খুব জরুরী একটা কল করতে হবে, কিন্তু বাচ্চার হাত থেকে কোনোভাবেই ফোনটা নেয়া যাচ্ছে না! যতই তাকে বুঝাচ্ছেন বা আদর করে বলছেন। কিন্তু না! তার হুটহাট জেদ এবং একরোখা স্বভাব এর কাছে শেষমেশ আপনাকেই হার মানতে হচ্ছে। শুধু কি ফোনের ক্ষেত্রে? অনেক সময় আবার এমন হয়, পরিবারের সবাই মিলে কোথাও গিয়েছেন; সেটি হতে পারে কোনো দাওয়াতে বা শপিংয়ে। এর মাঝে হুটহাট আপনার বাচ্চাটি হাত পা ছুড়ে কান্নাকাটি করে একদম অস্থির! সে কিছু একটা চাচ্ছে যা তার তখনই লাগবে। এসময় বাবা-মা উভয়কেই পড়তে হয় অস্বস্তিকর পরিবেশে! বাচ্চাদের এই একরোখা স্বভাব কন্ট্রোল করতে অনেক বাবা-মাকেই হিমশিম খেতে হয়। এমন সিচুয়েশন আপনারা অনেকেই ফেইস করেছেন, তাই না?
বাচ্চাকে শান্ত করতে, তাৎক্ষণিক তার অহেতুক অযথা সব আবদার মেনে নেয়াটাকেই শ্রেয় বলে মনে করেন অনেক বাবা-মা। হয়তো আপনিও সেটাই করছেন! কিন্তু বাচ্চাদের এমন সব হুটহাট জেদ এবং একরোখা স্বভাব মেনে না নিয়ে যদি সুস্থভাবে এমন সিচুয়েশনগুলো সামাল দেয়া যায়, তবে কেমন হয় বলুন তো? প্যারেন্টিংকে একটু সহজ আর স্বাভাবিক করতেই আমাদের আজকের লেখা। চলুন জেনে নেয়া যাক, শিশুর জেদ সামলাতে আমাদের করণীয়গুলো কী হতে পারে সেটা নিয়ে।
শিশুর জেদ কীভাবে সামলাবেন?
বাচ্চাদের হুটহাট জেদ এবং একরোখা স্বভাব কন্ট্রোল করতে নির্দিষ্ট কোন কুইক ফিক্স সল্যুশন আসলে নেই! তবে ঠিক সেই সময় কীভাবে রিঅ্যাক্ট করলে সিচুয়েশন অনেকটাই আমাদের আয়ত্তে থাকবে তা কিন্তু আমরা নির্ধারণ করতে পারি। তবে ঠিক সেই সময়টাতে পরিস্থিতি সামাল দেয়া থেকে যদি বাবা-মা আগেই প্রস্তুতি নেয়, সেটা হতে পারে আরও বেশি কার্যকরী। সহজভাবে বোঝার জন্যে বাচ্চাদের জেদ এবং একরোখা স্বভাব কন্ট্রোলের সিচুয়েশনকে আমরা দু’টি পর্যায়ে ভাগ করে নিতে পারি।
১) তাৎক্ষণিক সমাধান
২) আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ
এখন জেনে নিন, বাচ্চারা যখন হুটহাট জেদ কিংবা রাগ করে তখন সাথে সাথে কী করলে সহজেই সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে।
তাৎক্ষণিক সমাধান
তাৎক্ষণিক সমাধান অর্থাৎ ঠিক যেই মুহূর্তে রাগ বা জেদ করছে, সেই সময় আসলে প্যারেন্টদের করণীয় কী? এমন সময় বাচ্চারা এই মুহূর্তেই কিছু একটা লাগবে অথবা কিছু একটা চেয়ে হাত পা ছুড়ে কান্নাকাটি করতে থাকে। বাবা-মায়ের উচিত এমন সময় না ঘাবড়িয়ে কিছু প্যারেন্টিং স্কিল কাজে লাগানো। কী হতে পারে সেই প্যারেন্টিং স্কিলগুলো? চলুন জেনে নেয়া যাক।
১) ইগনোর বা উপেক্ষা করুন
প্রথমেই, বাবা অথবা মা হিসেবে আমাদের যে বিষয়টি নিজেদের আগে আয়ত্তে আনতে হবে সেটা হলো, সন্তানের অহেতুক বা অযথা আবদারগুলোকে ইগনোর করতে জানতে হবে। বাচ্চাদের সেই মুহূর্তে মেইন ফোকাসই থাকে বাবা-মায়ের অ্যাটেনশন আদায় করা। সে তখন বিশ্বাস করে এভাবে রাগ, জেদ করে রিঅ্যাক্ট করলে বাবা-মা তার কথা শুনতে বাধ্য। আর বাবা-মায়েরাও কিছুক্ষণ পরে এমন পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে ভয় পেয়ে যায়। মনে করেন, সন্তান কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে এবং কিছুক্ষণ পরেই সন্তানের অহেতুক আবদারগুলো মেনে নেয়। এতে সন্তানের মাথায় এ বিষয়টি ঢুকে যায় যে, আমি যা-ই চাই না কেন, এমন করে চাইলে বাবা-মা তা দিতে বাধ্য। সে কোনোভাবেই আর বুঝতে শেখে না যে, তার কোন আবদারগুলো সঠিক এবং কোন আবদারগুলো ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট।
তাই বাবা-মা হিসেবে আপনার কখনোই এ জিনিসটা সন্তানকে অনুভব করতে দেয়া যাবে না যে, বাচ্চা জেদ ও একরোখা ব্যবহার করলেই সে যা চাচ্ছে তা আপনি দিতে বাধ্য! কিন্তু এই ইগনোর বা উপেক্ষা বলতে কিন্তু এমন নয় যে আপনি বাচ্চাকে বুঝাবেন তাকে আপনি কেয়ার করেন না, সিরিয়াস নন বা উদাসীন। ইগনোর বা উপেক্ষা খুব টেকনিক্যালি করতে হবে। এজন্যেই একে আমরা প্যারেন্টিং স্কিল বলছি। চলুন জেনে নেই, সেগুলো কেমন হতে পারে?
