টুইন বেবি নিয়ে আপনি কতটুকু জানেন? আচ্ছা, এ নিয়ে বলার পূর্বে কিছুদিন আগের এক মজার ঘটনা শেয়ার করি- আমাদের বাড়ির তিন তলায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। বাবা-মা আর দুই মেয়ের ছোট্ট ছিমছাম পরিবার । সেদিন বিকেলবেলা মা গিয়েছিলেন পরিচিত হতে। বাসায় ফিরে ফুরফুরা মেজাজে বলছেন-“জানিস, নতুন যারা এসেছে ওরা বেশ ভালো, মিশুক খুব। তরু মেয়েটা যে কী ভালো চা বানায়! আচার-ব্যবহার খুব ভালো। একটা ভালো প্রতিবেশী পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।”
পরদিন সকালে মাকে নিয়ে মার্কেটে যাব তাই রিক্সার জন্য গেটে দাড়িয়ে ছিলাম। তখনই একটা রিক্সা এসে থামলো। মাকে হাসি মুখে সালাম দিল। মাও তার উত্তর দিয়ে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল – “কাল তোকে তরুর কথা বললাম না! ওই হচ্ছে তরু।” সাথে সাথে মেয়েটি বলে উঠল- “আন্টি, আপনার একটু ভুল হয়েছে। আমি তরু নই, লতা।” তখন মায়ের বিস্ময় ভরা মুখটা দেখার মত হয়েছিল। পরে জানা গেল তরু ও লতা দু’জন যমজ বোন। বাড়ির গেটে কথা বলা মেয়েটি ছিল লতা। যাকে মা তরু ভেবেছিলেন। মায়ের আর দোষ কি বলুন? হুবহু এক দেখতে দুজন। আলাদা করবার উপায় নেই একদম। আচ্ছা বলুন তো, কি এই যমজ বা টুইন বেবি রহস্য? কেন হয় টুইন বেবি ? টুইন-দের পারস্পরিক সম্পর্কটাই বা কেমন হয়? চলুন একটু ডিটেইলস-এ জানা যাক।
টুইন বেবি বা যমজ কী?
“কিভাবে যমজ সন্তান হওয়া সম্ভব?”
“চাইলেই কি কেউ যমজ সন্তানের জন্ম দিতে পারে?”
“যমজ ফল খেলে কি সত্যিই যমজ সন্তান হয়?”
– এমন অনেক প্রশ্নই আমরা রাজ্যের আগ্রহ নিয়ে যমজদের কিংবা সদ্যজাত যমজ সন্তানের অভিভাবকদের করে থাকি। চলুন প্রশ্নগুলোর উত্তর একটু খুঁজে নেই!
সবার আগে ভেতর থেকে “জোড়া বা যমজ ফল খেলে যময সন্তান হয়”– এই কুসংস্কারকে দূর করুন!
এখন আসুন শুরু করি যমজ নিয়ে তথ্যযাত্রা। “যমজ কী?”– তা বলতে গেলে বলতে হয় নারীত্বের কথা। প্রত্যেক নারী তার গর্ভে একবারে একটি মাত্র সন্তান ধারন করবেন এটা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু যখন দুই বা ততোধিক সন্তান ধারন করেন তখনই তাদের যমজ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব একই সময়ে একাধিক সন্তান ধারন করা? অবশ্যই এটি বিধাতার সৃষ্ট একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। নারীর ডিম্বাশয় হতে প্রতি মাসে একটি করে পরিপক্ক ডিম্বাণু জরায়ুতে আসে। এই ডিম্বাণু ও পুরুষের শুক্রাণু মিলে যে জাইগোট তৈরি হয়, তার থেকেই সন্তান জন্ম নিয়ে থাকে। এটাতো কেবল মাত্র একটি সন্তান জন্মের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যা কিনা মোটামুটি সবারই জানা!
