পৃথিবীতে হাজারো বিস্ময়ের মধ্যে সম্ভবত একজন নতুন শিশুর জন্ম প্রকৃতি ও সৃষ্টিকর্তার দেওয়া এক পরম আশীর্বাদ ও বিস্ময়ের নাম। একটি ক্ষুদ্র ভ্রুণ মাতৃগর্ভে ৯ মাস ধরে তিল তিল করে বেড়ে ওঠে। এরপর একদিন আসে সেই কাঙ্ক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ। যখন শিশু তার মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আগমন করে। শিশুর জন্ম নিয়ে মা– বাবা ও তার পরিজনদের মধ্যে ভয়–দুশ্চিন্তা, আনন্দ সব কিছুই একসাথে বিরাজ করে থাকে। একটি সুস্থ ও পরিপূর্ণ শিশু জন্মাবে সেটা সবারই কামনা থাকে। পৃথিবীতে আসার পরপরই সদ্য জন্ম নেয়া শিশু বা নবজাতকের প্রয়োজন বিশেষ যত্ন। সেই সাথে দরকার বাড়তি সতর্কতা। আর সময়টা যদি হয় শীতকাল, তবে তো আরও বেশি সতর্কতা প্রয়োজন। আমাদের আজকের লেখা নবজাতকের শীতকালীন যত্নআত্তি নিয়েই। চলুন তবে দেখে নেই নবজাতকের যত্নে ১২টি টিপস!
নবজাতকের শীতকালীন যত্নআত্তি নিয়ে আলোচনা
নবজাতকের শীতকালীন যত্নআত্তি করতে গেলে বেশ কিছু বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। তবে তার আগে জেনে নিন কেন নবজাতকদের বিশেষ পরিচর্যা প্রয়োজন।
নবজাতকদের বিশেষ পরিচর্যা প্রয়োজন কেন?
সদ্যজাত শিশু থেকে জন্মের ২৮ দিন পর্যন্ত বয়সী শিশুকেই নবজাতক শিশু বলে। মাতৃগর্ভ ও পৃথিবীর প্রকৃতির মধ্যে বিস্তর ফারাক। একজন নবজাতকের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হল পৃথিবীর প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া। একজন নবজাতক যখন জন্ম নেয় তখন তার শরীরের সব অংশ যেমন: পাকস্থলী, কিডনি, মস্তিষ্ক ইত্যাদি পরিপূর্ণ থাকে না। সময়ের সাথে সাথে নবজাতকের শরীর পরিপূর্ণতা পায়। এছাড়াও তার ত্বক অনেক সংবেদনশীল, পৃথিবীর আলো– বাতাসের সংস্পর্শের সাথে মানিয়ে নিতেও তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। এসব কারণে নবজাতকের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন।
শিশুর জন্মের প্রথম ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়কে তাই বলা হয় গোল্ডেন ওয়ান আওয়ার কেয়ার। জন্মের সাথে সাথে নবজাতককে পরিষ্কার করে তোয়ালে বা কাঁথা দিয়ে পেঁচিয়ে রাখতে হবে। এইসময়ের মধ্যে শিশুকে মায়ের শাল-দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এই শাল–দুধ শিশুর জন্য প্রাকৃতিক টীকা হিসেবেও কাজ করে। এই দুধের কারণে শিশুর শরীরে রোগ–প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠতে সাহায্য করে থাকে। এর পাশাপাশি শিশুকে মায়ের শরীরের সংস্পর্শে আনাটা খুব জরুরি। মায়ের শরীরের স্পর্শে শিশু নিজেকে নিরাপদ মনে করে। স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানের কিছুক্ষণের মধ্যেই মা তার বাচ্চাকে নিজের কোলে নিতে পারেন। তবে সিজারিয়ান ডেলিভারিতে মা সেই সময় থাকেন পোস্ট–অপারেটিভ রুমে। তখনও নার্স বা নবজাতকের কোন নিকট আত্মীয়ের দ্বারা বাচ্চাকে কিছু সময় মায়ের সংস্পর্শে রাখাটা জরুরি।
নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়কালের ঋতু অনুযায়ী তার যত্নের ব্যবস্থা করতে হবে। নবজাতক যেই ঋতুতে জন্ম গ্রহন করবে সেই ঋতু অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। গরম, শীত বা বর্ষার জন্য আলাদা আলাদা যত্নের ব্যবস্থা নিতে হবে। একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রত্যেক অভিভাবক ও নবজাতকের আত্মীয় পরিজনকে মনে রাখতে যে, প্রতিটা নবজাতক আলাদা। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নবজাতকের জন্য কার্যকরী পরিচর্যা করতে হবে।
নবজাতকের শীতকালীন যত্নআত্তি
