প্রতি বছর মেডিকেল সায়েন্স এগিয়ে চলেছে। বিজ্ঞানের সব শাখার মত চিকিৎসা বিজ্ঞানেও নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। মানুষের কষ্ট লাঘব করতে বিজ্ঞানীরা রাত দিন পরিশ্রম করছেন। ২০১৩ সালের নতুন কিছু উদ্ভাবন আপনাদের জানাতেই আজকের এই লেখাটি।
০১- বেরিয়াট্রিক সার্জারির (মোটা হওয়া কমাতে যে অপারেশন করা হয়) মাধ্যমে ডায়াবেটিস কনট্রোল করাঃ
এই অপারেশনের মাধ্যমে পাকস্থলীর আকার কমিয়ে আনা হবে যাতে একজন মানুষ একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্বল্প পরিমাণ খায়। এই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস চিকিৎসার মূলনীতি এই যে একজন মানুষ দিনে ৩ বার ভারী খাবার না খেয়ে, ৬ বার অল্প করে নাস্তা করবে। ভারী খাবার খেলে রক্তের গ্লুকোজ হুট করে উঠা- নামা করে। এই অপারেশন একাধারে ওজন কমাবে, আবার রক্তের চিনিকে নিয়ন্ত্রণেও রাখবে।
০২- নিউরোমডুলেশনের ( বাইরে থেকে স্টিমুলেশন দিয়ে ) মাধ্যমে মাথা ব্যথা কমানোঃ
সাধারণত মাথা ধরার নির্দিষ্ট কোন কারণ থাকে না। মাইগ্রেইন, টেনশন , ক্লাস্টার বিভিন্ন ধরনের মাথা ব্যথা হতে পারে। নিউরোমডুলেশনের মাধ্যমে বাইরে থেকে ইলেক্ট্রিকেল স্টিমুলেশনের মাধ্যমে ব্যথা দূর করা সম্ভব। মাত্র ১০ মিনিটে ৭০% রোগীর মাথা ব্যথা সেরে যাবে।
০৩- মাস স্পেক্ট্রোমেট্রির ( স্পেক্ট্রোমিটার নামক এক ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে টেস্ট করা ) মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া নির্ণয় করাঃ
একজন মানুষের শরীরে কী কী ক্ষতিকারক জীবাণু আছে তা যদি আগে থেকেই জেনে নেয়া যেত তবে কত মানুষকে বাঁচানো সম্ভব বা কত মানুষের কষ্ট লাঘব করা সম্ভব একবার ভেবে দেখুন তো!! হ্যাঁ, এবার বিজ্ঞানীরা এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন যার মাধ্যমে কয়েক দিনের মধ্যে একটি মানুষের শরীরে বসবাসরত ব্যাকটেরিয়া যা তার শরীরে ইনফেকশন করে রোগ সৃষ্টি করতে পারে, তা ডিটেক্ট করা হবে। কাজেই ডাক্তার এবং রোগীকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, যে সময়ে স্পেক্ট্রোমেট্রি রোগ নির্ণয় করবে। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় এটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।
০৪- অ্যাডভান্সড প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্য নতুন ওষুধঃ
বয়স্ক পুরুষদের মৃত্যুর জন্যে প্রোস্টেট ক্যান্সার অন্যতম কারণ। অ্যাডভান্সড হওয়া মানে ক্যান্সারটি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে, যাকে মেটাস্টেসিস বলে। আলাদা গ্রুপের বিজ্ঞানীরা ৫ টি নতুন ওষুধ আবিষ্কার করেছেন, যা ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে। Radium-223-dichloride নামে নতুন একটি ওষুধ এই বছর স্বীকৃতির অপেক্ষায় আছে, যা প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যাক্তিকে আগের থেকে বেশি বছর বাঁচতে সাহায্য করবে।
০৫- হাতে ধরা স্ক্যান মেশিনের মাধ্যমে মেলানোমা নির্ণয়ঃ
UV radiation exposure এর কারণে চামড়ায় একটি ক্যান্সার হতে পারে, যাকে মেলানোমা বলে। উপরের যন্ত্রটির মাধ্যমে কোন রকম কাটাকুটি ছাড়াই এই অসুখ নির্ণয় করা সম্ভব। এই স্ক্যানের মাধ্যমে শুধু যে তাড়াতাড়ি নির্ণয় সম্ভব তাই নয়, এর ফলে চিকিৎসার খরচ, মৃত্যুর হারও কমে যাবে।
০৬- লেজারের মাধ্যমে সেকেন্ডেরও কম সময়ে চোখের ছানির চিকিৎসাঃ
সেকেন্ডেরও কম সময়ে নিখুঁত ভাবে চোখের অতি ক্ষুদ্র অংশও কাটা সম্ভব হবে। নরমাল অপারেশনের ব্লেড দিয়ে কাটলে এত নিখুঁত করা সম্ভব নয়। ছানি পড়া চোখের জন্যে এটি অপারেশন বিহীন চিকিৎসা। এই চিকিৎসার পর দৃষ্টি শক্তি অন্যান্য অপারেশনের তুলনায় ভালো হবে।
০৭- শরীরের বাইরে কৃত্তিম উপায়ে ফুসফুসের রক্ত সঞ্চালনঃ
কিছু নন-ম্যালিগন্যান্ট (ক্যান্সার নয় এমন) রোগ আছে যার ফলে ফুসফুস নষ্ট হয়ে যায়। যখন অন্য কোন অপারেশন বা ওষুধে লাভ হয় না তখন ফুসফুস প্রতিস্থাপনই এর সঠিক চিকিৎসা। কিন্তু দাতা ফুসফুসের মাত্র ১৫ % ই শেষ পর্যন্ত প্রতিস্থাপনে ব্যবহার করা যায়। কারণ দাতা ব্যক্তির মস্তিস্কের মৃত্যুর ফলে এবং বাইরের পরিবেশের প্রভাবে ফুসফুস এর কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তাই সেই দাতা ফুসফুস কে বাইরে রেখেই রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে সচল রাখার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। এর ফলে প্রতিস্থাপন অনেক সুন্দর ভাবে সম্পাদন সম্ভব বলে তারা আশা করছেন।
০৮ – জটিল এনিউরিজমের চিকিৎসাঃ
এনিউরিজম ( রক্তনালির কোন অংশ প্রসারিত হয়ে যায়, যার ফলে স্থানটি দুর্বল হয়ে যায় এবং যে কোন সময় ফেটে যেতে পারে ) হলে রক্তপাত, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, শক এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। বিজ্ঞানীরা নতুন এক ধরনের স্টেন্ট আবিস্কার করেছেন যা রক্ত নালিকার দেয়াল কে মজবুত করবে। এন্ডোগ্রাফট এর মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা হত। এন্ডোগ্রাফট লাগানোর আগ পর্যন্ত ফ্যাব্রিক গ্রাফট ব্যবহার করা হয়। ফলে রোগীকে দু বার অপারেশনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু নতুন এই আবিষ্কার এই কষ্টকেও কমিয়ে দেবে।
০৯- স্তনের টমোসিন্থেসিস( স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের নতুন ও উন্নত টেস্টঃ
এটি একটি 3D mammography, যার মাধ্যমে অতি দ্রুত স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা সম্ভব। ২০১১ সালে FDA এই নতুন টেস্টকে স্বীকৃতি দিয়েছে। 2D mammography কে বাতিল করা হয়নি। এটিও এর পাশাপাশি ব্যবহার করা হবে । টেস্টটির সুবিধা এই যে এর ফলে বার বার mammography করার প্রয়োজন হবে না।
লিখেছেনঃ শারমিন আখতার চৌধুরী
ছবিঃ ওয়েবপার্ক্স.কম