হাইপোথাইরয়ডিজম, হাইপারথাইরয়েডিজম ও গলগন্ড কী এ নিয়ে অনেকের ভালো ধারণা নেই। ইদানিং হঠাৎ করেই কি ওজনটা কোনও কারণ ছাড়াই বেড়ে যাচ্ছে? কোনও কারণ ছাড়াই, খাবার ঠিকমত খাওয়ার পরও ওজন কমে যাচ্ছে? নাকি আগের মতো গরমটা আর সহ্য হচ্ছে না বা ঠান্ডাটা অসহ্যের পর্যায়ে চলে গেছে? নাকি প্রচুর ঘামে ভিজে যাচ্ছে শরীর? নাকি, ক্লান্তিবোধ আপনাকে কাবু করে ফেলছে? গলার স্বরটি পরিবর্তিত হয়ে গেলো কি হঠাৎ করেই? এরকম আরো অনেক সমস্যা হতে পারে আপনার, যদি আপনার শরীরে থাইরয়েড নামক অতি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থিটা অসুস্থ হয়ে যায়।
থাইরয়েড কী?
চলুন থাইরয়েড এর এনাটমিটা সহজ ভাষায় জানার চেষ্টা করি। থাইরয়েড প্রজাপতির মত দেখতে একটি গ্রন্থি, যেটা গলায় থাকে, গলার কলার বোন বা বিউটি বোন নামক হাড্ডির উপরে। এটি একটি এন্ড্রোক্রাইন গ্রন্থি। এটি হরমোন তৈরি করে। আর থাইরয়েড হরমোন আমাদের শরীরে জৈব বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এর গুরূত্ব অনেক।
থাইরয়েড গ্রন্থিতে কী কী সমস্যা হতে পারে? থাইরয়েডে অনেক রকম রোগ হতে পারে। নিচে হাইপোথাইরয়ডিজম, হাইপারথাইরয়েডিজম ও গলগন্ড রোগ নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১. হাইপোথাইরয়ডিজম
যখন শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে কম থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হয়। কখন বুঝবো যে আমি এই রোগে ভুগছি? চলুন জেনে নিই এর কিছু লক্ষণ।
হাইপোথাইরয়ডিজম এর লক্ষণসমূহ
১) কাজ করতে এনার্জি না পাওয়া বা ক্লান্তবোধ করা।
২) খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া।
৩) পর্যাপ্ত খাবার না খাওয়ার পরেও শরীরের ওজন ব্যাখ্যাতীতভাবে বেড়ে যাওয়া।
৪) ঠান্ডা একদমই সহ্য করতে না পারা।
৫) চুল ও ত্বক শুকনো ও মোটা হয়ে যাওয়া।
৬) মেয়েদের মাসিকের সময় প্রচুর রক্ত যাওয়া ও অনিয়মিত মাসিক হওয়া।
৭) মুখ ফুলে যাওয়া।
৮) হতাশাগ্রস্থ হওয়া।
৯) মাংসপেশীতে ব্যথা।
১০) পায়খানা কষা হয়ে যাওয়া।
১১) বন্ধ্যাত্বতায় ভোগা।
১২) মানসিক অবসাদে ভোগা।
১৩) যৌন চাহিদা কমে যাওয়া।
১৪) হার্ট এর গতি কমে যাওয়া।
১৫) থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যাওয়া বা গোটা গোটা উঠা। যাকে মেডিকেল ভাষায় goiter বলে।
এই সমস্ত লক্ষণ কয়েকটা একসাথে দেখা দিলে ডাক্তার এর শরনাপন্ন হবেন। ডাক্তার আপনাকে কিছু পরীক্ষা করতে দিবে। পরীক্ষার ফল দেখে ডাক্তার নিশ্চিন্ত হবেন আসলেই আপনি হাইপোথাইরয়েডিজম এ ভুগছেন কিনা? এরপর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিবেন ডাক্তার।
হাইপোথাইরয়েডিজম এর কারণ কী?
১) হাসিমোটর থাইরয়েডাইটিস নামক অটোইমিউনো ডিজিস থাকলে।
২) থাইরয়েড গ্লান্ড কোন কারণে শুকিয়ে গেলে।
৩) থাইরয়েডেকটমি নামক অপারেশনের পর।
৪) কিছু কিছু ওষুধ যেমন, carbimazole methimazole, propylthiouracil, amiodarone, lithium, নামক এন্টিথাইরয়েড ড্রাগ overdose হয়ে গেলে।
৫) আয়োডিনের অভাব হলে।
৬) ডিজহরমোজেনেসিস হলে।
৭) পিটুইটারিতে অসুখ হলে।
৮) হাইপোথ্যালামিক এ অসুখ হলে।
এছাড়া আরো অনেক কারণে হতে পারে।
হাইপোথাইরয়েডিজম এর চিকিৎসা কী?
এই রোগের চিকিৎসা তুলনামূলকভাবে সোজা। মুখে খাবার জন্য thyroxine হরমোন
এর পিল দেয়া হয়। যেটা অনেক সময় আজীবন খেয়ে যেতে হয়।
হাইপারথাইরয়েডিজম
শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি থাইরয়েড হরমোন ক্ষরিত হলে এই রোগ হয়।
হাইপারথাইরয়েডিজম এর উপসর্গগুলো কী কী?