১) শীতকালে নবজাতকের মা ও অন্য যারাই বাচ্চার দেখাশোনা করবেন তাদের বারবার হাত ধুয়ে নিতে হবে। এতে রোগ – জীবাণু শিশুর কাছে কম যাবে।
২) শীতকালে নবজাতকের যত্নআত্তি করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, ঘরে যাতে ঠাণ্ডা বাতাস না আসতে পারে। ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে দিনের বেলা দরজা–জানালা খোলা রেখে পর্যাপ্ত আলো–বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) নবজাতককে গরম কিন্তু আরামদায়ক পোশাক পরিয়ে রাখতে হবে। নবজাতকের গায়ে ভারি কম্বল বা লেপ কোনোটাই দেওয়া যাবে না। শীতের প্রকোপ কমাতে নবজাতকের হাত ও পায়ে মোজা পরিয়ে রাখতে হবে।
৪) নবজাতক শিশুকে ম্যাসাজ করতে হবে। এতে তার শরীরের রক্ত–সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। ভালো বেবি অয়েল দিয়ে বাচ্চাকে ম্যাসাজ করাতে হবে।
৫) জন্মের ৩ দিন পর থেকে শিশুকে প্রতিদিন গোসল বা গা মুছিয়ে দিয়ে হবে। শীতের সময়ে একদিন পরপর গোসল করানো ভালো। গোসলের সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, মাথা ভেজানোর পরে খুব দ্রুত মাথা ভালো করে মুছে ফেলতে হবে। গোসলের সময় কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে।
৬) নবজাতক শিশুর ত্বক খুব সংবেদনশীল, তাই তাদের ত্বককে সবসময় মসৃণ রাখতে হবে। এজন্য ভালো মানের বেবি লোশন বা ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। যেকোনো বেবি প্রোডাক্ট ব্যবহার করার আগে তার মান যাচাই করে নিতে হবে। সেই সাথে মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখও দেখে নিতে হবে।
৭) শীতকালে জন্ম নেয়া বাচ্চাদের বেলায় খেয়াল রাখতে হবে যাতে বাচ্চার সর্দি–জ্বর না হয়। নবজাতকের ঠাণ্ডা খুব খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই ঠাণ্ডা– সর্দি থেকেই বাচ্চার নিউমোনিয়া পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে, যা নবজাতকের জন্য খুব ক্ষতিকর।
৮) শিশুকে সবসময় ব্রেস্ট ফিডিং চালিয়ে যেতে হবে। যদি কোন কারনে শিশু অসুস্থও হয়ে যায়। তবুও মায়ের বুকের দুধ দেয়া বন্ধ করা যাবে না।
৯) নবজাতক যাতে কোন অবস্থায় প্রসাব–পায়খানা করে তার মধ্যে বেশিক্ষণ না থাকে সেদিকে নজরে রাখতে হবে। সম্ভব হলে ডায়াপার পরাতে হবে।
১০) ডায়াপার র্যাশ থেকে সাবধান হতে হবে। দিনের কিছু সময় ডায়াপার ছাড়া রাখতে হবে। তবে ডায়াপার র্যাশ যদি একান্ত হয়েই যায় সেক্ষেত্রে র্যাশ দূর করার ক্রিম লাগাতে হবে।
১১) নবজাতকের নাভি না পরা পর্যন্ত তেল বা পানি যাতে না লাগে খুব খেয়াল রাখতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।
১২) সময় অনুযায়ী শিশুর সবগুলো টিকা দিয়ে দিতে হবে।
নবজাতকের বেলায় যা একদমই করা যাবে না
১) নবজাতকের শীতকালীন যত্নআত্তি নেয়ার ক্ষেত্রে একটি ভুল ধারণা হলো, গরম লাগবে ভেবে বাচ্চাকে একদম খোলা বা শীত লাগবে ভেবে অনেক কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখা।
২) নবজাতক অবস্থায় শিশুর মুখের সংস্পর্শে এসে আদর করা থেকে একদম বিরত থাকা উচিত।
৩) বাইরে থেকে এসে কেউ যাতে হাত–মুখ না ধুয়ে নবজাতককের ঘরে প্রবেশ না করে সেদিকে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
ছোট্ট একটি প্রাণ আমাদের সবার জীবনে নিয়ে আসে অনাবিল আনন্দ। সেই আনন্দকে সব সময় ধরে রাখতে হলে আমাদের মা–বাবা, আত্মীয়দের নবজাতকের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সেইসাথে নবজাতক শিশুর জন্য দিতে হবে পরিপূর্ণ যত্ন। তবেই একজন নবজাতক শিশু বেড়ে উঠবে নিরাপদভাবে। তাহলে নবজাতকের শীতকালীন যত্নআত্তি করুন এবার নিশ্চিন্তে!
ছবি- সংগৃহীত: সাটারস্টক