অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের কাছে ট্রেকিং অনেকটা নেশার মত। ঝিরিপথ-পাহাড়-ঝরণার সৌন্দর্য্যের টানে আর লোকালয়ের কোলাহল থেকে ছুটি নিয়ে নির্জনে নিজেকে আবিস্কার করতে ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ছুটে যায় ট্রেকিংয়ে। ট্রেকিং মানে কোনো ঝরণার সন্ধানে দুর্গম পাহাড় বেয়ে ওঠা, বন জঙ্গলের পথ মাড়িয়ে, কখনো বা কাদা মাখা ঢালু রাস্তা ধরে এগিয়ে চলা, আবার ঝরণা ধারার পিচ্ছিল পথে হাঁটা, এক কথায় বলতে গেলে ট্রেকিং দুঃসাহসী ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান। যারা ট্রেকিং করতে যাচ্ছেন, সাহস আর ইচ্ছার পাশাপাশি পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ট্রেকিংয়ের পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে নতুন ট্রেকারদের কোন কোন বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত সেটা নিয়েই আজকের আয়োজন। চলুন তাহলে জেনে নেই।
ট্রেকিংয়ের পূর্ব প্রস্তুতি কেন প্রয়োজন?
ট্রেকিংয়ে যেখানে যাবেন, সেখানে হাতের কাছে দরকারি কোনো জিনিস খুঁজে পাওয়ার সম্ভবনা নেই আর বিপদে-আপদে নিজেদের ছাড়া অন্য কারোর সাহায্য পাবারও নিশ্চয়তা নেই। এমন কী সেই জায়গাটা সম্পূর্ণ জনমানবহীনও হতে পারে। আবার অনেক সময় আপনি ফোনের নেটওয়ার্ক পাবেন না। বন্য প্রকৃতিতে নতুন নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে প্রতি মুহূর্তে। ট্রেকিং কয়েক ঘণ্টারও হতে পারে, আবার কয়েক দিনেরও হতে পারে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না নিলে আপনার অ্যাডভেঞ্চারে বাঁধা আসতে পারে যেকোনো সময় আর সামান্য অসতর্কতায় ঘটে যেতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনাও। তাই আগে থেকেই পরিকল্পনা করুন, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন এবং মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করুন।
কোন বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে?
১) শারীরিক সক্ষমতা
শারীরিক সক্ষমতা ট্রেকিংয়ে যাওয়ার পূর্বশর্ত। হার্ট আর ফুসফুসের স্বাস্থ্য ভালো না হলে যাত্রাপথে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। শারীরিক অসুস্থতা থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের অনুমতি নিন। ঠাণ্ডায় বা উচ্চতায় সমস্যা হবে কিনা, হলে কী করতে হবে, সে সব জেনে নিতে হবে। ট্রেকিংয়ের জন্য মনস্থির করলে অন্তত এক মাস আগে থেকেই সিঁড়ি দিয়ে ওঠা ও হাঁটাহাঁটির অভ্যাস করুন। সেই সাথে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে শরীরকে জড়তামুক্ত করে নিন। পায়ের শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম করা জরুরী।
যারা কোনোদিন ব্যায়াম করেননি, তাদের ক্ষেত্রে শারীরিক প্রস্তুতির পর্বটা একটু কঠিন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু পুরোপুরি ফিট না হয়ে ট্রেকিংয়ে গেলে শুধু আপনি নিজে বিপদে পড়বেন না, আপনাকে নিয়ে দলের সবাই বিব্রত হবে। আর যাদের উচ্চতা ভীতি, অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট, অ্যানিমিয়া, জয়েন্ট পেইন, লো প্রেশার এই ধরনের সমস্যা আছে তাদের পাহাড়ে ট্রেকিংয়ে না যাওয়া ভালো।
২) ব্যাকপ্যাক নির্বাচন
ট্রেকিংয়ের কথা মনে আসলেই চোখের সামনে ভেসে আসে বড় ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে অভিযাত্রিক পাহাড় বেয়ে উঠছেন। ব্যাকপ্যাক ছাড়া ট্রেকিংয়ের প্রস্তুতি অসম্পূর্ণ। ট্রেকিংয়ের পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে যারা ব্যাগ কেনার কথা ভাবছেন, একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন ব্যাগে যত বেশি ফিতা থাকবে, ব্যাগের ওজন তত বেশি সারা শরীরে ভাগ করে দিতে পারবেন। এতে ওভারঅল ওয়েট কম মনে হবে। কোমরে ওজন ছড়িয়ে দিতে পারলে কাঁধের উপরে চাপ কমে যায় এবং হাঁটতে সুবিধা হয়। বেশি চেম্বার বা পকেট থাকলে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে রাখতে পারবেন। মনে রাখবেন, আপনার ব্যাগ যত হালকা হবে আপনি তত স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারবেন।
৩) পোশাকের দিকেও খেয়াল রাখুন
পোশাক যেন ট্রেকিংয়ে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরী। পানিতে ভিজলে বা ঘাম তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে এমন কাপড় বেছে নিন। হালকা রঙ কম রোদ শোষণ করে তাই হালকা রঙের সুতি পোশাক পরলে ভালো হয়। আরামদায়ক থ্রি-কোয়ার্টার স্পোর্টস প্যান্ট বা ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি-শার্ট, ফুল স্লিভ গেঞ্জি এগুলোই ট্রেকারদের বেশী পছন্দ। গামছা বা পাতলা তোয়ালে নিতে ভুলবেন না। স্থান, সময় ও ঋতু ভেদে পোশাক আলাদা আলাদা হয়ে থাকে তাই এগুলোও মাথায় রাখবেন।
৪) জুতা নির্বাচন
গ্রিপযুক্ত জুতা ট্রেকিংয়ের জন্য সবচেয়ে ভালো। বাজার ঘুরলেই ট্রেকিংয়ের কেডস বা বুট জুতা পেয়ে যাবেন। পাহাড়ি রাস্তায় পিছলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই জুতার অ্যাঙ্কেল ও আর্চ সাপোর্ট আর গ্রিপ ভালো হলে সেই ভয় আর থাকে না। সঙ্গে এক জোড়া স্যান্ডেল রাখুন যা ট্র্যাকিং বাদে অন্যান্য সময় ব্যবহার করতে পারবেন।
৫) সাথে নিন শুকনো খাবার
দ্রুত শক্তিবর্ধক এবং সহজেই হজম হয় এমন শুকনো খাবার ব্যাগে রাখুন। চিড়া-গুড়, মুড়ি, চকলেট, খেজুর, ওটসবার, ম্যাংগো বার, কুকিজ, বাদাম এগুলো খুব ভালো অপশন হতে পারে। গ্লুকোজ ও স্যালাইন নিতে ভুলবেন না। খাওয়ার পানির উৎস সম্পর্কে আগেই ধারণা নিয়ে রাখতে হবে। একদিনের বেশি ট্রেকিংয়ের প্ল্যান থাকলে কেক, বিস্কুটের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার নিতে হবে। দেশলাই বা লাইটার ও ছোট স্টোভ নিয়ে গেলে চা, ইনস্ট্যান্ট নুডলস অথবা স্যুপ বানিয়ে নিতে পারবেন।
৬) ফার্স্ট এইড বক্স সাথে নেওয়া মাস্ট
ট্রেকিংয়ের সময় ছোট-খাটো দুর্ঘটনা যেন সামলে নেয়া যায় বা কেউ হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়লে যেন তাৎক্ষনিক চিকিৎসা দেওয়া যায়, সেজন্য ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যান্টি সেপটিক ক্রিম, দরকারি ওষুধ, মশা নিরোধক ওডোমস, কাঁচি, ব্যান্ডেজ এগুলো গুছিয়ে নিন ট্যুরের আগেই। ট্রেকিংয়ের রুটে জোঁকের আনাগোনা থাকলে সাথে লবণ রাখুন।
৭) অন্যান্য বিষয়
ট্রেকিংয়ের পূর্ব প্রস্তুতি নিতে যে বিষয়গুলো খেয়াল না রাখলেই নয়, সেগুলো এক নজরে দেখে নিন।
- যে স্থানে যাচ্ছেন সেখানকার আবহাওয়া, রাজনৈতিক অবস্থা, পরিবেশ–পরিস্থিতি, কাছাকাছি লোকালয়ের অবস্থান এগুলোর সম্পর্কে ধারণা আগে থেকেই রাখতে হবে।
- লোকাল ট্যুর গাইড বা পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কাউকে দলে রাখলে খুবই ভালো হয়।
- কোন পথে কী বিপদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, কোন পথে কীভাবে চললে সুবিধা হয় সেগুলো সম্পর্কে গাইডের থেকে জেনে নিন। অবশ্যই বিশ্বাসভাজন গাইড ঠিক করতে হবে।
- সঙ্গী হিসেবে কাদের বেছে নিচ্ছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। সবার মধ্যেই শারীরিক ফিটনেস, সহযোগিতার মনোভাব এবং সব পরিবেশে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা থাকা খুব দরকার।
- সানগ্লাস, হ্যাট, ট্রেকিং স্টিক এগুলো ছাড়া আপনার প্রস্তুতি অসম্পূর্ণ।
- রাতে তাঁবুতে থাকার পরিকল্পনা থাকলে তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ এগুলো সঙ্গে নিতে হবে। লোক সংখ্যা অনুযায়ী ও আবহাওয়া বুঝে তাঁবু কিনে নিতে পারেন। দড়ি, টর্চ লাইট অবশ্যই নিতে হবে।
- টয়লেট্রিজ যেমন—ব্রাশ, পেস্ট, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টিস্যু ইত্যাদিও সঙ্গে রাখবেন।
- এখন সবাই স্মার্টফোনের গুগল ম্যাপে নিজের অবস্থান, গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় সবই দেখে নিতে পারে। কিন্তু দুর্গম এলাকায় জিপিএস এর ভালো সাপোর্ট পাওয়া যায় না। পথ হারিয়ে যেন না ফেলেন, সেজন্য ম্যাপ এবং কম্পাসের ব্যাবহার শিখে নিতে হবে আগে থেকেই।
- রুট প্ল্যানের ম্যাপ ব্যাগে রাখতে ভুলবেন না।
- ক্যামেরা, বাইনোকুলার, মোবাইল রাখার জন্য পানি নিরোধক জীপলক ব্যাগ সাথে রাখা আবশ্যক।
ব্যস, জেনে নিলেন ট্রেকিংয়ের পূর্ব প্রস্তুতি সম্পর্কে। যেখানেই যান না কেন, পরিবেশ ও বন্য প্রাণীর যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে কোনো বাঁধা নেই কিন্তু মনে রাখবেন যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে পরিবেশ দূষণ করা যাবে না। হ্যাপি ট্রেকিং!
ছবি- সাটারস্টক