স্বাস্থ্য নিয়ে যারা সচেতন বা একটু হলেও খোঁজ খবর রাখেন তাদের কারো কাছেই হয়তো কিটো ডায়েটের কথা অজানা নয়। কিটো ডায়েটের পুরো নাম কিটোজেনিক ডায়েট। বর্তমানে এই ডায়েটটি বেশ প্রচলিত ও জনপ্রিয়। অনেকেই বলেন এটি নাকি সবচেয়ে কম সময়ে ওজন কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু আসলেই কি তাই? সুস্থ থাকার জন্য কিটো ডায়েট কি আসলেই উপকারী? কিটো ডায়েট কী এবং এর সুবিধা-অসুবিধা সবকিছু নিয়ে জানাবো আজকের আর্টিকেলে।
কিটো ডায়েট কী?
কিটো ডায়েটের পুরো নাম কিটোজেনিক ডায়েট। এখানে আপনার শরীরে ত্বকের নিচে বা বিভিন্ন পেশির সাথে সংযুক্ত ফ্যাটকে কাজে লাগানো হয়। ডায়েটের একটি প্রকার হচ্ছে লো-কার্ব ডায়েট, যেখানে কম শর্করা নেওয়া হয়। কিটো ডায়েটকে সেই লো-কার্ব ডায়েটের সর্বোচ্চ পর্যায় বলা যেতে পারে। এই ডায়েটে যেসব খাবার থাকে তার মধ্যে শতাংশের পরিমাণে সবচেয়ে এগিয়ে ফ্যাট জাতীয় খাবার, এরপর আসে প্রোটিন জাতীয় খাবার। সবশেষে আসে শর্করা জাতীয় খাবার। অর্থাৎ তিন ধরনের খাবারের মধ্যে এখানে শর্করা জাতীয় খাবার সবচেয়ে কম থাকে।
সুস্থ থাকার জন্য কিটো ডায়েট কীভাবে কাজ করে?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, শর্করা কম থাকলে শরীর তার প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ কোথা থেকে পায়? আমাদের ব্রেইন শুধুমাত্র গ্লুকোজ ভেঙেই তার কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারে। কিন্তু কিটো ডায়েটে যখন শর্করাই স্বাভাবিকের চেয়ে কম নেওয়া হয় তখন ব্রেইনের এই স্বাভাবিক কাজে কি ব্যাঘাত ঘটে না? উত্তরটা খুব ইন্টারেস্টিং!
ব্রেইনের কাজ করার জন্য গ্লুকোজ দরকার, আবার গ্লুকোজ শুধুমাত্র শর্করা জাতীয় খাবার ছাড়াও বেশ কিছু উৎস থেকে তৈরি হতে পারে। আমাদের শরীরে বাড়তি যে শক্তি বা ক্যালরি থাকে সেগুলোকে আমাদের শরীর কিটোন বডি আকারে ফ্যাট হিসেবে জমা রাখে, যাতে করে কখনো যদি অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকতে হয় তাহলে যেন শরীর এই শক্তি ব্যবহার করে কাজ করতে পারে। ঠিক এই কারণেই আমরা রোজা রাখলে বা টানা অনেক সময় না খেয়ে থাকলেও হঠাৎ শক্তিহীন হয়ে পড়ি না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই জমা থাকা চর্বিগুলোই আপনার আমার শরীরকে মোটা করে দেয়। কিটো ডায়েট এই চর্বিগুলোকেই খরচ করে ফেলে। তাই ডায়েটে শর্করা কম থাকলেও ভয়ের কিছু নেই, আপনার শরীরের অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করেই শরীর আস্তে আস্তে স্লিম হয়ে যাবে!
ক্যালরি কাউন্ট
কিটো ডায়েটে খুবই কঠোরভাবে খাবারের কোন উপাদান কতটুকু থাকবে সেটা নির্ধারণ করা হয় এবং মেনে চলা হয়। আমাদের নরমাল ডায়েটে সাধারণত ৫০ ভাগ কার্বোহাইড্রেট, ২০ ভাগ প্রোটিন, ৩০ ভাগ ফ্যাট থাকে। কিন্তু এই ডায়েটে মোট খাবারের ৭০ ভাগ ফ্যাট থাকবে, ২৫ ভাগ থাকবে প্রোটিন আর ৫ ভাগ থাকবে শর্করা। অর্থাৎ যদি আপনি দিনে ১২০০ ক্যালরি খাবার গ্রহণ করেন তাহলে এর মধ্যে ফ্যাট থাকবে ৬০০ ক্যালরি। এই ফ্যাটগুলোও খুব সতর্কভাবে বাছাই করা, যে কোনো ফ্যাট এই কিটো ডায়েটে আপনি খেতে পারবেন না। কিটো ডায়েটে কী কী খাবেন সেগুলো আপনার শরীরের অবস্থা অনুযায়ী ডায়েটিশিয়ানের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা সবচেয়ে ভালো।
কিটো ডায়েট কত প্রকার?
