হাইপোথাইরয়েডিজম সমস্যা কি ও এর উপসর্গ নিয়ে অনেকেই জানতে চায়। এই হাইপোথাইরয়েডিজম সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত বলার পূর্বে কিছু ঘটনা শেয়ার করছি…”শারমিনের প্রেগন্যান্সির ৭ সপ্তাহের মাথায় হঠাৎ গর্ভপাত হয়। পরে জানা যায়, তাকে ডাক্তার হরমোনের যে ওষুধগুলো খেতে বলেছিল সে ভুলে তা খায়নি সেদিন।”
“দীপা ইদানিং সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। ওজনও অস্বাভাবিক রকমে বেড়ে যাচ্ছে। সবাই বলছে সারাদিন ঘুমিয়ে আর খেয়ে কাটাচ্ছে দেখেই তার এই হাল। কিন্তু সে বুঝতে পারছে তার শরীরটা খুব দূর্বল, সাথে মেজাজও খিটখিটে হয়ে থাকে সারাক্ষণ।”
“তানিয়া ও আবির অনেকদিন ধরেই বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ডাক্তার জানালো, তানিয়ার শরীরে একটি হরমোনের ঘাটতি আছে। যার কারণে বাচ্চা পেটে আসার পর তার গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি অথবা বাচ্চা হলেও তার সুস্থভাবে জন্মানোর সম্ভাবনা খুবই কম।”
এই যে সবগুলোর কথা বললাম এগুলোর পিছে একটি রোগই দায়ী। তা হলো হাইপোথাইরয়েডিজম। এটি একটি “থাইরয়েড” হরমোনের ঘাটতিজনিত রোগ। নিশ্চয়ই ভাবছেন খুব মারাত্মক একটি রোগ? অথচ সামান্য সচেতন হয়ে যদি আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কিছু খাবার যোগ করি তাহলে খুব সহজেই নিজেকে এই রোগ থেকে রক্ষা করতে পারি।
হাইপোথাইরয়েডিজম বর্তমানে অতি দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাওয়া একটি রোগ। পুরুষের তুলনায় নারীদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৬ গুণ বেশি। কিন্তু দেখা যায় এখনও আমাদের মধ্যে অধিকাংশ নারীরই এ রোগ সম্পর্কে ধারণা কম। অনেকেই জানেন না ওষুধ ছাড়াও প্রাকৃতিক উপায়ে এই রোগ মোকাবেলা করা যায়।
থাইরয়েড কি?
থাইরয়েড দেখতে একটি প্রজাপতির মত গ্রন্থি যা আমাদের গলায় থাকে। এই গ্রন্থি হতে থাইরক্সিন নামক হরমোন নিসৃত হয়। থাইরক্সিন হরমোন আমাদের দেহের বিভিন্ন বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি হৃদপিন্ডের গতি নিয়ন্ত্রণে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে, শরীরে কতটুকু প্রোটিন উৎপাদন হবে ইত্যাদি গুরুপুর্ণ কাজে থাইরয়েড হরমোনের প্রভাব রয়েছে। তাই এর গুরুত্ব অনেক।
হাইপোথাইরয়েডিজম কি?
‘হাইপো’ শব্দের অর্থ কম। যখন কোন কারণে থাইরয়েড গ্রন্থি প্রয়োজনের তুলনায় কম হরমোন তৈরি করে তখন তাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলে।
কীভাবে বুঝবেন আপনি হাইপোথাইরয়েডিজম এ ভুগছেন?
