গর্ভধারণ একজন মায়ের জন্য অনেক আনন্দের একটা বিষয়। অনেক স্বপ্ন জড়িয়ে থাকে এতে। কিন্তু অনেক সময় সেই স্বপ্নের আকাশে গর্ভপাত নামক ঘন কালো মেঘ দেখা দিতে পারে। অনেক স্বপ্ন অংকুরেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। একজন মায়ের জন্য গর্ভধারণের প্রথম দিকে গর্ভপাত অনেক বেদনাদায়ক। আর তাই early miscarriage বা গর্ভধারণের একদম শুরুর দিকে গর্ভপাত নিয়ে আজকে লিখতে বসেছি।
গর্ভধারণের প্রথম দিকে গর্ভপাত
এক্সপার্টরা বলেন, মোট গর্ভপাতের ২০% হয়ে থাকে গর্ভধারণের একদম শুরুর দিকে। এমনকি একজন মা প্রেগন্যান্ট কিনা তা সে নিজে জানার বা বোঝার আগেই গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে। যেহেতু অনেক মহিলার প্রেগন্যান্সি বোঝার আগেই miscarraige হয়, তাই এটি সম্পর্কে জানা অনেক গুরূত্বপূর্ণ। Miscarraige হলো গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত হয়ে যাওয়া। বেশিরভাগ ঘটে প্রথম ১৪ সপ্তাহের মাঝে। Miscarraige এর মেডিক্যাল টার্ম হলো spontaneous abortion।
গর্ভধারণের প্রথম দিকে গর্ভপাত হয় কেন?
এখন প্রথমে গর্ভপাতের কারণ বুঝতে গেলে আমাদের জানতে হবে, গর্ভধারণের একেবারে শুরুর দিকে কী ঘটে, একজন মায়ের শরীরে? একজন মায়ের ডিম্বাশয় থেকে একটি ডিম বিভিন্ন প্রসেস এর মাধ্যমে বের হয়ে ফেলোপিওন টিউব হয়ে আস্তে আস্তে uterus বা গর্ভাশয়ে আসে। শারীরিক মিলন হলে পিতার sperm বা শুক্রাণুর সাথে ডিম্বাণুর নিষেক হয়। এরপর নিষিক্ত জাইগোটে বিভাজন ঘটে। ৫ দিন পর ব্ল্যাস্টোসিস্ট তৈরি হয়। এটি ১০ দিনের মাথায় গর্ভাশয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। তখন একজন মহিলাকে টেকনিক্যালি প্রেগন্যান্ট বলা হয়। এরপর ব্ল্যাস্টোসিস্ট টিশ্যু ভেঙে পুষ্টি নেয়। যদি তখন পর্যাপ্ত পুষ্টি না পায়, তখন গর্ভপাত হয়ে যায়। এছাড়া আরো অনেক কারণ আছে।
গর্ভধারণের প্রথম দিকে গর্ভপাত হওয়ার কারণসমূহ
১) গর্ভধারণের প্রথম দিকে গর্ভপাত কেন হয় এটির সঠিক কারণ জানা যায় নি। তবে ধারণা করা হয়, বাচ্চার ক্রোমোজমাল এবনরমালিটির বা অস্বাভাবিকতার কারণে এটি হয়ে থাকে। আর ক্রোমোজমাল এবনরমালিটি হয় ডিম্বাণু অথবা শুক্রাণুতে কোনো সমস্যা থাকলে অথবা জাইগোটে যখন বিভাজন হয়, তখন কোন সমস্যা হলে। এছাড়া হরমোনাল সমস্যা থাকলে, মায়ের ইনফেকশন থাকলে, অথবা মায়ের কোন অসুখ থাকলে, লাইফ স্টাইল (ধূমপান করা, ড্রাগ এডিক্টেড, পুষ্টিহীনতা, অতিরিক্ত ক্যাফেইন খাওয়া, রেডিয়েশন অথবা বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসলে) জাইগোট ভালোভাবে গর্ভাশয়ে প্রতিস্থাপিত না হলে।
২) মায়ের বয়স বেশি হলে বেশি হবার সম্ভাবনা থাকে (৩৫ এর নিচে ১৫%, ৩৫-৪০ এ ২০-৩০%, ৪৫ এ ৫০% গর্ভপাত হবার সম্ভাবনা থাকে)।
৩) মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কনট্রোলে না থাকলে।
৪) যার আগে গর্ভপাত হয়েছে তার ২৫% সম্ভাবনা থাকে।
৫) হার্ট বা কিডনিতে সমস্যা থাকলে।
৬) থাইরয়েডে সমস্যা থাকলে।
গর্ভধারণের প্রথম দিকে গর্ভপাত হওয়ার উপসর্গ
কিছু কিছু উপসর্গ আছে যেগুলো দেখে বোঝা যায় যে, গর্ভপাত হচ্ছে কিনা!
