উকুন একবার মাথায় এসে পড়লে সহজে তা দূর করা যায় না। তাই এই উকুন সমস্যা দূর করার জন্য একটু সময় নিয়ে চেষ্টা করতে হয়। এমনকি উকুন পুরোপুরি চলে যাবার পরেও সব সময় সাবধান থাকা উচিত। আমাদের দেশে বিভিন্ন উকুন নাশক সাবান এবং তেল আছে, উকুন মারার জন্য। যেমন – ইংলিস সাবান, মেঘলা তেল, মেডিকার প্লাস তেল প্রভৃতি। এ ধরনের সাবান বা তেল ব্যবহারে অনেকের চুল রুক্ষ, শুষ্ক হয়ে যায়।
অনেকের উকুন শেষ হওয়ার পাশাপাশি প্রচুর চুল পড়ে। তাছাড়া সবার মাথার ত্বকের জন্য এগুলো সহনশীল নয়। তবে ঘরোয়া কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে আপনি উকুন থেকে রক্ষা পেতে পারেন। চলুন আজ তাই দেখে নেই!
উকুন সমস্যা কিভাবে হয় ও তার সমাধানে ৮টি টিপস
কিভাবে বুঝবেন আপনার উকুন আছে?
উকুন থাকলে সাধারণত সারা দিনই মাথা চুলকাতে থাকে। উকুন সমস্যা থাকলে মাথার ত্বকে কোন কোন জায়গায় হালকা লাল হয়ে ফুলে থাকে। আবার অনেকের মাথায় একটুও চুলকায় না। এক্ষেত্রে চুলে উকুনের ডিম আছে কিনা দেখতে হবে। ডিমগুলো হলো ওভাল শেপ-এর আর অফহোয়াইট রঙের। এগুলো চুলের সাথে লেগে থাকে। আর উকুন থাকবে স্কাল্প-এ। যদি ডিমের মত কিছু চুলে পান এবং সেটা যদি খুব সহজেই হাত থেকে পড়ে যায়, বা খুব সহজেই আঙ্গুল দিয়ে সরানো যায় তাহলে সেটা উকুনের ডিম না। কারণ উকুনের ডিম এক ধরনের আঠালো উপাদানের মাধ্যমে চুলের সাথে খুব ভালো ভাবে আটকে থাকে। অনেকের ধারণা উকুন শুধু মাত্র অপরিষ্কার চুলে হয়। না এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। উকুন পরিষ্কার, অপরিষ্কার, লম্বা, ছোট যে কোন চুলেই হতে পারে। উকুনের বেঁচে থাকার জন্য শুধু দরকার হালকা গরম পরিবেশ আর এমন একটা স্থান যেখান থেকে তারা খুব সহজেই রক্ত নিতে পারবে। আর তাই মানুষের স্কাল্প হচ্ছে তাদের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান।
উকুন কিভাবে হয় বা ছড়ায়?
