মানব শরীরের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ অঙ্গ হলো লিভার বা যকৃৎ। সমস্ত দূষিত বর্জ্য পদার্থ বের করে শরীরকে সুস্থ রাখে লিভার। আমাদের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটির মারাত্মক একটি অসুখের নাম লিভার সিরোসিস। এই রোগে লিভার পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়ে। অর্থাৎ যকৃৎ তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারায়, বাড়ে মৃত্যুঝুঁকি। লিভার সিরোসিস এর কারণ, লক্ষণ ও জটিলতা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো আজকে।
লিভার সিরোসিস কী?
লিভারের বিভিন্ন রোগ যেমন- হেপাটাইটিস বা অতিরিক্ত মদ্যপানজনিত কারণে লিভারের যে সমস্ত ক্ষতি হয় তার শেষ পর্যায় হলো লিভার সিরোসিস। রোগব্যাধি বা অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে লিভার যত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রতি ক্ষেত্রে লিভার নিজে নিজে সেই ক্ষত ঠিক করার চেষ্টা করে। সেই চেষ্টায় লিভারে স্কার টিস্যু বা ফাইব্রোসিস গঠিত হয়। ফলে সেই জায়গায় লিভারের কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়। সিরোসিসের ফলে লিভারে যে সমস্ত ক্ষতিসাধন হয় তা সাধারণত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় না। কিন্তু যদি লিভার সিরোসিস প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা যায় এবং এর কারণ নির্ণয় করা যায় তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।
কেন হয়?
- দীর্ঘদিন মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে
- দীর্ঘস্থায়ী ভাইরাল হেপাটাইটিস (হেপাটাইটিস বি, সি ও ডি) রোগে আক্রান্ত থাকলে
- ফ্যাটি লিভার বা লিভারে চর্বি জমলে (নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার)
- শরীরে আয়রনের আধিক্য থাকলে
- সিস্টিক ফাইব্রোসিস হলে (বংশগত এই রোগে ফুসফুস, পরিপাকতন্ত্র সহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়)
- উইলসন্স ডিজিজ বা শরীরে তামা জাতীয় পদার্থের আধিক্য থাকলে
- জন্মগতভাবে পিত্তনালীর ত্রুটি থাকলে
- কোনো রোগে বা আঘাতে পিত্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হলে
- পিত্তনালী শক্ত হয়ে গেলে
- সিফিলিস বা ব্রুসেলোসিস এর মতো ইনফেকশন থাকলে
- ক্যান্সারের ঔষধ যেমন- মেথোট্রিক্সেট, যক্ষ্মার ঔষধ যেমন- আইসোনায়াজিড ইত্যাদি অতিরিক্ত সেবন করলে
লিভার সিরোসিসের লক্ষণ
লিভারের ব্যাপক ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত সাধারণত লিভার সিরোসিসের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তবে যখন কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
- ফ্যাটিগ বা অতিরিক্ত ক্লান্তিভাব
- সহজেই রক্তপাত বা ক্ষত হয়ে যাওয়া
- ক্ষুধামন্দা
- বমি বমি ভাব
- পায়ে অথবা গোড়ালিতে ফোলা (Oedema) ভাব
- ওজন কমে যাওয়া
- ত্বকে ও চোখে হলদে ভাব
- ত্বকে চুলকানি হওয়া
- এসাইটিস (Ascites) বা পেটে পানি জমা
- ত্বকের ওপর দিয়ে মাকড়সার জালের মত রক্তনালী ভেসে ওঠা
- হাতের তালুতে লালচে ভাব
- মহিলাদের ক্ষেত্রে-মেনোপজের সময় ছাড়াই মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া
- পুরুষদের ক্ষেত্রে- যৌন দুর্বলতা, স্তনের আকার বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেওয়া
- বিভ্রান্তি, তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব বা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা
কাদের ক্ষেত্রে এ রোগের ঝুঁকি বেশি?