টুইন বেবি বা যমজ সন্তান এর জন্ম
ওয়েল, যমজ সন্তান প্রধানত দুটি পদ্ধতিতে জন্ম নিয়ে থাকে।
- মনোজাইগোটিক বা অভিন্ন বা Identical twin
- ডাই-জাইগোটিক বা ভিন্ন বা Non-Identical twin
মনোজাইগোটিক বা অভিন্ন বা Identical Twin
এক্ষেত্রে দুটি ডিম্বাশয়ের একটি হতে একটি ডিম্বাণু নির্গত হয় ও শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে একটি জাইগোট গঠন করে, কিন্তু জটিল বিভাজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরে তা সমান দুই ভাগে বিভক্ত হয়, তখন যমজ সন্তান জন্মলাভ করে। এভাবে ততোধিক যমজ সন্তানও হতে পারে। একটি জাইগোট বিভক্ত হয়েই এই পদ্ধতিতে যমজ সন্তান হয় বলে এদের চারিত্রিক ও গাঠনিক বৈশিষ্ট্য প্রায় অভিন্ন হয়ে থাকে। এদের পরম আত্নীয়রাও তাদের সনাক্ত করতে বেশ হিমশিম খেয়ে থাকেন। এদের বলতে পারেন একেবারে কার্বন কপি।
ডাইজাইগোটিক বা ভিন্ন বা Non-identical Twin
একে ফ্র্যাটারনাল টুইন-ও বলা হয়। এক্ষেত্রে নারীর ডিম্বাশয় হতে একটি ডিম্বাণুর জাগায় দুটি নির্গত হয়। এই দুটির প্রতিটি ডিম্বাণু পৃথক পৃথক শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে দুটি জাইগোট উৎপন্ন হয় এবং এর থেকেই তখন যমজ সন্তান জন্মলাভ করে থাকে। এই যমজ সন্তানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গাঠনিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হওয়ার সাথে সাথে রক্তের গ্রুপও ভিন্ন হতে পারে বা আবার একই রকম হতে পারে ।
এছাড়াও আরও দুটি কমপ্লিকেটেড টাইপ টুইনস আছে-
- প্রায় অভিন্ন বা Semi–identical twin
- যুগ্ম বা Conjoined twin
প্রায় অভিন্ন বা Semi-identical twin
কখনো কখনো একটি ডিম্বাণু দুটি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়। হতে পারে আগে শুক্রাণু দুটি দ্বারা নিষিক্ত হয়ে পরে শুক্রাণুসহ সমান ভাগে জাইগোট বিভক্ত হয় কিংবা এমনও হয়ে থাকে যে আগেই একটি ডিম্বাণু দ্বিবিভাজিত হয়ে আলাদা দুটি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়। এই সেমি আইডেন্টিক্যাল টুইন-দের মায়ের থেকে প্রাপ্ত জিনের বৈশিষ্ট্য একই রকম হয় কিন্তু দুটি ভিন্ন শুক্রাণু লাভের কারণে বাবার থেকে প্রাপ্ত জিনের বৈশিষ্ট্য যমজ সন্তানদের মধ্যে ভিন্ন হয়।
যুগ্ম বা Conjoined twin
যমজ সন্তান প্রতিটি মানুষের কাছে যেমন আনন্দ-উদ্বেগ তেমনি যুগ্ম যমজ সন্তানেরা সীমাহীন কষ্টের দাগ কেটে দিতে পারে। এরা মনোজাইগোটিক টাইপ হলেও জন্ম থেকেই এই যমজেরা একে অপরের সাথে যুগ্মভাবে থাকে। জাইগোট এক্ষেত্রে কমপ্লিটলি আলাদা হতে গিয়েও হতে পারে না। কিছু অরগান জোড়া লেগে থাকে। এদের সংখ্যা খুবই কম যা পুরো পৃথিবীর মানুষের মাত্র ৩% । এই যুগ্ম যমজ সন্তানদের আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বিভিন্ন অস্ত্রপচারের মাধ্যমে পৃথক করে সফলও হয়েছে তবে তার দৃষ্টান্ত অতি নগণ্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অস্ত্রপচারের সময় মৃত্যুর হাতছানিতে পৃথিবী ছেড়ে যায়।
টুইন বেবি বা জমজ সন্তান কেন হয়?
কীভাবে যমজ সন্তান হয় এই রহস্যতো মিটলো। কিন্তু এখনো “কেন” বাকি রয়েছে প্রশ্নের খাতায়। পূর্বেই উল্লেখ্য, যমজ সন্তান সম্পূর্ণভাবে বিধাতার রহস্য খেলা। কেউ চাইলেই যমজ সন্তানের জনক-জননী হতে পারে না। তবে বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে যমজ সন্তান হবার পেছনে কতগুলো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, যেসব মহিলা ফলিক এসিড বেশি গ্রহণ করে থাকেন তাদের যমজ সন্তান হবার সম্ভাবনা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০% বেশি। এছাড়াও যদি মায়ের বংশে আগে কেউ যমজ সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে তবে তার যমজ সন্তান হবার সম্ভাবনা অনেকাংশেই বেড়ে যায়। যেসব নারী ওজন ও উচ্চতায় বেশি তাদেরও যমজ সন্তান হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এরপরেও হরমোনজনিত কারণে, প্রকৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের কারণেও যমজ সন্তান হয়ে থাকে।
আচ্ছা, যমজ সন্তানদের জীবন-যাপন, বন্ধুত্ব কী আমাদের চেয়ে খানিকটা অন্য রকম?
