যোধা আকবর। মহাকাব্যিক-প্রণয়ধর্মী চলচ্চিত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার স্বপ্ন

যোধা আকবর | মহাকাব্যিক-প্রণয়ধর্মী চলচ্চিত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার স্বপ্ন

jodha-akbar

যোধা আকবর ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮-এ মুক্তি পাওয়া আশুতোষ গোয়ারিকর পরিচালিত ভারতীয় জীবনীমূলক মহাকাব্যিক-প্রণয়ধর্মী চলচ্চিত্র। হায়দার আলির কাহিনীতে ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন হায়দার আলি ও আশুতোষ গোয়ারিকর এবং সংলাপ লিখেছেন কে. পি. সাক্সেনা। মুঘল সম্রাট আকবরও তার স্ত্রী যোধার প্রেমের উপাখ্যান নিয়ে নির্মিত ছবিটিতে মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন হৃতিক রোশন ও ঐশ্বরিয়া রায় বচ্চন।

ছবির মূল বিষয়

এই ছবির মূল বিষয় (হৃতিক রোশন) মুসলমান মোঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে তাঁর হিন্দু স্ত্রী যোধাবাই (ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন)-এর প্রেম। এর সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক এ. আর. রহমান। গীত লিখেছেন জাভেদ আক্তার এবং কাসিফ। ছবিটি সাওপাওলো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ দর্শকের পছন্দের বিদেশী ভাষায় নির্মিত শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার লাভ করে, গোল্ডেন মিনবার আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে দুটি পুরস্কার, সাতটি স্টার স্ক্রিন পুরষ্কার এবং পাঁচটি ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার পায়। এর সঙ্গে অবশ্য ছিলো তৃতীয় এশিয়ান ফিল্ম এর জন্য দুটি মনোনয়ন।

Sale • Nail Art Kits, Split Ends, Sun Protection

    সংক্ষিপ্তসার

    যোধা আকবর, ষোড়োশ শতাব্দিতে ঘটা এক প্রেম কাহিনী। রাজনৈতিক সমঝোতার অঙ্গ হিসেবে যে বিবাহ হয়েছিল তা কীভাবে মহান মোঘল সম্রাট আকবর এবং রাজপুত রাজকন্যা যোধার মধ্যে প্রেমের জন্ম দিয়েছিল, সেটা ঘিরেই ছবির গল্প গড়ে উঠেছে। সম্রাট আকবর (হৃতিক রোশন)  তাঁর রাজনৈতিক সাফল্যকে কোনো সীমার মধ্যে রাখার মানুষ ছিলেন না। হিন্দু কুশ জয় করার পর তিনি তাঁর রাজ্যের সীমা বিস্তারের জন্য যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। তার রাজত্বের বিস্তৃতি ছিলো আফগানিস্তান থেকে বঙ্গোপসাগর এবং হিমালয় থেকে নর্মদা নদী পর্যন্ত। রাজনৈতিক কূটকৌশল, ভীতি প্রদর্শণ এবং পেশী শক্তির সাহায্যে আকবর রাজপুতদের বশ্যতা জয় করেছিলেন। তবে সবাই তাঁর কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন নি। মহারাণা প্রতাপসহ অন্যান্য অনেক রাজপুত রাজাই আকবরকে বিদেশী হানাদার ছাড়া আর কিছুই ভাবতেন না। যখন আকবর স্বাভিমানী রাজপুত রাজকন্যা যোধা (ঐশ্বরিয়া রাই)-কে বিবাহ করার সময় তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো রাজপুতদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করা। তখন তিনি আন্দাজ করতে পারেন নি যে এবার তিনি অন্য এক জয়যাত্রায় সামিল হতে চলেছেন। এক সত্যিকারের ভালবাসার জয়যাত্রা। 

    আজমেরের রাজা ভারমলের মেয়ে যোধা রাজনৈতিক সমঝোতার পাশা খেলায় শুধু এক গুটি হয়ে থাকতে চায় নি। সেইজন্য আকবরের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় যুদ্ধ নয় যোধার মনের গহিনে ঘৃণা এবং অন্ধবিশ্বাসে জড়িয়ে থাকা প্রেম জয় করা। ‘যোধা-আকবর’ তাঁদের না বলা একটি প্রেমকথা।

    ঐতিহাসিক শুদ্ধতা

    যোধা চরিত্র ইতিহাসের কোন কালপর্বে আদৌ ছিলো কী না সে নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বইপত্রগুলো থেকে জানা গেছে যোধাবাঈ নামে ইতিহাসে কোন চরিত্র ছিলো না। আবার রাজস্থানের প্রামান্য ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে লেখা বইয়ে তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই তথ্যগত দ্বন্দের কারণে যোধাবাঈ আসলেই ছিলেন কী ছিলেন না, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বোঝা কঠিন। ঐতিহাসিক মত যাই থাক না কেন, ভারতীয় উপমহাদেশে যোধাবাঈ এর নামে ছড়িয়ে থাকা কিংবদন্তিগুলোই সম্ভবত তাকে অমর করে রেখেছে।