এই রোগ অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক সময়ে ধরা পড়ে না। থাইরয়েড হরমোনজনিত রোগের লক্ষণগুলো এতটাই বৈচিত্র্যময় হয় যে খুব সহজেই তা চিকিৎসকদের সন্দেহকেও এড়িয়ে যায়। তাই কিছু উপসর্গ আছে যা দেখে আপনি নিজেই সন্দেহ করতে পারবেন হয়তো আপনি হাইপোথাইরয়েডিজম এ ভুগছেন এবং চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে পারবেন।
হাইপোথাইরয়েডিজম সমস্যা বুঝবার কিছু লক্ষণ
- থাইরয়েড হরমোন কমে গেলে বিপাক ক্রিয়া দেরিতে হয় তাই এই রোগের প্রথম লক্ষণ ওজন বেড়ে যাওয়া।
- অবসাদগ্রস্ততা,ঘুম ঘুম ভাব।
- ঠাণ্ডা একদমই সহ্য করতে না পারা।
- হৃদস্পন্দন কমে যাওয়া।
- উচ্চ রক্তচাপ হওয়া।
- বুকে ব্যথা অনুভূত হওয়া।
- গলগ দেখা যাওয়া।
- চামড়া ও চুল শুষ্ক ও খসখসে হয়ে যাওয়া।
- কানে কম শোনা বা একদমই না শোনা।
- স্নায়ু ও মাংসপেশী নির্ভর রিফ্লেক্স কমে যাওয়া।
- মাংসপেশীতে প্রচন্ডচাপ ও ব্যথা অনুভব করা।
- অনিয়মিত মাসিক ও মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত।
- মুখ ও পা ফুলে যাওয়া।
- কোষ্ঠকাঠিন্য।
- বন্ধ্যাত্বতা।
- যৌন ক্ষমতা কমে যাওয়া।
- স্বরের কোমলতা কমে যাওয়া, কন্ঠ ভারী ও কর্কশ শোনানো।
- পেটে পানি জমা।
উপরের কয়েকটি লক্ষণ একসাথে দেখা দিলেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হন এবং কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হোন আপনি হাইপোথাইরয়েডিজম এ ভুগছেন কি না।
হাইপোথাইরয়েডিজম সমস্যা মোকাবেলায় কিছু সুপারফুড
এই রোগের চিকিৎসায় সাধারণত বিভিন্ন রকমের সিনথেটিক হরমোন পিল দেওয়া হয় যার কিছু ক্ষতিকর পার্শবপ্রতিক্রিয়া থেকেই যায়। কিন্তু দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই,আজকে এমন কিছু খাবারের নাম শেয়ার করবো যা আপনাকে থাইরয়েড হরমোনের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করবে।
(১) আয়োডিনযুক্ত খাবার
আয়োডিনের ঘাটতি মেটাতে আমরা আয়োডিনযুক্ত লবন খেয়ে থাকি। কিন্তু অতিরিক্ত লবন উচ্চ রক্তচাপের কারণ হওয়ায় চিকিৎসকরা লবন পরিহার করতে বলে থাকেন। তাই লবনের পরিবর্তে সামুদ্রিক মাছ যেমন – লইট্টা, কোরাল প্রভৃতি খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া চিংড়ি, টুনা মাছেও প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে। সেদ্ধ ডিম, কলা, দানা জাতীয় শস্য, শাকপাতাতেও প্রচুর আয়োডিন। তাই এসব ও খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেয়া যাবে না।
(২) নারিকেল তেল
নারিকেল তেলের মধ্যে রয়েছে মিডিয়াম চেইন ফ্যাটি-এসিড। এটি থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি পূরণ করে। নারিকেল তেল থাইরয়েড হরমোন বৃদ্ধি করে, খাবার দ্রুত পরিপাকে সাহায্য করে এবং এতে বিপাক ক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে অবসাদগ্রস্ততা দূর করে। নারিকেল তেলকে রান্নায় ব্যবহার করতে পারেন। তবে প্রতিদিন ৩ চামচের বেশি নারিকেল খাওয়া যাবে না।
(৩) সামুদ্রিক শৈবাল
নামটি অপরিচিত শোনালেও এখন আমাদের দেশে সামুদ্রিক শৈবালের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। অধিকাংশ শৈবালেই সামুদ্রের পানির চেয়েও বেশি আয়োডিন রয়েছে যা ওষুধ বা লবনের বড় বিকল্প হতে পারে।
(৪) উচ্চমানের টাইরোসিন আমিষযুক্ত খাবার
টাইরোসিন দরকার হয় থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে। উচ্চমানের টাইরোসিন প্রোটিন পেতে হলে খেতে হবে মাংস, মুরগির মাংস, ডিম, মাছ, কলা ও মিষ্টি কুমড়ার বিচি।
(৫) গরু অথবা মুরগির স্টক
আমরা রান্নাতে বিফ ও চিকেনের যে স্টকটি ব্যবহার করি তাতে প্রচুর পরিমাণে অ্যামাইনো এসিড এল-প্রোলিন ও এল-গ্লাইসিন থাকে যা থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে। তাছাড়া শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং মাংসপেশীর ব্যথা দূর করে।
(৬) ফলমূল ও শাকসবজি
ফলমূল ও শাকসবজিতে থাকে ভিটামিন, মিনারেলস ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা প্রদাহ কমায়। তাছাড়া ফলমুল ও শাকসবজি পুষ্টিকর হওয়ায় আমাদের শরীরের হরমোন ব্যালেন্স করে, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে, এমনকি হার্টের সুরক্ষায় ও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
(৭) বিশুদ্ধ পানি
পানি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে এবং পরিপাক ক্রিয়া সচল রাখে। কোষ্ঠকাঠিন্য, শরীরের দুর্বলভাব দূর করতে এমন কি সুগারের প্রতি আসক্তি কমাতে প্রতি ২ ঘন্টা অন্তর কমপক্ষে একগ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।
হাইপোথাইরয়েডিজম সমস্যা মোকাবেলায় কোন খাবারগুলো এড়িয়ে যাবেন?
(১) গয়ট্রোজেনাস জাতীয় খাবার
গয়ট্রোজেনাস খাবার যেমন বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি, সয়াসস, চিনাবাদাম, শিম, পালংক শাক ইত্যাদি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া যাবে না। খেলে রান্না করে খেতে হবে, কাঁচা খাওয়া যাবে না। থাইরয়েড সমস্যা থাকলে এসব খাবার না খাওয়াই ভালো।
(২) কলের পানি
অবিশুদ্ধ কলের পানিতে অনেক সময় ফ্লোরিন ও ক্লোরিন থাকে যা আমাদের শরীরের আয়োডিন পরিশোষণে বাধা দেয়। তাই অবশ্যি পানি ফুটিয়ে খেতে হবে।
(৩) কফি
অবসাদ দূর করতে আমরা অনেকেই কফি খেয়ে থাকি। এতে থাকে ক্যাফেইন যা থাইরয়েড হরমোনকে ব্লক করে। তাই আপনি যদি হাইপোথাইরয়েডিজম এ ভুগে থাকেন তাহলে কফির অভ্যাস ত্যাগ করে ফলের জুস খাওয়ার চেষ্টা করুন।
(৪) পাস্তুরিত দুধ ও দুধজাতীয় খাবার
থাইরয়েড সমস্যা থাকলে পাস্তুরিত দুধ খাওয়া উচিত নয়। এমনকি দুধজাতীয় খাবার যেমন পনির, দই ইত্যাদি খাবার এড়িয়ে যেতে হবে।
(৫) চিনিযুক্ত খাবার
চিনি ওজন বৃদ্ধির জন্য দায়ী, তাছাড়া মেটাবলিজমের জন্য শরীরে হরমোনের যে সামাঞ্জস্য দরকার তাতে চিনি বাধা সৃষ্টি করে। তাই চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
(৬) রিফাইন্ড ময়দা
রিফাইন্ড বা মিহি করা ময়দা ও ময়দাজাতীয় খাবার শরীরে হরমোন লেভেলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং ওজন বাড়ায়।
(৭) তাছাড়া হাইপোথাইরয়েডিজম রোগীদের তিসির তেল এবং ফলের মধ্যে পীচ ও স্ট্রবেরি এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন হোন। হাইপোথাইরয়েডিজম সমস্যা থেকে শুরু করে শরীরের সকল সমস্যা বুঝতে চেষ্টা করুন আজই, প্রতিকার ও প্রতিরোধে নিন ব্যবস্থা। দেখবেন সতেজ এবং সুস্থ থাকছেন সব সময়।
ছবি – সংগৃহীতঃ সাজগোজ.কম