উহু, না!!! ওরাও আমাদেরই মতন সহজ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করে। যমজ হোক বা না হোক, আমরা সবাই সাধারণ ও স্বাভাবিক মানুষ রে বাবা! যদি বন্ধুত্বের কথা আসে- একথা সত্য যে, জন্মলগ্ন থেকেই যমজেরা একে অপরের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। একে অপরের মানিক-জোড় যাকে বলে। একই সাথে হয় তাদের নাওয়া, খাওয়া, পড়া আর বাকি সবকিছু। অনেকেই হয়তো দেখেছেন যমজ সন্তানেরা বেশিরভাগ একই রকম পোশাক পরে থাকে। ছোট্ট খেলনাও চাই অবিকল এক।
এ থেকে বোঝাই যায় যে মনন ও রুচিবোধও তাদের অনেকটাই এক। বন্ধুদের আড্ডায় কি কোনো পারিবারিক পরিবেশের ভীড়ে কেউ যদি কখোনো হেয়প্রতিপন্ন করে কথা বলে দু’জনের একজনকে, তখন হাসিমাখা মুখের পিছনে মেঘকালো মলিন মুখখানি আড়াল পায় না অপর জনের কাছে। ঠিক ধরতে পারে কষ্টের অনুভূতি। অনেকটা যেন মনের মাঝে বিচরণের মত। সময়-অসময়ে ভাগাভাগি করে নেয় একে অপরের দুঃখ-কষ্ট।
তাহলে, মুভিতে যেমন দেখায়, একজন মার খেলে অন্য জন একই জাগায় ব্যথা পায়, তা কি সত্যি?
উত্তর- নাহ, সেটা সত্যি নয়। তবে এটা সত্যি যে ,তাদের একে অপরের অনুভব করার ক্ষমতা অত্যন্ত তীব্র।আচ্ছা, দেখতে এক, স্বভাবেও এক , তবে কি তাদের মেধাও এক? সব কিছুর উত্তর বরং এক কথাতেী দেই- যমজদের জিনগত বিন্যাস অনেক মিলের মাঝে, অল্প হলেও কিন্তু ভিন্ন।
টুইন বেবি বা জমজ সন্তানদের জীবনযাপন
একসাথে বেড়ে ওঠার কারনেই যমজেরা চিন্তায়–স্বভাবে এক হয়ে থাকে। তবে তাদের মধ্যে ভিন্ন মতামতও দেখা যায়। হতেই পারে দু’জনের একজন চিত্রশিল্পী ও অন্যজন প্রকৌশলী। এবার দেখুন অমিল কত! এত এত মিলের মাঝেও কিন্তু অমিলের বাস। এর থেকে খুনসুটি, কথা কাটাকাটি কম হয় না তাদের। যেমন মিল তেমন ঝগড়া। আবার একটু পরেই গলায় গলায় ভাব। বলতে পারেন, এই মেঘ এই বৃষ্টি । বাবা-মা শখ করে একই রকম পোশাক পড়ান । এই ব্যাপারটা অনেকেরই অপছন্দ । অনেকেই চায় আলাদা হতে। অন্যদের বিব্রত করতে চায় না তারা। অনেকেই বলেন, যমজ হওয়াতে মাঝেমধ্যে তাদের নিজেদেরই ঝামেলা পোহাতে হয় । পরীক্ষার হল এমন একটি ঝামেলার সময়।
যমজ সন্তানেরা বিশাল এই পৃথিবীতে একে অপরের আস্থা। খানিক সময়ের ব্যবধান মাত্র, এই দু-এক মিনিট হবে । এর মাঝেই একজন বড় আর একজন ছোট। কেউ কেউ বড় হওয়াতে বেশ গর্ববোধও করে। নিজের ভালোবাসার ছত্রছায়ায় আগলে রাখে তার ছোট্টটিকে । সেও থাকে নির্ভয়ে হাতে হাত ধরে । যতই জানি না কেন যমজদের সম্পর্কে, একই রকম দেখতে দু’জন মানুষ যখন চোখের সামনে দাঁড়ায়, বিস্ময়ে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যমজ সন্তানদের নিয়ে শুধু সাধারণ মানুষই আগ্রহ প্রকাশ করে না, করে থাকে অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষকরাও। যমজ সন্তানদের প্রতি আগ্রহের ফল স্বরূপ – যমজ মেলারও আয়োজন করা হয়। সেখানে একত্রিত হয় যমজেরা। তারা নিজেদের মধ্যকার এমন সাদৃশ্য নিয়ে বেশ মজাই পায়। অনেকে বন্ধুদের মজা করে বোকাও বানায়।
যমজ সন্তান যেন ঠিক সাধারণের মাঝে অসাধারণ। রহস্যভরে বলাই যায় তারা মানব রহস্যের বারমুডা ট্রায়েঙ্গেল। বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা প্রতিনিয়ত চলছে তাদের ঘিরে। আশা রাখি চিকিৎসা বিজ্ঞান চিরকালের মত জয়ী হবে যুগ্ম যমজ সন্তানদের স্বাভাবিক জীবন উপহার দেবার মরণ যুদ্ধে। হয়তো আর বেশিদিন নেই যেদিন পৃথিবীতে কোন যুগ্ম যমজ সন্তান দেখে আমাদের কষ্ট পেতে হবে! আসলেই, বাবা-মায়ের জন্য যমজ সন্তান সত্যিই একটা সুন্দর মিরাকুলাস গিফট।
ছবি- onebauer.media