হৃদরোগ এখন বিশ্বব্যাপী অকাল মৃত্যুর একটি বড় কারণ। হার্ট অ্যাটাক হয় সাধারণত হৃদপিন্ডে পর্যাপ্ত রক্ত চলাচল কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলে। অথবা রক্ত চলাচলের শিরা-উপশিরাগুলোতে কোন ব্লক হলে হার্ট অ্যাটাক হয়। তবে আগেভাগেই হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো ধরতে পারলে হয়তো অকাল মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের এক মাস আগে থেকেই দেহ কিছু সতর্কতা সংকেত দিতে শুরু করে। সাধারণত বুকে ব্যাথা হলেই আমরা ভেবে থাকি হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, আসলেই কি তা? কতটুকু জানি আমরা? আজকে আমরা আপনাদের জানাবো হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো এবং এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ
(১) শারীরিক দুর্বলতা
রক্ত প্রবাহ কমে গেলে এবং রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হলে এমনটা হয়। রক্তের শিরা উপশিরাগুলোতে চর্বি জমে বাধা সৃষ্টি করলেও মাংসপেশী দুর্বল হয়ে পড়লে হৃদরোগের প্রধানতম এই লক্ষণটি দেখা দেয়।
(২) ঠাণ্ডা ঘাম
রক্ত প্রবাহ কমে গেলে দেহে ঘাম ঝড়লে স্যাঁতস্যাঁতে ও ঠাণ্ডা ভাব অনুভূত হবে।
(৩) ঠাণ্ডা ফ্লু
হার্ট অ্যাটাকের শিকার অনেককেই ১ মাস আগে থেকে
ঠাণ্ডা সর্দি বা ফ্লু-তে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
(৪) ঝিমুনি
সাধারণত দেহে রক্তের প্রবাহ কমে গেলে ঝিমুনিও দেখা দেয়। মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ কমে গেলে ঝিমুনির সৃষ্টি হয়ে থাকে।
(৫) বুকে ব্যাথা
বুক, বাহু, পিঠ এবং কাঁধে ব্যাথা অনুভূত হলে দ্রুত ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। বুকে ব্যাথা ও সংকোচন হৃদ রোগের একটি বড় লক্ষণ।
(৬) বদ হজম, বমি ও তলপেটে ব্যাথা
বমিভাব, বদহজম, বুক হৃদপিন্ডে জ্বালাপোড়া করা বা তলপেটে ব্যাথাও অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ হতে পারে। সুতরাং, এই লক্ষণগুলো দেখা গেলেও হৃদরোগের ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
(৭) শ্বাসকষ্ট
ফুসফুসে পর্যাপ্ত পরিমানে অক্সিজেন এবং রক্ত সরবরাহ না হলে এই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। হার্টের সমস্যা থাকলে ফুসফুসে রক্ত চলাচল কমে যায়। আর শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস ছোট হয়ে আসার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কাদের বেশি?
কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় আবার কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সাধারণত যেসকল কারণে হার্ট অ্যাটাক হতে পারেঃ
(১) হার্ট অ্যাটাক সব বয়সে একরকমভাবে হয় না। সাধারণত মধ্যবয়সে কিংবা বৃদ্ধ বয়সে এ রোগটি বেশি হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই না যে ছোট বাচ্চাদের এই সমস্যা হয় না। তাদের ঝুঁকি তুলনামূলক কম থাকে।
(২) ধুমপান ও মদ্যপান ইত্যাদি কারনে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
(৩) বংশে কারও হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
(৪) সাধারণত মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অনেক বেশি হয়।
(৫) ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপার লিপিডেমিয়া ইত্যাদি রোগের কারণে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
(৬) শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে মুটিয়ে যাওয়া বা স্থূলতা হার্ট অ্যাটাকের একটি কারণ।
(৭) অধিক হারে চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করলে এবং শাকসবজি ও আঁশ জাতীয় খাবার কম খেলে।
(৮) অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা অশান্তির ফলে।
(৯) জন্মনিয়ন্ত্রক পিল বা অন্য কোন হরমোন নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ সেবনের ফলে।
চিকিৎসা
- হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় রোগীকে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এরকম ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার পূর্বে কিংবা নেওয়ার মধ্যবর্তী রাস্তায় পর্যাপ্ত পরিমানে আলো বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে। রোগীর জিহবার নিচে একটি নাইট্রেট (Nitrate) ট্যাবলেট দিতে হবে।
- হাসপাতাল নির্বাচনের ক্ষেত্রে, হৃদরোগের চিকিৎসা সুবিধা সংবলিত হাসপাতাল হলে উত্তম।
- হাসপাতালে নেবার পর চিকিৎসক প্রয়োজন অনুসারে চিকিৎসা শুরু করবেন। চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে রোগীর ECG করতে হতে পারে, অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে আবার ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড (intravenous fluids) কিংবা নাইট্রোগ্লিসারিন (Nitroglycerin) দিতে পারেন।
- প্রথমে এনজিওগ্রাম (Angiogram) করে ব্লকের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে। যদি ব্লক বেশি হয় এবং ওষুধে সমাধান হবে না বলে মনে হয়, তবে এনজিওপ্লাস্টি (Angioplasty) করতে হতে পারে। এক্ষেত্রে সার্জন ছোট হয়ে যাওয়া ধমনিতে প্রয়োজন অনুসারে কয়েকটি মাইক্রো রিং (Micro Ring) পরিয়ে দিবেন।
- এরপরেও আবার হার্ট অ্যাটাক হলে, চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে ওপেন হার্ট সার্জারি বা বাইপাস (Bypass) সার্জারি করতে পারেন।
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম
হার্ট অ্যাটাক মানে হলো হার্টের পেশির অংশ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া। যদি হার্টের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, চিকিৎসা হওয়ার পর সে সুস্থ হয়ে উঠলেও ওই অংশটুকু কিন্তু নিরাময় হবে না। সুতরাং প্রতিরোধ করাটা সর্বোত্তম পদ্ধতি এবং আমাদের মতো গরিব দেশে তো এটা অবশ্যই দরকার। তাই এর থেকে পরিত্রাণ পেতে কিছু জিনিস অবশ্যই মেনে চলা উচিৎ যেমন-
১) মানসিক অবসাদ বা দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
২) নিয়মিত ব্লাড প্রেসার পরিমাপের মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৩) নিয়মিতভাবে ডায়াবেটিস পরীক্ষা এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৪) ধুমপান, মদ্যপান ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫) মোটা হওয়া বা স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৬) চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া কমাতে হবে এবং রক্তে কোলেস্টোরলের মাত্রা কমাতে হবে।
৭) শাকসবজি ও ফল বেশি করে খেতে হবে।
8) প্রতিদিন নিয়মিতভাবে হাঁটা, দৌড়ানো কিংবা যেকোন শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে।
৯) চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে বা প্রয়োজনে বন্ধ করতে হবে।
কথায় আছে , রোগ বালাই বলে কয়ে আসে না। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। যেকোনো অসুখ মারাত্মক আকার ধারণ করার আগে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই সেসব উপসর্গকে গুরুত্ব সহকারে দেখি না। ফলে সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়ানো যায় না। অথচ সামান্য একটু সচেতনতাই পারে যেকোনো অসুখ প্রকট আকার ধারণ করার আগে আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে। তাই সুস্থ থাকতে বছরে অন্তত একবার, সম্ভব হলে দুইবার সমগ্র দেহ চেকআপের ব্যবস্থা করুন এবং বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই (BMI) মেনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলার চেষ্টা করুন।
ছবি- সংগৃহীত: ইউপি.কম