কপালে হালকা ভাঁজ, কখনো বা গালে হাত কিংবা উদাস মনে একদিকে তাকিয়ে থাকা; একরকম মূহুর্ত আমাদের প্রত্যেকের জীবনে খুব কমন, তাই না? কেমন যেন চিন্তার জগতে প্রবেশ করে হারিয়ে যাই! এই সাধারণ চিন্তা ভাবনা থেকে মানুষ কখন যে বিষণ্নতা আর দুশ্চিন্তার অতলে ডুবে যায়, সেটা সে টেরই পায় না। আর সূত্রপাত হয় বিভিন্ন মানসিক সমস্যার। অবাক হলেন নাকি? অবাক হওয়ার কিছু নেই! আমরা সাধারণ মানুষ শারীরিক সুস্থতাকে যতটা গুরুত্ব দেই, ততটাই অগ্রাহ্য করি মানসিকভাবে সুস্থ্ থাকার বিষয়টি। বিষণ্ণতা আর দুশ্চিন্তা আপনার জীবনে কতটুকু ক্ষতি করতে পারে সেটা জানেন কি? এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী, সেটাও কিন্তু আমাদের জেনে নিতে হবে।
বিষণ্ণতা আর দুশ্চিন্তা কেন নীরব ঘাতক?
বিষণ্নতা বা উদাসীনতা আর দুশ্চিন্তা, দুইটি শব্দ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছোট্ট একটু উদাহরণ দেই, যখন আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে যাই, স্বাভাবিকভাবেই বলে বসি ‘Bored হয়ে গেলাম’’, তাই না? যখন কাজে মন বসে না, তারপরও কাজটি চালিয়ে যেতে হয় আমরা হয়ে যাই বিষণ্ন। এখন এই কাজটি যদি প্রতিদিনই ঘটে আপনার সাথে, তখন মনের যে স্বাভাবিক অবস্থা সেটাতে কিন্তু বিঘ্ন ঘটবে। যেকোনো কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। সেই সাথে শরীরের উপরও পড়বে বিরুপ প্রতিক্রিয়া। কখনো কখনো এটি আপনাকে ডিপ্রেশনের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় টেনশন করা হচ্ছে দুশ্চিন্তা। গবেষণায় দেখা দিয়েছে এই ধরনের মেন্টাল কন্ডিশন আপনার লাইফ স্প্যান বা আয়ুষ্কাল কমিয়ে দেয়।
যেসব কারণে সচরাচর আমরা বিষণ্ণতায় ভুগি
১. দীর্ঘদিন ধরে একই ধরণের কাজ করা, কাজে নতুনত্ব না থাকা
২. দিনের পর দিন অলসভাবে সময় কাটানো
৩. পরিবার এবং বন্ধুদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা
৪. ফিউচার প্ল্যান না থাকা
৫. পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম না নেওয়া এবং পুষ্টিকর খাবার না খাওয়া
৬. সময়কে কাজে না লাগানো
৭. সবকিছুতেই কনফিউসড থাকা
আপনার জীবনে এটা কীভাবে ক্ষতি করছে?
মাঝে মধ্যে কোনো কারণে বিষণ্ণভাব আসাটা স্বাভাবিক! কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় এবং দীর্ঘদিনের বিষণ্ণতা মানবদেহে ট্রিগার পয়েন্ট হিসাবে কাজ করে এবং বিভিন্ন সমস্যার সূত্রপাত হয়।
১) অতিরিক্ত বিষণ্ণতা মানুষকে বিপথেও নিয়ে যেতে পারে, যেমন সিগারেট ও অ্যালকোহলে আসক্তি। এই কাজটি উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের মাঝে বেশি লক্ষ্য করা যায়। এতে করে একজন সুস্থ সবল মানুষও শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙে পরে। তখন দেখা যায় যে নিজের প্রতি আর কন্ট্রোল থাকছে না, একটুতেই ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছেন অথবা হুট করেই রেগে যাচ্ছে।
২) ‘Substance Abuse’ শব্দটি কি নতুন শুনলেন? এটি একটি মেডিকেল টার্ম, যেটা বিভিন্ন ড্রাগ বা যেগুলো শরীরের ক্ষতিসাধন করে সেগুলোর প্রতি আসক্ত হওয়াকে বুঝায়। Boredom এবং Substance Abuse এই দুইটি বিষয় বিভিন্নভাবে সম্পর্কিত। মানুষ আনন্দ পেতে বা এক্সপেরিয়েন্সের জন্য প্রথমবারের মত অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ বা নিষিদ্ধ জিনিস ট্রাই করে, তাদের মধ্যে এই abuse এর প্রবণতা দেখা যায়। পরে মানুষ যখন উদাসীনতায় ভোগে, তখন তার মধ্যে ঐ জিনিসের প্রতি নির্ভরতা বা আসক্তি কাজ করে। এভাবেই একজন বিষণ্ণ ব্যক্তি ড্রাগ অ্যাডিক্টেড হয়ে যেতে পারে।
৩) কখনো এমনটা লক্ষ্য করেছেন, কেউ উদাসীনভাবে খেয়েই যাচ্ছে! সে নিজেও জানে না, কখন সে প্রয়োজনের অধিক খেয়ে ফেলছে!! একটি ডিসঅর্ডার যেটাকে বলা হয় Binge Eating Disorder। অতিরিক্ত উদাসীনতায় কিছু মানুষ এমন করে, বিশ্বে প্রায় ২% মানুষের সাথে এমনটি ঘটে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা আর বিষণ্ণতা মানুষকে এই ডিসঅর্ডার এর দিকে অগ্রসর করে।
কীভাবে বিষণ্ণতাকে প্রতিহত করবেন?
১) সকালে উঠেই চেষ্টা করবেন বাইরে মুক্ত আলো বাতাসে ৩০ মিনিট হাঁটার। এতে সারাদিন ফ্রেশ ফিল করবেন, দেখবেন বিষণ্ণতা আপনাকে তেমন কাবু করতে পারবে না। এর পাশাপাশি মেডিটেশন বা ইয়োগা করতে পারেন। স্ট্রেস রিলিফের জন্য ইয়োগা বেশ কার্যকরী।
২) আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কাজের রুটিনে পরিবর্তন আনা। ব্যস্ততার মাঝে একটু সময় বের করুন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য। ছুটির দিনে পরিবার বা বন্ধুদের সাথে সময় কাটান। নিজের কথাগুলো শেয়ার করুন, ভালো লাগবে।
৩) আর যারা বাসায় অলসভাবে দিন কাটাচ্ছেন, তাদের উচিত আগে নিজেকে স্টাডি করা, কোন কাজটি পছন্দ সেটা বুঝতে চেষ্টা করুন। গার্ডেনিং করতে পারেন, টুকিটাকি ক্রাফটস এর কাজও কিন্তু মন্দ না। অথবা ট্রাই করতে পারেন নিত্যনতুন রেসিপি।
৪) সময়ের মূল্য দিতে শিখুন, নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন, ফিউচার প্ল্যান সেট করে সেদিকে এগিয়ে যান। আর দিনের প্রত্যেকটি ভাগকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। সময়মত বিশ্রাম নিন, হেলদি লাইফস্টাইল মেনে চলুন।
চিন্তা আর দুশ্চিন্তা, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
জীবনের বিভিন্ন সিচুয়েশনের প্রতি ভয় বা চিন্তার যে প্রতিফলন সেটা হলো Anxiety বা দুশ্চিন্তা। এটা আমাদের জীবনের একটি অংশ। চিন্তা হওয়াটা খুবই নরমাল, আমাদের সবারই হয়। ছোটখাটো বিভিন্ন চিন্তা যখন বড় আকার ধারণ করে, সেটা মানসিকভাবে আপনাকে অশান্তিতে রাখে, আর তখনই আপনি চলে যান ডিপ্রেশনে! দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মানুষ হাইপার টেনশন, মেমোরি লস, মাথা ব্যথা এমন অনেক সমস্যায় ভোগেন।
কীভাবে বুঝবেন আপনি দুশ্চিন্তাগ্রস্থ?
১. যেকোনো কিছুতে নার্ভাস ফিল করা
২. আত্মবিশ্বাসের অভাব
৩. কাজে মনোযোগের অভাব
৪. হুটহাট ঘাবড়ে যাওয়া এবং হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, বুকে ব্যথা করা
৫. শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া
৬. অপর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম, রাতে ঘুম না আসা
৭. কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
৮. মানসিকভাবে অস্বস্তিতে থাকা
বিষণ্নতা আর দুশ্চিন্তা কীভাবে ক্ষতি করছে?