উকুন সমস্যা সাধারণত শিশুদের মাধ্যমে বেশি ছড়ায়। এক শিশুর জামা কাপড়, চুল থেকে আরেক শিশুর মাথায়, কাপড়ে উকুনের ডিম ছড়াতে পারে। যেসব শিশু স্কুলে পড়ে তাদের ক্ষেত্রে এরকম বেশি হয়। উকুন আছে এমন কেউ যদি কোথাও মাথা লাগিয়ে বসে তখন তার মাথা থেকে উকুনের ডিম সেখানে লেগে যেতে পারে। তারপর ঐ এক-ই স্থানে অন্য কেউ মাথা রাখলে তার মাথায়-ও উকুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন বড় বড় সোফাগুলোতে আমরা মাথা সোফার সাথে লাগিয়ে বসি বেশির ভাগ সময়। একই সুইমিং পুল বা একই পুকুরের পানির মাধ্যমে উকুন ছড়াতে পারে না। কারণ, উকুন সাঁতার পারে না। একজনের মাথার সাথে আরেক জনের মাথা লেগে থাকলে সেক্ষেত্রে উকুন ছড়াবে। যেমন- সন্তানের মাথায় উকুন থাকলে মায়ের মাথায় আসবেই। একই চিরুনি, তোয়ালে ব্যবহারের মাধ্যমেও ছড়ায়।
উকুন দূর করার ৮টি টিপস
১) নিট কম্ব ব্যবহার
সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে নিট কম্ব (উকুনের ডিম পরিষ্কারের জন্য চিরুনি) ব্যবহার করা। এই চিরুনি নিউমার্কেটসহ যে কোন দোকানেই পাওয়ার কথা। চুলগুলোকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে প্রথম ১ সপ্তাহ দিনে ৩ বার করে চুল আঁচড়াবেন। ১ সপ্তাহ পরে শুধু রাতে আঁচড়াবেন। ফলে উকুনের ডিম এবং একদম নতুন যে উকুন রয়েছে মাথায় সেগুলো দূর হয়ে যাবে। নিট কম্ব ব্যবহার করার পরে তা অবশ্যই ১০/১৫ মিনিট চুলায় রাখা গরম ফুটন্ত পানিতে রাখতে হবে আর নাহলে ৩০ মিনিট ভিনেগার-এ চুবিয়ে রাখতে হবে।
২) চুলে কন্ডিশনার লাগান
চুল ভালো মত আঁচড়ে নিন। এরপর কন্ডিশনার দিন চুলে। কিছুক্ষণ চুলে এভাবে কন্ডিশনার রেখে দিন। যেহেতু কন্ডিশনার খুব পিচ্ছিল, তাই বড় উকুনগুলোর চুলের সাথে আটকে থাকা বা চলা ফেরা করা খুবই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এবার নিট কম্ব দিয়ে আঁচড়ে নিলে উকুন আর চুলের সাথে লেগে থাকতে পারবে না।
৩) রসুন ও লেবুর প্যাক
১০/১২ টি রসুনের কোয়া পেস্ট করে নিন। সাথে ২/৩ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে নিন। এবার আধা ঘণ্টা পেস্ট-টি মাথার ত্বকে লাগিয়ে রাখুন। চুলে লাগানোর দরকার নেই। এরপর ধুয়ে ফেলুন। এভাবে কয়েকদিন করতে হবে।
৫) অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার ব্যবহার করুন
শ্যাম্পু করার আগে একবার আর শ্যাম্পু করার পরে আরেকবার অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার দিয়ে পুরো চুল ভিজিয়ে নিন অথবা চুল ভিনেগার দিয়ে ভালোভাবে ভিজিয়ে ৩/৪ মিনিট রেখে দিন। এইটুকু সময় শুকনো তোয়ালে দিয়ে চুল আলতোভাবে মাথার উপর উচু করে বেঁধে রাখবেন। ৩/৪ মিনিট পর নিট কম্ব দিয়ে আঁচড়ে নিন।
৬) ওভার নাইট ট্রিটমেন্ট