১. রক্তপাত
গর্ভপাতের সবচেয়ে সাধারণ চিহ্ন হলো যোনি দিয়ে হালকা বা অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া। যদিও প্রেগন্যান্সির প্রথম দিকে রক্তপাত হওয়া স্বাভাবিক। কনসিভ করার ৭-১০ দিনের মাথায় ইমপ্লান্টেসনের কারণে কিছু রক্তপাত হয়। এটা স্বাভাবিক। এই রক্তের পরিমাণ অনেক কম থাকে, এমনকি নরমাল মাসিকে যে রক্ত যায়, তার চেয়েও কম। তবে অতিরিক্ত রক্ত গেলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করবেন। অনেক সময় অনেকে বুঝতেই পারেনা যে, তিনি প্রেগন্যান্ট। তাই অতিরিক্ত রক্ত গেলে ভাবেন যে, হয়ত দেরিতে মাসিক হচ্ছে, আর অতিরিক্ত রক্ত যাচ্ছে যেটা স্বাভাবিক। আসলে তা নয়। প্রেগন্যান্সির প্রথম ৩ মাস রক্ত যোনি দিয়ে গেলেই ডাক্তার দেখানো উচিত। রক্তপাতের সময় নিচের ক্রাইটেরিয়া গুলো লক্ষ্য করুন,
- বাদামি বা উজ্জ্বল লাল রক্ত যাওয়া, সাথে cramping বা পেটের বা কোমড়ের পেশীর সংকোচন থাকতে পারে নাও পারে।
- অতিরিক্ত রক্ত গেলে, ঘণ্টায় ১টার বেশি প্যাড ভিজলে।
- হঠাৎ রক্তপাত হলে।
এগুলো দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরনাপন্ন হবেন।
২. Cramping বা পেশীর সংকোচন বা ব্যথা
হালকা পেশীর সংকোচন জনিত ব্যথা স্বাভাবিক। এটি অস্থায়ী ও অল্প সময়ের জন্য থাকে। যদি অতিরিক্ত ব্যথা হয় এবং নিচের বৈশিষ্ট্য গুলো থাকে,
০১. প্রথমে পিঠের বা কোমড়ের দিকে ব্যথা হয়।
০২. ব্যথা অনেকক্ষণ স্থায়ী হয়।
০৩. ব্যথার সাথে রক্তপাত হয়।
এগুলো থাকলে সাথে সাথে ডাক্তার দেখাবেন।
৩. পানি ভাঙা বা যোনি দিয়ে মিউকাস যাওয়া
যদি যোনি দিয়ে সাদা-গোলাপি রং এর মিউকাস বা পিচ্ছিল পদার্থ যায় অথবা হঠাৎ করে প্রচুর পানি গেলে অথবা সলিড টিশ্যু বের হলে, গর্ভপাত হয়। এছাড়া অন্য উপসর্গ গুলো হলো,
-ওজন কমে যাওয়া।
-প্রেগন্যান্সির চিহ্ন গুলো হঠাৎ করে হ্রাস পাওয়া।
-বাচ্চার হার্ট সাউন্ড না পাওয়া,আল্ট্রাসাউন্ডে।
গর্ভপাত হয়ে গেলে চিকিৎসা কী?
চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, রক্তপাত বন্ধ করা ও ইনফেকশন প্রতিহত করা। সাধারণত গর্ভধারণের স্থায়িত্ব যত কম হয়,শরীর ততো তাড়াতাড়ি ফিটাল ম্যাটারিয়াল সব বের করে দেয়। তখন মেডিকেল প্রসিডিউর দরকার হয় না। যদি শরীর নিজে নিজে বের না করে, তখন D&C করতে হয়। এরপর বাসায় রক্তপাত মনিটর করতে হবে। যদি কাঁপুনি বা জড় আসে, তাহলে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করবেন।
গর্ভপাত প্রতিরোধ করার উপায়
বেশিরভাগ গর্ভপাত জেনেটিক সমস্যার কারণে হয়। দূর্ভাগ্যবশত এগুলো প্রতিরোধ এর উপায় নেই। তবে যেসব অন্য কারণে হয়, সেগুলো প্রতিরোধ করা যেতে পারে। যদি একবার হয়ে থাকে গর্ভপাত, তাহলে সম্ভব হলে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করন, গর্ভপাতের কারণটা জানার চেষ্টা করুন। পরের বার গর্ভধারণের আগে ও সময় নিজের লাইফ স্ট্যাইলে কিছুটা পরিবর্তন আনুন। নিচে কিছু টিপস দেয়া হলো, যেটা আপনাদের গর্ভপাত প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে-
১. গর্ভধারণের আগের এক দুই মাস থেকে ফলিক এসিড ৪০০ মিঃগ্রাঃ একটি করে খাবেন সম্ভব হলে।
২. ব্যায়াম করবেন নিয়মিত।
৩. স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার খাবেন।
৪. স্ট্রেস ম্যানেজ করা শিখতে হবে।
৫. ধূমপান করবেন না, বা আশেপাশের কেউ যাতে ধূমপান না করে, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।
৬. এক্স রে, বা অন্য রেডিয়েশনে এক্সপোজ হওয়া যাবেনা।
৭. যেকোনো ওষুধ খাবার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৮. অ্যালকোহল বা অতিরিক্ত ক্যাফেইন খাবেন না।
৯. পেটে যাতে কোনও আঘাত না লাগে, এ ব্যাপারে সতর্ক হোন।
পরিশেষে, সব হবু মায়েদের জন্য রইল শুভ কামনা। ভালো থাকুক প্রতিটি মা ও শিশু।
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ; ইমেজেসবাজার.কম