পিত্তথলিতে পাথর (Gallbladder Stone or Gall Stones) হওয়া আমাদের চারপাশের অতিপরিচিত রোগগুলোর মধ্যে একটি। আত্মীয়স্বজনের কারো পিত্তথলিতে পাথর হয় নি বা এজন্য গলব্লাডার ফেলে দিতে হয় নি এমন লোক মনে হয় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। সত্যিই কি পাথর হয় না এগুলো অন্য কিছু? এসব কি সত্যিকারের পাথরের মতো? কিভাবে ওখানে গেলো? এ জাতীয় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় আমাদের মনে। আসুন তবে জেনে নেই পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত।
পিত্তথলিতে পাথর কেন হয়?
পেটের ডানদিকে যকৃতের পেছনে ও তলার দিকে থাকে পিত্তথলি (Gallbladder)। পিত্তরস তৈরি করাই এর কাজ। খাবার হজমে, বিশেষ করে চর্বিজাতীয় খাবার হজম করতে পিত্তরস দরকার হয়। নানা কারণে এই পিত্তথলিতে বিভিন্ন পদার্থ অতিরিক্ত জমে গিয়ে পাথরের সৃষ্টি করে।
কোলেস্টেরল, বিলিরুবিন বা ক্যালসিয়াম ইত্যাদি পদার্থের সংমিশ্রণে তৈরি এই পাথরগুলো পিত্তরসের সঙ্গে মেশানো অবস্থায় থাকে এবং হালকা বাদামি, ময়লাটে সাদা বা কুচকুচে কালো রঙেরও হতে পারে। কী পদার্থ দিয়ে পাথরটা তৈরি তার ওপর নির্ভর করে পাথরের রঙ ও আকৃতি।
কাদের বেশি হয়?
পিত্তথলিতে পাথর হয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব সহজ নয়। তবে এ সমস্যা বেশি দেখা যায় মেয়েদের মধ্যে। প্রতি ৩ জন রোগীর মধ্যে ২ জনই হয়ত মেয়ে। ৬৬ ভাগ মেয়েদের হয়। ডাক্তারি ভাষা অনুযায়ী ফাইভ এফ ফ্যাক্টর বলে একটি বিষয় আছে-
১) ফিমেইল (নারী)
২) ফ্যাটি (স্থূল)
৩) ফরটি (৪০ বছর)
৪) ফারটাইল (প্রজননক্ষম)
৫) ফেয়ার (ফর্সা)
এ ধরনের নারীদের এই রোগটি বেশি হয়। তবে পুরুষরাও এ রোগের আওতার বাইরে নন। অবশ্যই পুরুষদের হচ্ছে। পিত্তথলির নানান সমস্যার রোগীদের প্রতি ৩ জনে ১ জন পুরুষ এ রোগে আক্রান্ত পাওয়া যায়।
লক্ষণসমূহ
প্রধানত এই পাথর হলে পেটে ব্যথা হয়। পিত্ত থাকে আমাদের পেটের ডান দিকের ওপরের অংশে, লিভারের সঙ্গে লেগে। ব্যথা মূলত ওই জায়গাতেই হয়। কখনো কখনো তীব্র ব্যথা হয়। আবার কখনো কখনো অল্প অল্প ব্যথা হয়। এই ব্যথা কখনো সম্পূর্ণ পেটে ছড়িয়ে যায়, ওখান থেকে শুরু হয়ে অথবা পিঠ ও ডান কাঁধের দিকে ছড়ায়। এর সঙ্গে রোগীর বমি থাকে, জ্বর থাকে, কখনো কখনো কাঁপুনিও থাকতে পারে অথবা কখনো জন্ডিস থাকতে পারে।
চিকিৎসা