১) খাবারের রুচি বেশ ভালো থাকার পরেও শরীরের ওজন কোন কারণ ছাড়াই কমে যাওয়া।
২) প্রচুর ঘামা, গরম একেবারে সহ্য না করতে পারা।
৩) হাতের তালু ঘেমে যাওয়া।
৪) মাংস পেশীতে শক্তি না পাওয়া।
৫) হাত পা কাঁপা।
৬) অনিয়মিত মাসিক হওয়া।
৭) ঘুমে সমস্যা হওয়া।
৮) ডিস্টার্ব ও নার্ভাস থাকা।
৯) চোখে ঝাপসা দেখা।
১০) পাতলা পায়খানা ঘন ঘন হওয়া।
১১) বুক ধুকপুক ধুকপুক করা,ও হার্ট বিট বেড়ে যাওয়া।
১২) উচ্চ রক্তচাপ হওয়া।
১৩) চুল পাতলা হয়ে যাওয়া।
১৪) থাইরয়েড গ্লান্ড ফুলে গেলে বা বড় হলে।ইত্যাদি।
তার মানে দেখা যাচ্ছে হাইপোথাইরয়েডিজম এর বিপরীত উপসর্গ গুলোই হলো হাইপারথাইরয়েডিজম এর।
হাইপারথাইরয়েডিজম এর কারণ কী?
১) graves নামক অটোইমিউনো ডিজিস হলে।
২) multinodular goiter বা অনেকগুলো গোটা গোটা হয়ে থাইরয়েড গ্লান্ড বড় হলে।
৩) থাইরয়েড এ প্রদাহ হলে।
৪) আয়োডাইড ইন্ডিউস ড্রাগ যেমন, amiodaron
৫) TSH ক্ষরণকারী পিটুইটারি এডেনোমা হলে
৬) choriocarcinoma and hydatidiform mole হলে। ইত্যাদি।
হাইপারথাইরয়েডিজম এর চিকিৎসা কী?
৩ ভাগে বিভক্ত এর চিকিৎসা। রোগীর অবস্থা, বয়স, নডিউল এর সাইজ, টক্সিসিটি ইত্যাদি এর উপর নির্ভর করে ডাক্তাররা ৩ ধরনের চিকিৎসা দেন।
১. মুখে খাবার ওষুধঃ carbimazole, একটা নির্দিষ্ট ডোজ এ। প্রেগন্যান্ট মহিলাদের জন্য propylthiouracil দেয়া হয়।
২. অপারেশনঃ subtotal thyroidectomy করা হয়।
৩. রেডিও থেরাপি: 131I দিয়ে করা হয়।
এছাড়াও symptomatic treatment এর জন্য propranolol দেয়া হয়।
এছাড়াও থাইরয়েড এ goiter বা গলগণ্ড হয়।
গলগন্ড
থাইরয়েড গ্লান্ড যে কোনও কারণে বড় হয়ে গেলে, তাকে গলগন্ড বলে।
গলগন্ড এর কারণ কী?
অনেক সময় থাইরয়েড হরমোন স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু গ্লান্ড বড় হয়ে যায়, যেমন, বয়ঃসন্ধি কালে ও গর্ভাবস্তায়, কারণ এ সময় শরীরের চাহিদা বেশি থাকে। এটা স্বাভাবিক। তখন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়না। এছাড়া হাইপারথাইরয়েডিজম, হাইপোথাইরয়েডিজম, থাইরয়েড এ ক্যান্সার ও কোনও প্রদাহ হলে হয় গলগন্ড।
তাই goiter বা থাইরয়েড গ্লান্ড বড় হলে ও উপরে লেখা উপসর্গ দেখা দিলেই
ডাক্তার দেখান।
থাইরয়েড গ্লান্ড সুস্থ রাখার কয়েকটি টিপস
১) উচ্চ মানের tyrosine প্রোটিনযুক্ত খাবার খান। tyrosine দরকার হয় থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে। আর এটি পেতে খেতে হবে লাল মাংস, মাছ, মুরগির ডিম ও মাংস, কলা ও মিষ্টি কুমড়ার বিচি।
২) goitogenous খাবার যেমন বাঁধাকপি, ফুলকপি, সীম, চীনাবাদাম, সয়াসস, ইত্যাদি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া যাবে না। রান্না করে খাবেন, কাঁচা খাবেন না। আর থাইরয়েড এ সমস্যা থাকলে এসব খাবার খাওয়া উচিত নয়।
৩) gluten প্রোটিনযুক্ত খাবার খাবেন, immune system কে ঠিক রাখার জন্য। এজন্য গম, শস্যদানা, যব, বার্লি খেতে হবে।
৪) থাইরয়েড ঠিক রাখার জন্য লিভারের সুস্থতা দরকার। কেননা এখানেই T4, T3 convert হয়। আর লিভারের সুস্থতার জন্য ফ্যাটি এসিড যুক্ত খাবার খেতে হবে। বিভিন্ন তেলযুক্ত মাছ, কাঁচা বাদাম, অলিভওয়েল এ পাওয়া যাবে।
৫) আয়োডিন যুক্ত লবণ খাবেন।
৬) কীটনাশক ও হেভি মেটাল যেমন, mercury, cadmium, leadead এ exposer হবেন না।
থাইরয়েডকে ভালো রাখুন, নিজে ভালো থাকুন।
ছবিঃ এক্সপার্টবিকন.কম