বাঁচতে হলে ঘুমোতেই হবে! ঘুমই হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার চাবিকাঠি। ঘুম আপনার মস্তিষ্ক ও শরীরকে দেয় পূর্ণাঙ্গ বিশ্রাম। যার কারণে আপনি কর্মক্ষম থাকতে পারেন। কিন্তু যাদের রয়েছে ইনসমনিয়া সমস্যা? বিশেষ করে অনিদ্রার মতো ভয়াবহ যন্ত্রণা যাদের রয়েছে, তারাই বুঝতে পারেন ঘুমের মূল্য! অনিদ্রা মানে না ঘুমিয়ে থাকা। কিন্তু পুরোপুরি না ঘুমিয়ে তো বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। অনেকে আছে যারা রাতের পর রাত শুয়ে জেগে থাকে, ঘুমানোর চেষ্টা করলেও তাদের ঘুম আসে না। আবার ঘুমানোর পর মধ্যরাতে জেগে যায়। চেষ্টার পরও আর ঘুমাতে পারে না। অনেকে এটাকে খুব সাধারণ ব্যাপার মনে করে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু সারা দিনের কাজকর্ম শেষে শরীর ও ব্রেনের বিশ্রাম দরকার হয়। ঘুমের সমস্যা নিয়মিত চলতে থাকলে ক্রনিক (chronic) হয়ে পরে অসুখে পরিণত হয়। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে ইনসমনিয়া (insomnia)।
সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিনের ঘুমের মাত্রা
স্বাভাবিক বা সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। কাজের চাপ বা ব্যস্ততা খুব বেশি থাকলেও প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। দিনে ৬ ঘণ্টার কম ঘুমালে সেটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে সাধারণত, পূর্ণবয়স্ক মানুষদের ৭-৮ঘন্টা, শিশুদের ৯-১৩ ঘন্টা, একেবারে ছোট বাচ্চাদের ১২-১৭ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন। ঘুমানোর মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, অনেক রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকা যায়, মন সতেজ থাকে আবার কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ঘুমানোর সময় শরীরের কোষগুলো বিশ্রাম পায় এবং সেই সঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে যায় টক্সিন (toxin) নামক একটি পদার্থ। ভালো ঘুম ওষুধের থেকেও ভালো কাজ করে।
কেন হয় ইনসমনিয়া সমস্যা?
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাই ইনসমনিয়ার মূল কারণ। ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, পড়াশোনা ইত্যাদি কারণে ঘুমে দেরি হয় এবং পরে সঠিক সময়ে ঘুম আসে না। এছাড়াও আরও বেশ কিছু কারণ আছে যা আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। যেমন-
১) মানসিক চাপ
প্রচণ্ড মানসিক চাপ (চাকরি হারালে, প্রিয়জন মারা গেলে অথবা ডিভোর্স হলে যেমন চাপ হয়)।
২) ঘুমের ব্যাঘাত
ডিপ্রেশন বা অবসাদগ্রস্ত, টেনশন, দুঃস্বপ্ন ইত্যাদি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
৩) অতিরিক্ত ক্যাফেইন পান
অতিরিক্ত ক্যাফেইন পান, যেমন- চা, কফি ইত্যাদি উত্তেজক পদার্থ ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
৪) নিয়মিত অ্যালকোহল গ্রহণ
নিয়মিত অ্যালকোহল গ্রহণ করলে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। প্রথম প্রথম অ্যালকোহল গ্রহণ করলে ঘুমের সমস্যা না হলেও পরবর্তীতে ইনসমনিয়ার সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।
৫) ধূমপান বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য
ধূমপান বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবন তরুণ সমাজের ইনসমনিয়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ।
৬) কিছু রোগের কারণে
উচ্চরক্ত চাপ এবং কিছু কিছু রোগের কারণে মস্তিষ্কে রাসায়নিক দ্রব্যের তারতম্য ঘটলে ইনসমনিয়া হতে পারে।
৭) কিছু ওষুধ সেবনের ফলে
কিছু কিছু ওষুধ সেবনের ফলে, যেমন- হাঁপানি রোগের ওষুধ সারাজীবন ধরে খেতে হয়। এতে ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
৮) শারীরিক কিছু সমস্যায়
শারীরিক কিছু সমস্যায়, যেমন- আর্থ্রাইটিস, বুক জ্বালা, মাথাব্যথা, দাঁতের সমস্যা, লিভার, ফুসফুস বা কিডনির সমস্যা, প্রোস্টেটের সমস্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনিদ্রা হতে পারে।
৯) এলোমেলো কাজের সময়
