একটি পরিবারের জন্য গর্ভাবস্থা হল আনন্দ এবং প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ এক অসাধারন যাত্রা। তবে এই যাত্রা যাতে নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে পাড়ি দেয়া যায় সে জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়। এই ধরনের একটি ঝুঁকিপূর্ণ রোগ হল রুবেলা। গর্ভাবস্থায় রুবেলা আক্রান্ত হলে গুরুতর পরিণতি হতে পারে। গর্ভবতী মহিলা ও তার বিকাশমান শিশুর জন্য রুবেলা খুবই বিপজ্জনক। রুবেলার বিরুদ্ধে টিকা না দেওয়া যে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
রুবেলা কী?
রুবেলা, সাধারণত জার্মান হাম নামে পরিচিত। রুবেলা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি ভাইরাল সংক্রমণ রোগ। যদিও এটি সাধারণত শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে হালকা হাঁচি-কাশির লক্ষণযুক্ত অসুস্থতা হিসেবে প্রকাশ পায়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। অনেকটা কোভিডের মতোই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশির ড্রপলেট থেকে রুবেলা ছড়ায়।
এটি যদিও খুব জটিল রোগ নয় তবে কোনো মা গর্ভাবস্থায় রুবেলা আক্রান্ত হলে এর পরিণতি শিশুর জন্য ভয়াবহ হতে পারে। সাধারনত গর্ভাবস্থায় প্রথম ১২ সপ্তাহের মধ্যে রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এর সংক্রমণ সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি করে। এছাড়া শিশুরা আক্রান্ত হলে এটি তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
রুবেলার লক্ষণ
- সংক্রমনের ফলে শরীরে লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি দেখা দেয়।
- মাথা এবং ঘাড়ের চারপাশের গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে।
- উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর থাকতে পারে।
- হাঁচি-কাশি এবং সেই সাথে সর্দির সমস্যা থাকতে পারে।
- শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা থাকতে পারে। বিশেষ করে আঙ্গুল, কব্জি বা হাঁটুতে ব্যাথা।
- চোখ-মুখ ফুলে যাওয়া, চোখ চুলকানো, চোখ লাল হয়ে যাওয়া।
কনজেনিটাল রুবেলা সিনড্রোম
গর্ভবতী মায়েরা গর্ভের প্রথম তিন মাসে রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে মা থেকে গর্ভের শিশু আক্রান্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে গর্ভপাত, এমনকি গর্ভের শিশুর মৃত্যু হতে পারে অথবা গর্ভজনিত বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে শিশু জন্ম গ্রহণ করে, যা কনজেনিটাল রুবেলা সিনড্রোম নামে পরিচিত। যার পরিণতি আজীবন শিশুকে বয়ে বেড়াতে হয়। রুবেলা ভাইরাস গর্ভস্থ শিশুর প্রায় সবকিছুকে প্রভাবিত করে।
কনজেনিটাল রুবেলা সিন্ড্রোমের এর কিছু সাধারন উদাহরণ হল-
- বধিরতা বা কানে শুনতে না পাওয়া।
- চোখে ছানি।
- বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা।
- হার্টের ত্রুটি।
- ত্রুটিযুক্ত লিভার এবং প্লীহা।
- জন্মগত কম ওজন।
- জন্মের সময় ত্বকে র্যাশ।
- এছাড়াও গ্লুকোমা, ব্রেইন ড্যামেজ, থাইরয়েড এবং অন্যান্য হরমোনের সমস্যা, ফুসফুসের প্রদাহ ইত্যাদি সমস্যাও জন্মগতভাবে দেখা দেয়।
নির্দিষ্ট লক্ষণগুলোর চিকিৎসা করা গেলেও কনজেনিটাল রুবেলা সিনড্রোমের কোনো প্রতিকার নেই। তাই এই বিধ্বংসী রোগ থেকে বাঁচতে গর্ভধারনের আগেই প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
রুবেলা প্রতিরোধের উপায়
গর্ভাবস্থায় রুবেলা থেকে রক্ষা পাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হল ভ্যাকসিন। হাম, মাম্পস ও রুবেলা (এমএমআর) ভ্যাকসিন রুবেলা সংক্রমণ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। এই ভ্যাকসিন লাইভ/জীবিত ভাইরাস থেকে তৈরি করা হয় বিধায় গর্ভাবস্থায় কোনোভাবেই এটি দেয়া হয় না, গর্ভধারনের আগেই এই ভ্যাকসিন নিয়ে রাখতে হয়। গর্ভধারনের আগেই এই ভ্যাকসিন নিলে মায়ের শরীরে একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরী হয় যাকে হার্ড ইমিউনিটি বলে। এই ভ্যাকসিন রুবেলা ভাইরাস কে আশেপাশে ছড়াতে দেয় না। তাই সন্তান জন্মদানের বয়সের মহিলা এবং পুরুষ উভয়ের জন্যই তাদের MMR ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও গর্ভবতী হওয়ার পরিকল্পনা করছেন এমন মহিলাদের গর্ভধারণের আগে MMR ভ্যাকসিন নেওয়ার পর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার জন্য অন্তত এক মাস অপেক্ষা করা উচিত।
গর্ভাবস্থায় রুবেলা হলে কী করবেন?
একজন গর্ভবতী মা রুবেলা আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে গেলে বা তার নিজের রুবেলা আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে অতি দ্রুত চিকিৎসা সেবা প্রয়োজন হয়। ল্যাবরেটরি টেস্ট এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হয়। গর্ভাবস্থায় রুবেলা আক্রান্ত হলে সাধারনত যে পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে, তা হল-
আইসোলেশন
সংক্রমিত গর্ভবতী মা থেকে যেন আশেপাশে রুবেলা আরো না ছড়ায় সে জন্য তাদের আইসোলেশনে রাখতে হবে। পরিবারের শিশু ও বয়স্ক সদস্যদের থেকেও নিরাপদ দূরত্ব মেনে চলতে হবে।
উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা
যখন যে উপসর্গ দেখা যাবে সাথে সাথে সেই উপসর্গের চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজন মত বিশ্রাম এবং খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
গর্ভস্থ শিশুর পর্যবেক্ষন
গর্ভের শিশুর বিকাশ ঠিকমত হচ্ছে কি না তা নির্ণয়ের জন্য নিয়মিত আলট্রাসনোগ্রাফি করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে
সংক্রমণের তীব্রতার উপর নির্ভর করে, গর্ভবতী মহিলাদের ব্যাপক যত্ন প্রদানের জন্য প্রসূতি বিশেষজ্ঞ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞের মতো বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের প্রয়োজন হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস সংক্রমণ মা এবং অনাগত সন্তান উভয়ের জন্যই বিধ্বংসী পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সৌভাগ্যবশত, এটি এমন এক রোগ যা টিকা দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। সন্তান ধারনে সক্ষম যে কোন নারীর রুবেলার ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা এবং আক্রান্ত হলে সাথে সাথে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া মা ও গর্ভস্থ শিশুর ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। সঠিক সময়ে সঠিক সচেতনতা অবলম্বনের মাধ্যমে রুবেলার মত অনেক ঝুকিপুর্ণ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ছবিঃ সাটারস্টক।