পরিবারে নতুন সদস্যের আগমন সবসময়ই আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। কিন্তু বাচ্চা যত বড় হয়, বাবা মায়ের মনের ভিতরে নতুন ভয়ের জন্ম নেয়। আমার বাচ্চাটা সেইফ আছে তো, কোনো বিপদে পড়েনি তো! আমাদের চারপাশে কিছু বিকৃত মনমানসিকতার মানুষের জন্যই এই ভয়ের সূচনা। কেননা চাইল্ড অ্যাবিউজ একটি মারাত্মক ক্রাইম যেটি আমাদের চারপাশে অহরহ ঘটছে। অথচ আমাদের অনেকেরই এ ব্যাপারে ধারণাই নেই। বা জানলে হয়তো তেমন ভাবিও না। এরকম ঘটনা থেকে শিশুরা শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়, সেই সাথে তাদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াও ব্যাহত হয়। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আজকের বিষয় হলো চাইল্ড অ্যাবিউজ থেকে প্রতিকারের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা গুড টাচ ও ব্যাড টাচ নিয়ে। এ বিষয়টি নারী পুরুষ উভয়েরই জানা জরুরি।
গুড টাচ ও ব্যাড টাচ কী?
প্রত্যেক বাচ্চার জন্য এটি খুবই সাধারণ ও বেসিক একটি ম্যাসেজ। ভালো সংস্পর্শ মানে শিশু নিজেকে নিরাপদ ভাবে এবং ভালো বোধ করে। অপরপক্ষে খারাপ সংস্পর্শ প্রতিটি শিশুর জন্য ভীতিকর ও অস্বস্তিকর। সংস্পর্শ বাচ্চাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মাঝেমধ্যে তারা নিজেরাও বুঝতে পারে কোনটি ভালো এবং কোনটি খারাপ সংস্পর্শ। কেননা একদম কাছের মানুষ দ্বারা এই জঘন্য ঘটনার শিকার হতে পারে আপনার সন্তান। ধরুন, এক আত্মীয় প্রথম দুই তিনবার সাক্ষাতে আপনার বাচ্চাকে ভালোভাবে স্পর্শ করলো এবং তাকে কিছু গিফট দিলো। এতে আপনার বাচ্চা তাকে ভরসা করতে পারে। পরবর্তীতে ঐ একই ব্যক্তি বাচ্চার এই সহজে ভরসা করার ব্যাপারটিকে কাজে লাগিয়ে তাকে হয়রান করতে পারে। তাই প্রতিটি ব্যাপারে বাচ্চাকে যত্নের সাথে এই শিক্ষা দেয়া অত্যন্ত জরুরি।
কত বছর বয়স থেকে শিখাবেন?
সাধারণত দুই বছর বয়স থেকে বাচ্চারা তাদের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। আপনি প্রতিদিন একটু একটু করে খেলার ছলে প্রত্যেকটি অঙ্গ সম্পর্কে তাকে চেনান। ছবি এঁকে কোনটি হাত, পা, মাথা, চোখ এভাবেও শিখাতে পারেন। তারপর ধীরে ধীরে তাকে প্রাইভেট পার্টস চিহ্নিত করা শিখান। কাপড় বদলানো এবং গোসল করার সময়ও তাকে এই ব্যাপারে অবহিত করুন।
যেভাবে বোঝাবেন ও শিখাবেন
১) শুধু শিশুকেই নয়, আপনার পরিবারের সদস্যদেরও এই বিষয় সম্পর্কে জানানো এই অংশের অন্তর্ভুক্ত। বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী এমনকি কোনো আত্মীয় যদি ভালোভাবে আদর করে বা চুমু দেয় যেটা তার ভালো লাগে এবং কমফোর্ট ফিল করে সেটি গুড টাচ। শিশু কাকে কাকে আদর করতে পারবে এটাও শিখাতে হবে। বাসায় সে তার পরিবারের সদস্যকে যেভাবে ট্রিট করে বাইরে যেন এমনটি না করে জানিয়ে রাখুন এ বিষয়েও।
২) কোনো সংস্পর্শে শিশু যদি ভয় বা ব্যথা পায় এবং অস্বস্তি বোধ করে বা কেউ অকারণে তার প্রাইভেট পার্টে হাত রাখে সেটা ব্যাড টাচ।
