিশ্বে এই মাদক গ্যাং খুবই সংঘটিত ও শক্তিশালী। এতটাই শক্তিশালী যে কোন কোন দেশে তারা ঐই দেশের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কলম্বিয়া এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের দেশেও প্রায়শই দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর, প্রতিবাদকারির উপর আক্রমন করেছে মাদক চক্র।
অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধান তিনটি আফিম ও আফিমজাত পণ্য উৎপাদনকারী অঞ্চলের কাছাকাছি একটি দেশ হওয়ায় এবং প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে বিপজ্জনক মাদকদ্রব্যের প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশকে গত প্রায় তিন দশক ধরে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের রুট হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সারা বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত পপির সিংহভাগই উৎপাদিত হয় এশিয়ার ৩টি প্রধান অঞ্চলে যথা: (১) থাইল্যান্ড, লাওস ও বার্মা-এই তিনটি দেশের সীমান্ত সংযোগ স্থলে যাকে গোল্ডের ট্রায়াঙ্গল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। (২) পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান ও তুরস্ককে নিয়ে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট অঞ্চল এবং (৩) এ দুটি অঞ্চলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ভারত-নেপাল সীমান্ত জুড়ে গোল্ডেন ওয়েজ এলাকা।
মূলত পঞ্চাশের দশক থেকে অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র বাংলাদেশকে মাদকাসক্তি চোরাচালানের করিডোর হিসাবে ব্যবহার করে আসছে। বাংলাদেশকে মাদক পাচারের করিডোর হিসাবে বেছে নেবার পিছনে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে দুটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। প্রথমটি বিশ্বের প্রধান মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলো যেমন গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী। তাছাড়া বাংলাদেশের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য উৎপাদনে ও ব্যাপক ব্যবহারে দীর্ঘদিন যাবত মুক্ত ছিল ফলে আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ সংস্থার কার্যাবলী ও তাদের সন্দেহের বাইরে থাকে। মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীরা ও সুযোগকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় কিছুটা নিয়ন্ত্রনে রয়েছে।
আমাদের যা করণীয়ঃ
গণসচেতনতাই এই সমস্যা উত্তরণের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পথ। মাদক বিরোধী সকল কার্যক্রম পরিচালনা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের দায়িত্বও কোন অংশে কম নয়। কেননা এই মাদকাসক্ত ব্যক্তি আমি, আপনি অথবা আমাদেরই সন্তান। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি একদিকে যেমন অনুউৎপাদনশীল অর্থাৎ তিনি কোন উৎপাদনে অংশ নিচ্ছেন না, তেমনি নানা ভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করছেন। এখন আমাদের কাজ বোধহয় দুটি ১. সচেতনতার মাধ্যমে এটা দেখা যে, নতুন করে কেও যেন আর মাদকাসক্ত না হয় এবং মাদক চক্র ভেঙ্গে দেয়া অর্থাৎ প্রতিরোধ। ২. যারা ইতিমধ্যে মাদকাসক্ত হয়েছে তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা অর্থাৎ প্রতিকার।
তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেট, দৈনিক প্রথম আলো ও কিছু বই।
ছবিঃ ওয়ানটুথ্রিআরফ.কম
লিখেছেনঃ সাইফুল্লাহ ফয়সাল