কাজের শিফট যদি এলোমেলো হয়, যেমন- একদিন দিনে আবার অন্যদিন রাতে। এমন ক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
১০) পরিবেশগত কারণে
পরিবেশগত কারণে, যেমন- অতিরিক্ত কোলাহল, উচ্চস্বরে গান বাজানো, গাড়ির শব্দ ইত্যাদির কারণেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
লক্ষণ
- রাত্রে ঘুমের সমস্যার পাশাপাশি ইনসমনিয়ার যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে-
- দিনের বেলা ঘুম ঘুম ভাব লেগে থাকতে পারে
- ঘুম ঘুম ভাব লেগে থাকলেও দিনের বেলা চেষ্টা করলেও ঘুম আসতে চায় না
- সারাদিন ক্লান্ত লাগতে পারে
- মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকতে পারে
- ক্লান্তির কারণে দিনের বেলা কোনো কাজে মনোযোগ দিতে কষ্ট হতে পারে
এসব উপসর্গ মাঝে মধ্যে মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছরও থাকতে পারে।
ইনসমনিয়া চিকিৎসা
আপনার যদি ইনসমনিয়া আছে বলে মনে হয়, তাহলে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। মৃদু ইনসমনিয়া ভালো ঘুমের অভ্যাসের সাহায্যে ভালো করে ফেলা সম্ভব। যদি ইনসমনিয়ার কারণে আপনার দিনের বেলা ঘুম ঘুম ভাব এবং ক্লান্ত লেগে থাকে, তাহলে ডাক্তার আপনাকে অল্প কয়েকদিনের জন্য ঘুমের ওষুধ খেতে বলতে পারেন। নিজে নিজে ঘুমের ওষুধ কিনে খাবেন না। এগুলোতে খারাপ সাইড ইফেক্ট থাকতে পারে এবং এগুলো সময়ের সাথে সাথে কার্যক্ষমতা হারায়।
আর যদি ঘুমের সমস্যার মাত্রা অনেক বেশি হয়, তাহলে প্রথমে যে কারণে ইনসমনিয়া হচ্ছে সাধারণত তার চিকিৎসা করা হয়। যদি এতে ইনসমনিয়া ভালো না হয়, তাহলে আপনাকে কাউন্সেলিং (counselling) এবং বিহেভিওরাল থেরাপি (behavioral therapy) করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। এটাতে যেসব কাজে ইনসমনিয়া বাড়ে সেগুলো বাদ দিতে আপনাকে সাহায্য করা হবে এবং যেসব ব্যবহারে ঘুম ভালো হয় সেগুলো শেখানো হবে।
ইনিসমনিয়া প্রতিরোধে উপায়
১) ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন
ঘুমের আগে দীর্ঘসময় ধরে মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এগুলোর আলোর কারণে ঘুম আসতে দেরি হয় এবং ইনসমনিয়া সমস্যা বেড়ে যায়।
২) দিনের শেষাংশে ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল দূরে থাকুন
দিনের শেষাংশে ক্যাফেইন, নিকোটিন, অ্যালকোহল ইত্যাদি থেকে দূরে থাকুন। ক্যাফেইন ও নিকোটিন এর কারণে ঘুম আসতে দেরি হতে পারে। অ্যালকোহলের কারণে রাত্রে ঘুম ভালো না হতে পারে এবং মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
৩) নিয়মিত ব্যায়াম করুন
নিয়মিত ব্যায়াম করুন। তবে ঘুমের আগে ব্যায়াম করবেন না, তাহলে ঘুম আসতে সমস্যা হবে। রাতে ব্যায়াম করলে ঘুমের কমপক্ষে তিন-চার ঘন্টা আগে করুন।
৪) রাতে কম খান
রাত্রে খুব বেশি খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। ঘুমের আগে পেট অতিরিক্ত ভর্তি করে খেলে ঘুম ভালো হবে না।
৫) এয়ার প্লাগ ব্যবহার করুন
আপনার বেডরুমকে আরামদায়ক করুন। ঘরটা যেন অন্ধকার ও শব্দহীন এবং খুব বেশি গরম অথবা ঠান্ডা না হয় তার দিকে খেয়াল রাখুন। যদি শব্দের সমস্যা থাকে তাহলে এয়ার প্লাগ (air plug) পরে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
৬) বই পড়ুন
বিভিন্ন পজিশনে শুয়ে দেখুন, কোনটাতে আপনি সবচেয়ে বেশি আরাম অনুভব করছেন সেটা খেয়াল করুন। ঘুমের আগে রিলাক্স হওয়ার জন্য বই পড়তে, গান শুনতে অথবা গোসল করতে পারেন। আপনার যদি ঘুম না আসে তাহলে বিছানা থেকে উঠে বই পড়ুন অথবা শরীর/মন উত্তেজিত হয় না এমন কোনো কাজ করুন। ঘুম ঘুম ভাব আসলে আবার বিছানায় যান। শোয়ার পরে যদি পরের দিনের কাজ নিয়ে চিন্তা হয়, তাহলে একটা কাগজে সেগুলোর লিস্ট করুন। এতে চিন্তা একটু কমতে পারে।
তাহলে জেনে নিলেন তো, ইনসমনিয়া সমস্যা কেন হয়। নিয়মিত জীবনযাপনেই আসলে সুস্থ থাকা যায়। তাই, পর্যাপ্ত ঘুমান, নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করুন এবং সুস্থ জীবন পরিচালনার মাধ্যমে দূরে রাখুন ইনসমনিয়াকে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ; thoughtcatalog.com, foodal.com