বাচ্চার সাথে আই কনট্যাক্ট পুরোপুরি এড়িয়ে চলুন
বাচ্চাদের হুটহাট জেদ এবং একরোখা ব্যবহারের সময়টাতে আপনি বাচ্চার কাছাকাছি কোথাও কিছু একটা হাতে নিয়ে বসে পরতে পারেন। অথবা অন্য কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতে পারেন। বাচ্চা যতই অস্থিরতা করুক না কেন, প্যারেন্ট হিসেবে শুরুতেই মেনে নিন এমনটা হতেই পারে এবং ছোট বাচ্চা এমনটা করতেই পারে! এটি অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। শুধুমাত্র এই সময়ে বাবা-মা বাচ্চার সাথে আই কনট্যাক্ট পুরোপুরিভাবে অ্যাভোয়েড করবে। বাচ্চা সেই সময় যা-ই করুক সেটা যদি ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট কোনো চাওয়া হয়, তবে কোনো রকম আই কনট্যাক্ট না করে তার আশেপাশে থাকুন কিন্তু সে যা চাচ্ছে তা দেয়া যাবে না। এতে প্রথমত বাচ্চাটি বুঝতে পারবে সে জেদ করলেই তা তাকে দেয়া হবে না এবং পাশাপাশি সে এটাও বুঝবে যেহেতু আপনি তার আশেপাশে আছেন তার মানে, আপনি তার ব্যাপারে কেয়ারলেস নন!
স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড হয়ে মিনিমাম কমিউনিকেশন মেনটেইন করুন
আপনার বাচ্চা যখন একরোখা ব্যবহার করছে তখন তার পাশে থেকে তার সাথে আই কনট্যাক্ট না করলেও নূন্যতম কমিউনিকেশন মেইনটেইন করতে হবে। যেমন, বাচ্চাটি আপনার কাছে আপনার মোবাইল চাচ্ছে, তার তখনই লাগবে। সে সময় আপনি হাতে একটি বই বা নিউজ পেপার দেখতে দেখতে বলতে পারেন, “দেখো মা/বাবা আমি বুঝতে পারছি এ জিনিসটি তোমার খুবই প্রিয় এবং তুমি এটা চাচ্ছো। কিন্তু আমি খুবই সরি। এই মুহূর্তে এটি আমি তোমাকে দিতে পারছি না। একটু অপেক্ষা কর বা ১/২ ঘণ্টা পর আমি তোমাকে এটি দিবো” এবং এরপর পুরোপুরি আপনি অন্যদিকে আপনার মনোনিবেশ করুন। এতে বাচ্চা বুঝতে শিখবে তার এই আবদারটি করে আসলে এই মুহূর্তে তেমন একটা লাভ নেই। পাশাপাশি বাবা-মা বুঝতে পারছে যে তার এ জিনিসটি পছন্দের।
ধৈর্য নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করতে হবে
অনেক বাবা-মা ই যে ভুলটি করেন, বাচ্চাদের হুটহাট জেদ এবং একরোখা স্বভাব দেখলে হুট করে ক্ষেপে উঠেন, নিজেরাই রাগ করে সন্তানকে মারধোর শুরু করেন। এতে করে সন্তান ইমোশনাল ট্রমাতে চলে যায় অনেক সময়। আবার কিছু ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়। বাচ্চা আরও বেশি করে জেদ দেখাতে থাকে, যা আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য খুবই ভয়াবহ হতে পারে। সে এক সময় আপনার পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্যদের সাথেও রাগারাগি করতে পারে। আবার পরিবারের বাইরেও তার ইফেক্ট পড়তে পারে। তাই সন্তান যখন ছোট থাকে, তখন থেকেই সন্তানকে ধৈর্যের সাথে বড় করে তুলতে হবে।
এতে সন্তানের মানসিকতায় কেমন প্রভাব পড়বে?