    ‘সম্রাট আকবরের সময়কাল, শাসনব্যবস্থা এবং জীবনী নিয়ে যে তিনটি আকর গ্রন্থ (আকবরনামা, মুতাখাবাত তাওয়ারিখ, তবকাত-ই-আকবরী) ফার্সী ভাষায় রচিত হয়েছিল সেখানে কোথাও যোধাবাঈ এর নাম উল্লেখ নেই। তবে আবুল ফজলের তিন খন্ডে রচিত আকবরনামায় উল্লেখ আছে আকবর রাজপুতের একজন রাজকুমারীকে বিয়ে করেছিলেন যার উপাধি ছিল মরিয়ম জামানী। পরবর্তীতে উল্লেখ করা হয় মরিয়ম জামানীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন এক রাজকুমার, যার নাম সেলিম— যিনি সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন। কিন্তু যোধা নামটি কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। ‘যোধা শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন উনবিংশ শতাব্দীর একজন বৃটিশ ইতিহাসবিদ কর্নেল টড যিনি আসলে পেশাদার ইতিহাসবিদ ছিলেন না। তিনি মূলত রাজস্থানের লোক সাহিত্য থেকে নামটি পেয়েছিলেন। মজার বিষয় এই যে, যোধপুরের রাজপরিবার আবার দাবি করছে যোধা বলে কেউ একজন ছিলেন যার সঙ্গে আকবরের বিয়ে হয়েছিল।

    বলিউড চলচ্চিত্র যোধা-আকবর মুক্তি পাওয়ার পর এক সংবাদ মাধ্যমে জয়পুরে রাজপরিবারের বংশধর পদ্মিনী দেবীও বলেছেন, যোধাকে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে মোগল এবং রাজপুতদের মধ্যে একরকম সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল। অন্যদিকে যোধাবাঈকে নিয়ে রাজপুত সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিন্ন গল্প প্রচলিত আছে। ফলে সে সম্প্রদায়ের লোকজন যোধাবাঈ চলচ্চিত্রটি প্রকাশ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছিল এবং সেটি প্রকাশের বিরোধী ছিলেন।  

    পরিচালক আশুতোষ গোয়ারিকর স্বীকার করেছেন যে ছবির ৭০ শতাংশই তাঁর কল্পনা প্রসূত। যদিও ছবিটিতে দেখানো অনেক ঘটনাই বাস্তবে ঘটেছিল। কয়েকটি রাজপুত গোষ্ঠী দাবি করে যে যোধার বিয়ে হয়েছিল আকবরের সঙ্গে নয়, আকবরের পুত্র জাহাঙ্গিরের সঙ্গে। তারা এই ভুল তথ্য পরিবেশনের জন্য আশুতোষ গোয়ারিকরের কাছ থেকে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা দাবি করে। রাজস্থানের ৩০টি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটিকে দেখাতে দেওয়া হয় নি। 

    তথ্যাদি

    আশুতোষ গোয়ারিকর নয়া দিল্লি, আলিগড়, লক্ষ্ণৌ, আগ্রা এবং জয়পুর থেকে ঐতিহাসিক এবং বিদ্বান ব্যক্তিদের নিয়ে একটি গবেষক দল নিয়োগ করেন, যাতে ছবির ঐতিহাসিক সত্যতা বজায় থাকে। ছবিতে ৮০টিরও বেশি হাতি, ১০০টি ঘোড়া এবং ৫৫টি ঊট ব্যবহার করা হয়। ঢাল তলোয়ার হাতে তৎকালীন সাজসজ্জায় সজ্জিত প্রায় এক হাজার নর্তক-নর্তকীকে নিয়ে কারজাত-এর একটি ময়দানের প্রেক্ষাপটে ছবির প্রধান গান “আজিম-ও শান শাহেনশাহ”-এর চিত্রগ্রহণ করা হয়। ছবিতে তানিস্কের তৈরী প্রায় ৪০০০ কেজি ওজনের সোনার গয়না ব্যবহার করা হয়েছিল। ছবির বাজেট ছিলো ৩৭ কোটি টাকা (প্রায় ৭.৪২ মিলিয়ন USD)।

    পরিশেষে বলা যায়, যোধা-আকবর ছবিটি খুব ভালো লাগার মতো কারণ ছবিটিতে ইতিহাসের সাথে হৃদয়ের স্পর্শ আছে। এই ছবিতে এমন এক ভালবাসার কথা বলা হয়েছে যা, লিঙ্গ, ধর্ম, সংস্কৃতি সব গন্ডি ভেঙ্গে দেয় এবং সেই ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখায় যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা আর সহনশীলতা দুটি জোড়া স্তম্ভের মতো অবিচলভাবে আমদের রক্ষা করবে। আকবর এবং যোধা সেই লোভনীয় স্বপ্নেরই বহিঃপ্রকাশ।

    ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ; রেডিফ.কম; ইউটিউব

    16 I like it
    6 I don't like it
    পরবর্তী পোস্ট লোড করা হচ্ছে...

    escort bayan adapazarı Eskişehir bayan escort