৩) কেউ যদি আপনার শিশুকে চকলেট বা অন্যকিছুর লোভ দেখিয়ে আলাদা রুমে বা কেউ নেই এমন জায়গায় নিয়ে যায়, তাহলে বলে রাখুন সে যেন না যায়৷
৪) শিশু মানা করার সত্ত্বেও যদি বারবার তাকে স্পর্শ করে এটাও ব্যাড টাচ।
৫) এসব ঘটনার সম্মুখীন হলে সে যেন কাউকে বলে অথবা জোরে চিৎকার করে সে ব্যাপারে তাকে শিক্ষা দিন।
৬) পরিবারের কোন কোন সদস্য শিশুকে গোসল করানো, টয়লেট করানো বা কাপড় বদলিয়ে দিতে পারবে তা বুঝিয়ে বলুন।
৭) গুড টাচ ও ব্যাড টাচ নিয়ে এখন প্রচুর বই ও ভিডিও অ্যাভেলেবল। বই পড়ে গল্পের ছলে, ছবি এঁকে অথবা একসাথে বসে ভিডিও দেখে প্র্যাক্টিক্যালি তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন। এতে শিশুও ধীরে ধীরে টাচ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবে।
করণীয়
শিশুকে গুড টাচ ও ব্যাড টাচ সম্পর্কে শিখানোর সাথে সাথে কিছু দায়িত্বও আপনাকে পালন করতে হবে। যেমন-
শিশুকে অবজার্ভ করুন
আপনার শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করুন। সে লাজুক, রাগী, সেনসিটিভ নাকি হাসিখুশি কিনা খেয়াল করুন। সব বাচ্চাকে এই বিষয়ে একভাবে বোঝানো যাবে না। তাই তার মতো করেই তাকে সেইভাবে শিক্ষা দিন। অনেক বাচ্চা যেকোনো পরিবেশে সহজেই মিশে যায়। তাই তাকে তার সার্কেল সম্পর্কে অবহিত করুন। কারণ এসব বাচ্চাদের যে কেউ কোনো কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে তার ক্ষতি করতে পারে। যে বাচ্চাটি চুপচাপ থাকে তার সাথে কিছু ঘটলে হতে পারে সে তা নাও বলতে পারে। তাই আপনার শিশুর মনোভাব অনুযায়ী গুড টাচ ও ব্যাড টাচ এর শিক্ষা দিন।
অতিরিক্ত ভরসা করা থেকে বিরত থাকুন
ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘Sometimes salt looks like sugar’ অর্থাৎ সবসময় যে কাউকে ভরসা করবেন না। শিশুরা খুব কাছের মানুষ দ্বারাও চাইল্ড অ্যাবিউজের শিকার হতে পারে। সে এসে হয়তো তার সম্পর্কে আপনাকে জানালো। আর সেই ব্যক্তিকে আপনি ভরসা করেন বলে উল্টো বাচ্চাকে বকা দিলেন মিথ্যা বলার জন্য৷ এতে কিন্তু তার উপর বিরূপ একটি প্রভাব পড়বে। এমনটি একদমই করবেন না। আপনার বাচ্চা কার কার সাথে মিশছে, কার সাথে কথা বলছে, কার আচরণ কেমন এ ব্যাপারে সতর্ক হোন।
শিশুর সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করুন
অনেক সময় কাজের চাপে বা যেকোনো কারণে বাবা মা শিশুকে বুঝে উঠতে পারেন না। অনেক বাবা মা অল্পতেই রেগে যান। আপনার শিশু কী বলতে চায় সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন৷ তার সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করুন, যেন মন খুলে সে যেকোনো কিছু শেয়ার করতে পারে। আপনিই যদি তাকে কো-অপারেট না করেন, তাহলে শিশু কোনো অপ্রস্তুত ঘটনার শিকার হলেও বলতে চাইবে না।
শিশুকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলুন
শিশুদের সেলফ কনফিডেন্স শিখানো ভীষণ জরুরি। এতে যেকোনো খারাপ সময় সে ফাইট ব্যাক করতে পারবে। তাকে বোঝান, তার শরীর একান্তই তার। কোনো খারাপ ঘটনা ঘটলে সে যেন না ভাবে যে তার ভুল। ভয় পেয়ে যেন সে দূরে সরে না যায়। এই আত্মবিশ্বাস যদি শিশুর মাঝে গড়ে ওঠে তাহলে যে কোনো পরিস্থিতিতে সে নিজেকে সামলে নিতে পারবে।
লজ্জা না পেয়ে রুখে দাঁড়ান
অনেক সময় শিশুর চেয়ে বাবা-মাই এসব বিষয়ে কথা বলতে লজ্জা পান। উল্টো বাচ্চাকেই চুপ করিয়ে দেন লোকে কী বলবে এটা ভেবে। জেনে রাখুন, এতে আপনি নিজের অজান্তেই শিশুকে অনেক বড় দুর্ঘটনার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। শিশুর পাশাপাশি আপনাকেও প্রতিবাদ করতে হবে এই বিষয়ে। লজ্জা পেয়ে বা সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে এই ভেবে এখন যদি কিছু না বলেন, তাহলে একদিন হয়তো পরিস্থিতি আর হাতের মুঠোয় থাকবে না। তাই এসব পরিস্থিতিতে সন্তানের পাশে দাঁড়ান এবং অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
যে বিষয়গুলো দেখলে সাবধান হতে হবে
বাচ্চারা অনেক কিছু শেয়ার করতে পারে না বা বলতে চায় না। সেক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ দেখলে বুঝতে হবে সে কোনো অপ্রীতিকর সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কিনা। যে লক্ষণগুলো দেখলে আপনাকে সাবধান হতে হবে এবং শিশুর সাথে কথা বলতে হবে-
- ঘুমের মাঝে শিশু চিৎকার করলে
- ভয়ে রাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেললে
- চঞ্চলতা কমে যেয়ে একদম চুপচাপ হয়ে গেলে
- কাজে অমনোযোগী হয়ে গেলে
- সব সময় নার্ভাস হলে বা ভয়ে ভয়ে থাকলে
যে কোনো সমস্যায় জরুরি হেল্পলাইন নম্বরে কল দিন
আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত চাইল্ড অ্যাবিউজ, চাইল্ড রেইপ এর মতো ঘটনাগুলো ঘটছে। ছেলে বা মেয়ে শিশু যে কেউ এই ঘটনাগুলোর শিকার হতে পারে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি অনেক অর্গানাইজেশনও শিশুর সুরক্ষার জন্য কাজ করে আসছে। আপনার সন্তানও যদি এমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হয় তাহলে ১০৯৮ এই হেল্পলাইন নম্বরে কল দিতে পারেন। আপনার শিশুর যেকোনো সমস্যায় আপনি সাহায্য পাবেন জরুরি এই সেবা থেকে।
সুস্থ ও সুন্দর মনের শিশু পরিবারের ও দেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে। শিশু যদি পরিবার থেকে খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তাহলে সে মানসিকভাবেও নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে পারে। তাই শিশুর স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রক্রিয়া যেনো বাধাপ্রাপ্ত না হয়, তাই শিশুকে ভালো ও খারাপ সংস্পর্শ সম্পর্কে অবহিত করুন। আজ এই পর্যন্তই, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করুন।
ছবিঃ সাটারস্টক, Northeast Today