চিকিৎসার শুরুতে ব্যথা বেশি থাকলে রোগীকে মুখের সবধরনের খাবার বন্ধ করে স্যালাইন দেয়া হয়, সেই সাথে ব্যথার ওষুধ, গ্যাসের ওষুধ এবং অ্যান্টিবায়োটিক-ও দেয়া হয়। শতকরা ৯০ ভাগ রোগীই এই চিকিৎসায় সুস্থ বোধ করেন। এরপর চিকিৎসক সময় বুঝে রোগীকে অপারশন করে পিত্তথলি ফেলে দেবার পরামর্শ দেন। প্রায় সময়ই এই ভর্তিতেই অপারেশন বা কলিসিস্টেকটমি করে দেয়া হয়। তবে রোগীর অন্য কোনো সমস্যা থাকলে ২-৩ মাস পরেও এটা করা যেতে পারে। পেট কেটে এবং মেশিনের সাহায্যে সামান্য ফুটো করে দুভাবেই কলিসিস্টেকটমি করা যায়। শুধু পিত্তনালীতে পাথর হলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অপারেশন না করে শুধু ইআরসিপি করেও তা সরিয়ে ফেলা যায়, পিত্তথলিতে পাথর হলে তেমন করার সুযোগ থাকে না।মনে রাখতে হবে শুধু ওষুধ সেবনে পিত্তথলির পাথর ভালো করে দেয়া সম্ভব নয়, তাই এই ধরনের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়া ঠিক হবে না।
পিত্তথলি ফেলে দিলে কি কোন ক্ষতি হয়?
পিত্তথলি যদি সঠিকভাবে কাজ না করে সেই ক্ষেত্রে চর্বিজাতীয় খাবার হজমে অসুবিধা হবে। ফলে ওই চর্বি বা ফ্যাটের সঙ্গে ভিটামিন কে বা আরো প্রয়োজনীয় ভিটামিনগুলোও শোষণ হবে না এবং নানা রকম সমস্যা দেখা দেবে। সমস্যা দেখা দেয় ঠিকই, কিন্তু অনেকেরই আছে পিত্তথলি নেই বা পিত্তথলি কাজ করছে না, দীর্ঘদিন ধরে পিত্তথলির রোগে ভুগছেন, তার মানে এই না যে তাদের ভিটামিন এ, ডি, ই ও কে শোষণ হবে না বা আমাদের শরীরে ঢুকতে পারবে না। যাদের গলব্লাডার-এ সমস্যা আছে, এটি যখন ফেলে দেওয়া হয় সেই ক্ষেত্রে শরীর এটাকে অবশ্যই সমন্বয় করে নেয়। পিত্তটা প্রতিদিনই আমাদের অন্ত্রের মধ্যে আসে। তবে এত ঘনভাবে আসে না। খাওয়ার সময় আসে না। কিন্তু সার্বক্ষণিকভাবে আসতে থাকে। তাই ওই ভিটামিনগুলো শোষণে সমস্যা হয় না।
মেনে চলুন কিছু নিয়ম
পিত্তথলিতে পাথর প্রতিরোধে বা অপারেশনের পর সুস্থ থাকতে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে, যেমন-
১. অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন।
২. বাটার বা চিজ জাতীয় খাবার সেবনে নিয়ন্ত্রিত হন।
৩. পরিমিত পরিমাণে পানি পান করুন।
৪. অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার বর্জন করুন।
৫. ওজন কমাতে ক্রাশ ডায়েট না করে নিয়ম মেনে ডায়েট করুন।
৬. কফি, দুগ্ধ জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার পরিমিত পরিমাণে সেবন করুন।
৭. অতিরিক্ত তেল, ঝাল, মশলাযুক্ত খাবার বর্জন করুন।
৮. ডিমের কুসুম খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। কারণ, অপারেশনের পর পিত্ত রস পাতলা থাকে যা উচ্চ কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার হজম করতে পারে না।
নিয়ম মেনে চললে কোন রোগব্যাধিকেই শরীরের ক্ষতি করতে দেয়া যায় না। রোগ যেমন আছে, প্রতিরোধ ও প্রতিকারও তেমনি আছে । তাই নিয়ম মেনে চলুন, সুস্থ থাকুন ও ভালো থাকুন।
ছবিঃ সংগৃহীত – সাটারস্টক