আপনি যখন অতিরিক্ত চিন্তা করেন, তখন আপনার ব্রেইন সঠিকভাবে পরিচালনা করতে না পেরে বিভিন্ন ধরনের ফ্রি রেডিক্যাল আর স্ট্রেস হরমোন রিলিজ করে। অনেক সময় দেখা যায় আপনি বাইরে থেকে স্বভাবে খুবই শান্ত কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচুর চিন্তা করেন! যেটি অত্যন্ত ক্ষতিকর আপনার শরীরের জন্যও। যত স্ট্রেস হরমোন রিলিজ হবে, ততটাই আপনি শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।
জব চলে গেছে কিংবা ভালো জব পাচ্ছেন না! শুরু করলেন চিন্তা। একদিন, দুইদিন এমন করে প্রতিদিন! কয়দিন পরে দেখলেন রাতে ঘুম আসছে না, এবার হলো ইনসমনিয়া। তারপর লক্ষ্য করলেন বুকে হালকা ব্যথা, ধরা পরলো হাই প্রেশার! এরপর নিজের প্রতি অবহেলা, শুরু হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবন। সেখান থেকে ডায়াবেটিস আর মানসিক অশান্তি তো আছেই। উদাহরণ হলেও এখনকার সময়ে এটা অনেকেই ফেইস করছেন। দুশ্চিন্তা আপনাকে এভাবেই শেষ করে দিচ্ছে দিনের পর দিন! তাহলে বুঝলেন তো, বিষণ্নতা আর দুশ্চিন্তা আপনার জীবনে কতটুকু ক্ষতি করতে পারে।
তাহলে কী করা উচিত আমাদের?
১) মন খুলে হাসুন, নিজেকে ভালোবাসুন। সেই কাজটি করুন যেটা আপনাকে আনন্দ দেয়। বিষণ্নতা আর দুশ্চিন্তা সেই মানুষকে কম অ্যাটাক করে যে নিজেকে ভালোবাসে।
২) ‘শেয়ারিং’ এটা খুবই কমন একটি টার্ম হলে অনেকেই সেটা করতে নারাজ। মন খুলে কথা বলুন, নিজেরই হালকা লাগবে।
৩) কে কী বলবে এটা মূখ্য না, আসল বিষয় হচ্ছে আপনার ভালো থাকা। সামাজিক জীব হিসাবে কিছু দায়বদ্ধতা তো আমাদের আছেই। নিয়মের মধ্যে থেকে নিজের জীবনে পজেটিভ চেঞ্জ আনুন।
৪) ঘুমের রুটিনে অবহেলা করবেন না। দৈনিক আট ঘন্টা ঘুমাতে চেষ্টা করুন। কেননা আপনি যখন ঘুমাবেন, ব্রেইনও রেস্ট পাবে। এতে আপনার কর্মউদ্দীপনা বাড়বে এবং মানসিক অশান্তি কিছুটা হলেও কমবে।
৫) প্রতিদিন শরীরচর্চার পাশাপাশি ধর্মীয় কাজগুলোও মেনে চলুন। এতে দুশ্চিন্তা গ্রাস করবে না, মানসিকভাবে সবল থাকবেন।
৬) আর মানসিক অস্থিরতা থেকে যদি ডিপ্রেশনে চলে যান, তাহলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করুন। কাউন্সেলিংয়েও অনেক সমস্যার সমাধান হয়।
ছোট্ট একটি ঘরোয়া টিপস শেয়ার করছি, বিষণ্নতা আর দুশ্চিন্তা কমাতে ট্রাই করতে পারেন। হালকা কুসুম গরম পানিতে পা ভিজিয়ে রাখুন। সাথে সফট মিউজিক বা আপনার পছন্দের গান প্লে করতে পারেন। চোখ বন্ধ করে পুরানো ভালো স্মৃতি মনে করুন। দেখবেন সাথে সাথেই রিলাক্স ফিল করছেন।
বিষণ্নতা আর দুশ্চিন্তা কমাতে কী কী করা যেতে পারে, সেগুলো আজ আমরা জানলাম। আপনি যখন মানসিকভাবে ভালো থাকবেন, তখন আপনার শারীরিক সুস্থতাও নিশ্চিত হবে। আর প্রফুল্ল মন আপনার কাজের অগ্রগতি বাড়ায়। তবে এটা ঠিক যে বিষণ্নতা আর দুশ্চিন্তাও জীবনের অংশ! জীবন তো একটাই, তাহলে কেন নিজের প্রতি অবহেলা করবেন? নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন।
ফার্সি কবি জালালউদ্দিন রুমি বলেছিলেন….“মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত যা কিছু আছে তাই বিষ”। তাই চিন্তা করুন পরিমিতভাবে, অতিরিক্ত নয়। আজ এই পর্যন্তই, সবাই ভালো থাকবেন।
ছবি- সাটারস্টক