রাতে ঘুমোতে যাবার আগে প্রথমে অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার দিয়ে চুল ভালো মত ভিজিয়ে নিন। তারপর চুলে লাগানো ভিনেগার পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে চুলে নারিকেল তেল দিন। এখন একটি শাওয়ার ক্যাপ দিয়ে মাথা ঢেকে রাখুন। ৬/৭ ঘণ্টা এভাবেই রেখে দিন সারা রাত। যেহেতু এতক্ষণ রাখতে হবে তাই রাতের কথা বললাম। আপনি চাইলে দিনের বেলাতেও এটা করতে পারেন। ৬/৭ ঘণ্টা পরে নিট কম্ব দিয়ে চুল আঁচড়ে নিন। চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এক টানা ৫/৬ দিন এই নিয়মটি মেনে চলুন উকুন দূর করার জন্য। পেপার টাওয়েল বা কোন সাদা বড় কাগজ নিন। পেপার টাওয়েল-এর আরেক নাম কিচেন রোল বা কিচেন পেপারও। আগোরা-তে পেয়ে যাবেন। পেপার টাওয়েল-এর উপর নিট কম্ব দিয়ে চুল কয়েকবার করে আঁচড়াতে থাকুন। উকুনের ডিম এবং উকুন বের হয়ে আসবে।
৬) হেয়ার স্ট্রেইটনার ব্যবহার
হেয়ার স্ট্রেইটনার যদি-ও চুলের জন্য ভালো না, তারপরেও উকুন মারার জন্য এটি ব্যবহার করতে পারেন সপ্তাহে একবার। এসব ট্রিটমেন্ট চলার পাশাপাশি একটু বেশি তাপসহ হেয়ার স্ট্রেটনার ব্যবহার করলে চুলে আটকে থাকা উকুন এবং উকুনের ডিম নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ, উকুন হালকা গরম পরিবেশে টিকে থাকতে পারে, অতিরিক্ত গরমে নয়। এরপর শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে ফেলবেন। তবে এ পদ্ধতিটি তাদের জন্য যাদের চুল কম পড়ে আর যাদের চুলের স্বাস্থ্য ভালো।
৭) বেশি মাত্রায় শ্যাম্পু করা যাবে না
চুল বার বার শ্যম্পু করলে উকুন দূর করা যায় না বরং এতে তাদের লাভ হয়। বার বার শ্যাম্পু করার ফলে মাথার ত্বকের তেল ধুয়ে চলে যায়, ফলে রক্ত নিতে উকুনের আরও বেশি সুবিধা হয়।
৮) ফেইসওয়াশ চুলে লাগান
যে কোন ফেইসওয়াশ চুলে লাগান। এরপর একবার চুল আঁচড়ে নিন অতিরিক্ত ফেইসওয়াশ দূর করার জন্য। এখন হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিন। এর ফলে উকুন নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। কিন্তু এই পদ্ধতি রাতে করলে ভালো। কারণ চুলে ফেইসওয়াশ প্রায় ৮ ঘণ্টার বেশি রাখতে হবে। যেহেতু উকুন নিঃশ্বাস না নিয়ে প্রায় ৮ ঘণ্টার মত বেঁচে থাকতে পারে। সকালে চুল ধুয়ে ফেলবেন। আর সাথে অবশ্যি বালিশের কাপড়, বিছানার চাদর গরম পানিতে ধুয়ে ফেলবেন। এটা প্রতি সপ্তাহে ২/৩ দিন করতে পারেন উকুন মারার জন্য।
সতর্কতা
১) বেণী করে রাখুন
চুল অনেক বড় হলে বেণী করে বা খোপা করে যাওয়া ভালো। চুল এমন ভাবে রাখবেন যেন অন্য কারও চুলের সাথে না লাগে। যেমন বাসে অনেক ভিড় থাকে আর এ অবস্থায় চুল খোলা রেখে এমন কারও পাশে যদি বসতে হয় বা দাঁড়াতে হয় যার মাথায় আগে থেকেই উকুন আছে তাহলে আপনার মাথায়-ও সেই উকুন চলে আসতে পারে। আবার বাসে দাঁড়িয়ে যেতে হলে আর অনেক ভিড় থাকলে আপনার চুল খোলা থাকুক আর বেণী করাই থাকুক কাঁধের উপর দিয়ে সামনে এনে রাখুন যেন অন্য কোন মেয়ের খোলা চুলের সাথে না লাগে।
২) চিরুনি, বালিশ, তোয়ালে শেয়ার করবেন না
কখনো নিজের চিরুনি, বালিশ, হেয়ার ব্যান্ড, তোয়ালে, কাপড় ছাড়া অন্যেরটা ব্যবহার করবেন না।
৩) বালিশের কাভার ধুয়ে রাখবেন
সপ্তাহে এক দিন বালিশের কাভার গরম সাবান পানিতে ধুবেন।
৪) কম্ব পরিষ্কার রাখবেন
নিট কম্ব আর সাধারণ চিরুণি সব সময় পরিষ্কার করবেন। ভিনেগারে আধা ঘণ্টা করে চুবিয়ে রাখলে ভালো।
তাহলে উকুন নিয়ে আর বিভ্রান্ত না হয়ে আজ থেকেই টিপসগুলো মেনে চলুন আর থাকুন কনফিডেন্ট!
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