লিভার সিরোসিস লিভারের অন্যান্য সমস্যা বা রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় লিভারের সমস্যার চিকিৎসা না করা হলে সময়ের সাথে সাথে এটি আরও খারাপ হবে এবং সিরোসিসে পরিণত হবে। যাদের অতিরিক্ত মদ্যপানের অভ্যাস আছে তাদের ক্ষেত্রে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এছাড়া অতিরিক্ত স্থুলতার কারণে নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার দেখা দেয়। যা পরবর্তীতে লিভার সিরোসিসে রূপ নেয়। ভাইরাল হেপাটাইটিসও লিভার সিরোসিসের ঝুঁকির কারণ। তবে দীর্ঘদিন হেপাটাইটিসে আক্রান্ত থাকলেই যে রোগী এ রোগে আক্রান্ত হবেন এমন নয়। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে লিভার সিরোসিসের একটি অন্যতম কারণ এই ভাইরাল হেপাটাইটিস।
জটিলতা
১) সিরোসিসের ফলে লিভারে স্বাভাবিক রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হয়, যার ফলস্বরূপ লিভারে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালিকায় উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। যাকে পোর্টাল হাইপারটেনশন বলে।
২) পোর্টাল হাইপারটেনশন এর কারণে প্লীহা বা স্প্লিন বড় হয়ে যেতে পারে এবং এতে শ্বেত রক্তকণিকা ও অণুচক্রিকা জমা হতে পারে। তাই রক্তে শ্বেত রক্তকণিকা বা অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে গেলে সেটিও লিভার সিরোসিসের লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। এছাড়া এর কারণে ছোট ছোট শিরায় রক্ত প্রবাহের চাপ বেড়ে যায়, যার ফলে মারাত্মক রক্ত ক্ষরণ হতে পারে। এর ফলে খাদ্যনালী ও পাকস্থলিতেও জীবননাশকারী রক্তক্ষরণ হতে পারে।
৩) পা ও পেট ফুলে যায়। লিভারের মূল রক্তনালিকা বা পোর্টাল শিরায় চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে পায়ে পানি আসে বা ইডিমা হতে পারে এবং পেটেও পানি জমতে পারে, যাকে এসাইটিস বলে। লিভারে রক্তের প্রোটিন বা অ্যালবুমিন তৈরি করার ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলেও শরীরে পানি জমে।
৪) এছাড়াও লিভারের ইনফেকশন, অপুষ্টি, জন্ডিস, লিভার ক্যান্সার ইত্যাদি রোগে ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারেন।
ঝুঁকি কমানোর উপায়
লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি কমাতে নিচের পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করতে পারেন। যেমন-
১) লিভারের কোনো রোগে আক্রান্ত থাকলে মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন।
২) স্বাস্থ্যকর খাবার খান। ফল ও সবজিযুক্ত ডায়েট চার্ট ফলো করুন। চর্বি ও ভাজা পোড়া জাতীয় খাবার বর্জন করুন।
৩) ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। শরীরের অতিরিক্ত চর্বি লিভারের ক্ষতি করতে পারে।
৪) হেপাটাইটিসের ঝুঁকি কমান। একই সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করলে, অরক্ষিত যৌন মিলনের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ও সি ছড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করুন।
৫) আপনি যদি এমন কোনো পেশায় জড়িত থাকেন যার মাধ্যমে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হতে পারেন, তাহলে পূর্ব সতর্কতা হিসেবে হেপাটাইটিসের টিকা গ্রহণ করুন।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসকে নীরব ঘাতক বলা হয়। বাংলাদেশে এর প্রাদুর্ভাব বেশ লক্ষণীয়। এই ভাইরাস দীর্ঘদিন দেহে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। এর সংক্রমণে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না করলে পরবর্তী সময়ে লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সারসহ নানা রকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। লিভার সিরোসিসে পুরোপুরি আরোগ্য লাভ হয় না। তবে সঠিক চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জটিলতা দূর করা যেতে পারে। তাই সময়মতো চিকিৎসা করুন, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক