বর্তমান যুগটাকে আধুনিক যুগ বলার পাশাপাশি রোগ আর ওষুধের যুগ বললে ভুল হয় না। বছরে ৩০টা করে নতুন ধরনের রোগ আবিষ্কৃত হচ্ছে, আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামছে অসংখ্য ওষুধ। ফলে আমাদের মধ্যে যতটা বাড়ছে রোগের ভয় ঠিক ততটাই বাড়ছে ওষুধ ভীতি। আমাদের আশেপাশের এমন অনেককেই আমরা আক্ষেপ করে বলতে শুনি, “রোগের চেয়ে রোগের ওষুধই আমায় শেষ করে দিল” অনেকে আবার বিকল্প ওষুধের সন্ধানে ঘুরছেন। আমাদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা হাইপ্রেশার বা উচ্চরক্তচাপ থাকলে পুরুষ বা নারীর শরীরে যে লক্ষণগুলো দেখা দেবে তা হল –
- মাথা ধরা
- চোখজ্বালা
- মাথা ঘোরা
- বুক ধড়ফড় করা
- নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ
- শিরা ছিড়ে যাওয়া; যার প্রকাশ হবে মুখের রক্তিমাভায়
এমনি আরও কত কী। কিন্তু এই ধারণাগুলোর বিশেষ কোন ভিত্তি নেই। এগুলো হল অনিয়মের কারণে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যার উপসর্গ মাত্র। তাই এই কারণের ওপর ভিত্তি করে প্রেশার ধরা পড়ে কদাচিৎ।
আমাদের অধিকাংশ রোগীর উচ্চরক্তচাপ ধরা পড়ে নিতান্তই আকস্মিকভাবে – হয়ত বিশেষ কোনো কারণে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রেশার মাপতে গিয়ে ব্যাপারটা ধরা পড়ল; কিংবা অন্য কোন রোগের চিকিৎসার জন্য প্রেশার মাপতে যেয়ে চমকে উঠতে হল; অথবা জীবনবীমা করাতে গিয়ে ফিজিক্যাল টেস্টে বেরিয়ে এল উচ্চরক্তচাপের করুন কাহিনী। এছাড়া অনেক রোগীরই উচ্চরক্তচাপ ধরা পড়ে বুকের ব্যথা, হৃদরোগ কিংবা কিডনির সমস্যা উৎপন্ন হলে।
আপনার প্রেশার যদি অস্বাভাবিক রকম উচ্চ পর্যায়ে না পৌঁছে যায়, তাহলে বিকল্প ওষুধের চিকিৎসায় চমৎকার সাড়া মিলবে। বিকল্প ওষুধের চেষ্টাটা হল যৎসামান্য ওষুধ প্রয়োগে সমস্যাকে বাগে আনা। এতে করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সমস্যাও হয় না। যেহেতু উচ্চরক্তচাপ সমস্যায় সারা জীবনই ওষুধ খেয়ে যেতে হতে পারে, তাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটাও একই সঙ্গে যথেষ্ট চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্যাগুলো এড়ানোর জন্যই মেনে চলতে হবে কিছু বিধি নিষেধ।
১. জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলুন। সর্বদা ঘড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়নোর দরকার নেই; অমুক কাজ এই সময়ের মধ্যেই যে করে হোক শেষ করতে হবে এমন ধরাবাঁধা পণ না করাই ভালো। অফিসকে বাড়িতে বয়ে নিয়ে আসা চলবে না। দিনের কিছুটা অংশ, বোধ করি সপ্তাহে একটা দিন অন্তত পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান-পরিবারকে দিন, তাতে শরীর-মন কিছুটা শান্তি পাবে।
২. অবাক করা হলেও সত্য যে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যারা খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেশি মুটিয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব বেড়ে যাওয়ার কারণে মানসিক চাপ থেকে প্রেশার এর সমস্যা সৃষ্টি হয়। অতএব অতিরিক্ত মেদ থাকলে ঝরিয়ে ফেলুন, লবণ খাওয়া কমিয়ে দিন একেবারে।
৩. প্রতিদিন নিয়ম করে অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম অথবা যোগাসন করুন। হালকা ব্যায়াম ও যোগাসনে যে রক্তচাপ কমে এটা প্রমাণিত সত্য। না পারলে ছাদে হালকা পায়চারি করুন।
৪. যেসব ব্যায়ামে একই প্রক্রিয়ার ক্রমিক আবর্তন হয় একটি নিয়মিত গতিতে, তাতে রক্তচাপ কমানোর কাজ হয়। যেমন হাঁটা, জগিং বা মৃদু দৌড়, সাঁতার কাটা, সাইকেলে চড়া ইত্যাদি। তবে অতিরিক্ত ব্যায়াম কখনই চলবে না। তাছাড়া বয়স এবং শরীরের সক্ষমতার উপর বিবেচনা করে ব্যায়াম বা যোগের আসন নির্বাচন করতে হবে।
৫. উচ্চ রক্তচাপে যোগের কার্যকারিতা অসাধারণ। শবাসন, পদ্মাসন, বজ্রাসন, যোগমুদ্রা, ধনুরাসন, পশ্চিমোত্থানাসন, কোণাসন, মৎস্যাসন ইত্যাদির সুপ্রয়োগে সুফল পাওয়া যাবে।
এর মধ্যে সাজগোজের ফিটনেস সেকশনে যোগাভ্যাসের নিয়মকানুনসহ কিছু যোগাসনের পদ্ধতি সম্পর্কে দেওয়া আছে। সেগুলো রপ্ত করতে পারলে অনেকখানি উপকার হবে।
৬. একজন ডায়াবেটিসের রোগীর জীবনে ওষুধ পথ্যের গুরুত্ব যেমন, প্রেশারের রোগীর জন্য ও পথ্যের গুরুত্ব ততখানি। হাই প্রেশার আছে যাদের, সেটি মোকাবেলা করার জন্য যে আহার ব্যাবস্থা হবে তাতে শর্করার ভাগ হবে কম, তৈলাক্ত খাবারও যৎসামান্য পরিমাণে, লবণের ভাগও হবে সামান্য এবং ক্যালোরির মাপও হতে হবে নিম্নমানের। ফাইবার যুক্ত খাবার এক্ষেত্রে শরীরের শক্তির চাহিদা পূরণ করবে। এছাড়া ৩৫ বছর হয়ে যাবার পর নারী পুরুষ উভয়েরই ক্যালসিয়াম ও পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার বা সাপ্লিমেনট গ্রহণ করা উচিত।
৭. অতিসত্বর ধূমপান পরিহার করুন। তামাক যে শরীরে হাইপার টেনশন, ব্লাড সার্কুলেশনের হেরফের এর জন্য দায়ী তা নিয়ে কোন মতান্তর নেই। এগুলো প্রেশারের সঙ্গে মিলিত হয়ে হার্ট ও কিডনির সর্বনাশ করে। ফলে যে ব্যাক্তি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এতটুকুও উৎসাহী, ধূমপান তাকে পরিত্যাগ করতেই হবে।
৮. টেনশন দূরে রাখার চেষ্টা করুন। দিন শেষে বাড়ি ফিরে ক্লান্তি দূর করার জন্য গোসলের পানিতে কয়েক ফোঁটা গোলাপজল ও লেবুর রস মিশিয়ে নিন। নিমিষেই সারাদিনের ধকল ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
৯. হাঁটা হচ্ছে সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যায়াম। নিয়মিত হাঁটলে ব্লাড প্রেসার কমে, হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমে, অতিরিক্ত ক্যালোরি কমিয়ে দেয়, এনার্জি বাড়ায়। হাঁটা শুরু করার আগে আর হাঁটা শেষে প্রচুর পানি খাবেন। শরীরের টক্সিন বের করে দিতে সাহায্য করবে এটি। তবে ভারি খাবার খেয়ে হাঁটবেন না।
১০. যদি মনের অবস্থার ঘন ঘন তারতম্য হয়, সহজেই মাথা ধরে যায়, ব্যায়াম করেও ভালো ফল না পান তা হলে বুঝবেন আপনার শরীরে ক্রোমিয়ামের অভাব রয়েছে। ক্রোমিয়াম প্রেসার কন্ট্রোলে রাখতে সাহায্য করে, ধমনী আর ব্লাড ভেসেলে প্লাক গড়ে ওঠা আটকায়, ক্ষত সারিয়ে তোলে, মাড়ি সুস্থ রাখে। কিসে আছে ক্রোমিয়াম? সামুদ্রিক মাছ, মাশরুম, পালং শাক, আঙ্গুর, কিসমিস, আপেল, ব্রকলি, ডিম, গুড় এসব খাবারে। তবে মনে রাখতে হবে আইসক্রিম, সফট ড্রিংক, মিষ্টি শরীরে ক্রোমিয়াম এর পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
ছবিঃ সংগৃহীত – cloudinary.com