বাবা অথবা মা যখন ধৈর্য নিয়ে এই সময়গুলো সামাল দিবে, এতে একটা সময় পর সন্তানের মাথায় কিছু জিনিস গেঁথে যাবে। যেমন,
- আমার বাবা-মা আমার নেগেটিভ জিনিসগুলোকে প্রায়োরিটি দিচ্ছে না
- আমি চাইলেই যেকোনো জিনিস সাথে সাথে পেয়ে যাবো বিষয়টি এমন নয়
- আমার বাবা-মা আমাকে জিনিসটা হয়তো এই মুহূর্তে দিচ্ছে না কিন্তু আমাকে গুরুত্ব দিচ্ছে
- চাইলেই কোনো জিনিস আমার সাথে সাথেই পেতে হবে বিষয়টি এমন নয়
- ধৈর্য ধরলে আমি যা চাচ্ছি পরে ঠিকই পাবো
- রাগ, জেদ না দেখিয়ে রিকোয়েস্ট করে চাইলে আমাকে সেটা দেয়া হবে
এখান থেকে আমরা কী বুঝতে পারি? হ্যাঁ! রাগ করে কথা বললে বা কড়া ভাষায় শাসন করলে হয়তো আমার সন্তানকে সেই সময়ের জন্যে চুপ করাতে পারতাম। কিন্তু আমার সন্তান কী আসলেও কিছু শিখতো? না! বাচ্চারা অনেক কিছুই আবদার করবে। ওরা এই বয়সে সবটা বোঝে না এবং বুঝবেও না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন সব ইভেন্টগুলো দিয়েই কিন্তু বাচ্চারা আস্তে আস্তে কোনটা উচিত এবং অনুচিত সেটা বুঝতে শেখে।
২) ডিস্ট্রাকশন বা অন্য দিকে মনোনিবেশ করা
ইগনোর বা উপেক্ষা করার স্কিল আয়ত্ত করতে বাবা-মাকে যতটা ব্রেইন খাটাতে হয়, ডিস্ট্রাকশন এর জন্য অতটা সময় দিতে হয় না। এটি মূলত বাচ্চার মনোনিবেশ অন্য কোনো দিকে পরিবর্তন করার একটি টেকনিক। যেমন, আপনার বাচ্চাটি শপিং মলে আরেকটি বাচ্চার হাতে একটি খেলনা দেখে তা নেওয়ার আবদার করলো। আপনি তখন পাশেই দেখতে পেলেন বাচ্চাদের একটি প্লে-জোন আছে। সাথে সাথে খুব আগ্রহ নিয়ে সেদিক তাকিয়ে বাচ্চাকে বলতে পারেন, “দেখো দেখো কত কিছু আছে ঐখানে খেলার জন্যে। তুমি যদি এখন লক্ষ্যি বাচ্চাদের মত আমার কথা শুনো, তাহলে তোমাকে সেখানে খেলতে নিয়ে যাবো।” এই টেকনিকটা ম্যাক্সিমাম বাচ্চাদের জন্যই খুব কাজে দিবে।
এইতো জেনে নিলাম বাচ্চাদের হুটহাট জেদ এবং একরোখা স্বভাব সামলানোর কার্যকরী দু’টি উপায়! ডিস্ট্রাকশন বা বাচ্চাদের অন্যদিকে মনোনিবেশ করার টেকনিকটা তুলনামূলকভাবে কম কষ্টের তবে সব বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটি কাজে নাও দিতে পারে। বাবা-মা হিসেবে আপনাকে প্রথমেই বুঝে নিতে হবে আপনার সন্তানের জন্য কার্যকরী টেকনিক কোনটি হবে। “ইগনোর বা উপেক্ষা” এই স্কিলটি মূলত বাবা-মায়ের জন্য জানা খুবই জরুরী। সন্তান হওয়ার আগে অথবা বাচ্চা ছোট থাকতে থাকতেই বাবা-মা যদি এসব ছোট ছোট ব্যাপারগুলো ধৈর্যের সাথে আয়ত্তে আনতে পারে তবে সেটা অবশ্যই বর্তমানের সাথে সাথে ভবিষ্যতের জন্যেও ফলপ্রসূ হবে। আশা করছি আজকের লেখাটি নতুন বাবা-মা আছেন বা যারা বাবা-মা হওয়ার জন্যে চিন্তা ভাবনা করছেন, তাদের জন্যে খুবই হেল্পফুল হবে। ভালো থাকবেন, হ্যাপি প্যারেন্টিং।
ছবি- সাজগোজ