কিটো ডায়েটের মধ্যেও আবার বেশ কিছু প্রকারভেদ আছে। মূলত বিভিন্ন শারীরিক কন্ডিশন ও ক্যালরির প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করেই এই ভাগগুলো করা হয়েছে।
স্ট্যান্ডার্ড কিটোজেনিক ডায়েট
এই কিটোজেনিক ডায়েটে ৫% কার্বোহাইড্রেট, ২০% প্রোটিন আর ৭৫% ফ্যাট থাকে।
টার্গেটেড কিটোজেনিক ডায়েট
এটাও অনেকটা স্ট্যান্ডার্ড কিটোজেনিক ডায়েটের মতোই, তবে একজন মানুষের শারীরিক পরিশ্রম কেমন হয় তার উপর অনেকটাই নির্ভর করে।
সাইক্লিক্যাল কিটোজেনিক ডায়েট
এই ডায়েটে সপ্তাহে ৫ দিন শর্করা বাদ থাকে এবং বাকি দুইদিন শর্করা যোগ করতে হয়।
হাই প্রোটিন কিটোজেনিক ডায়েট
এই ডায়েটে প্রোটিন গ্রহণের হার ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশে বেড়ে যায় এবং অন্যান্য উপাদান যেমন কার্বোহাইড্রেট ৫% ও ফ্যাট ৬০% থাকে। মূলত বডি বিল্ডাররা এই কিটোজেনিক ডায়েট ফলো করে থাকেন।
এই ডায়েটে যে খাবারগুলো খাওয়া যাবে
কিটো ডায়েটে অসম্পৃক্ত চর্বি গ্রহণ করা হয় এবং শর্করা সবচেয়ে কম খাওয়া হয়। এই ডায়েটে যে খাবারগুলো খেতে পারবেন- চর্বিযুক্ত গরুর মাংস, মুরগির মাংস, সব ধরনের মাছ, সামুদ্রিক টুনা মাছ, ডিম, বাটার, পনির, ঘি, সব ধরনের বাদাম, অলিভ অয়েল, কোকোনাট অয়েল, সান ফ্লাওয়ার অয়েল, লাল-সবুজ পাতার সবজি, পালং শাক, ব্রকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সব ধরনের মশলা, অ্যাভোকাডো, জলপাই, স্ট্রবেরি, লেবু বা সাইট্রাস ফল ইত্যাদি।
যা খাওয়া যাবে না
শর্করা জাতীয় খাবার কিটো ডায়েটে মানা। এছাড়াও কোনো খাবারকে কিটো ডায়েটের অন্তর্ভুক্ত হতে হলে কিছু শর্ত আছে। কিটো ডায়েটে থাকাকালীন যে খাবারগুলো খাওয়া যাবে না- চিনি বা মিষ্টিজাতীয় যেকোনো কিছু একেবারে বাদ, কোক বা কোমল পানীয়, চকোলেট, স্মুদি, আইসক্রিম, আটার তৈরি রুটি বা খাবার, পাস্তা, নুডুলস, ওটস, কর্নফ্লেক্স, সব ধরনের মিষ্টি ফলের জুস, ডাল, মূলজাতীয় খাবার, যেমন- আলু বা গাজর, যেকোনো ধরনের প্রসেসড ফুড বা প্রিজারভেটিভ দেওয়া খাবার ইত্যাদি।
কিটো ডায়েটের বৈশিষ্ট্য
কিটো ডায়েট মেনে চলা একটু কঠিন, এছাড়াও এখানে যেসব খাবার ব্যবহার করা হয় সেগুলো যথেষ্ট ব্যয়বহুল। তাই কিটো ডায়েট চাইলেও অনেকেই ফলো করতে পারেন না। তবে এই ডায়েট অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য ডায়েটের চেয়ে বেশি কার্যকরী, বিজ্ঞানীরা এর প্রমাণ পেয়েছেন বরাবরই। যেমন-
- দ্রুত ওজন কমে যায়
- ক্ষুধা লাগার প্রবণতা কমে যায়
- অল্প খাবার খেয়েও বেশিক্ষণ সতেজ থাকার প্রবণতা তৈরি হয়
- শরীরে ইনসুলিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়
- ব্লাড সুগারের পরিমাণ কমে যায়
- লিভারে জমে থাকা চর্বির পরিমাণ কমে যায়
- রক্তচাপ কমে যায়
কিটো ডায়েটের সমস্যা
অনেকগুলো ভালো দিক থাকলেও কিটো ডায়েট আল্টিমেটলি খুব ভালো বা একেবারে ত্রুটিহীন ডায়েট নয়। বরং এরও বেশ কিছু খারাপ দিক আছে। এক নজরে সেগুলো একবার দেখে আসা যাক-
- শরীরে ফাইবারের পরিমাণ কমে যায়
- শরীর থেকে অনেক বেশি পরিমাণে পানি বেরিয়ে যায়
- খাবার থেকে শরীর সব ধরনের ভিটামিন বা মিনারেল পায় না
- যারা ওয়ার্ক আউট করেন তাদের জন্য এই ডায়েট সবসময় ভালো নয়
- ক্লান্তি বেড়ে যায়
- ঘুম কমে যায়
- নিম্ন রক্তচাপ হতে পারে
- কিডনিতে পাথর হতে পারে
- কোষ্ঠকাঠিন্য ও হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়
স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিদের মাঝে কিটো ডায়েট বর্তমানে বেশ পরিচিত। শরীরের জন্য অবশ্যই এই ডায়েট উপকারী। আবার এটাও সত্যি, সবাই এই ডায়েটের উপযোগী নন। অনেকে নিজে থেকেই ক্যালরি কাউন্ট করে ডায়েট শুরু করেন। কিছুদিন পর ওজন কমলেও নানা সমস্যা দেখা যায়। তাই কিটো ডায়েট শুরুর আগে অবশ্যই ডায়েটিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক