শরীরের অন্যতম অঙ্গ নাক। নাকের প্রধান কাজ শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করা। শ্বাস প্রশ্বাস সঠিকভাবে চলছে মানেই ব্যক্তি জীবিত আছেন। এই নাক দিয়ে যখন রক্ত পড়ে তখন কিন্তু পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে যেতে পারে। আজকের লেখায় আমরা জানবো নাকের কাজ কী, নাক দিয়ে রক্ত পড়া বা এপিস্ট্যাক্সিস এর কারণ এবং এর চিকিৎসা সম্পর্কে।
নাকের কাজ কী?
নাকের অনেক ধরনের কাজ আছে। সেগুলো হলো-
১) নাকের প্রধান কাজ হচ্ছে ঘ্রাণ নেওয়া। নাকের ভেতরে ছোট ছোট রিসেপ্টর (যে কোষ নাকের ভেতরে গন্ধের অনুভূতি বহন করে) থাকে যার সাহায্যে ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় (olfactory area) সক্রিয় হয় এবং কোনটা সুগন্ধ আর কোনটা দুর্গন্ধ, আমরা বুঝতে পারি।
২) নাকের সরু পথ বাইরের বাতাস শরীরের ভেতরে এবং ভেতরের বাতাস বাইরে পৌঁছাতে সাহায্য করে।
৩) নাকের ভেতরে সূক্ষ্ণ অনেক চুল রয়েছে। এদের কাজ হচ্ছে, বাইরের আবহাওয়ায় বাতাসে উড়তে থাকা অপেক্ষাকৃত বড় সাইজের ধূলিকণাকে ফুসফুসের ভেতরে ঢুকতে বাঁধা দেওয়া।
৪) নাকের মধ্যে আঠালো, পিচ্ছিল পদার্থ রয়েছে। একে মিউকাস বলে। খুব ছোট ধূলিকণা, ভাসতে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোকে এই মিউকাস আটকে দেয়। এছাড়া মিউকাসে থাকা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী এনজাইম এদেরকে ধ্বংস করে দেয়।
৫) আমাদের শরীরের তাপমাত্রা আর বাহিরের তাপমাত্রা কিন্তু এক নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই আবহাওয়ার ঠান্ডা বাতাস ফুসফুসে পৌঁছালে মানুষ ঠান্ডার সমস্যায় ভোগে। এক্ষেত্রে নাক বাহিরের বাতাসকে শরীরের উপযোগী তাপমাত্রায় পরিণত করে, যাকে এয়ার কন্ডিশনিং বলে।
৬) হাঁচির মাধ্যমে নাকে আটকে থাকা ক্ষতিকর পদার্থ বাইরে বের হয়ে যায়।
৭) নাকের ভেতর অবস্থিত সাইনাসগুলো শব্দের প্রতিধ্বনিতে সাহায্য করে।
নাক দিয়ে রক্ত পড়া বা এপিস্ট্যাক্সিস
অনেক সময় দেখা যায় হঠাৎ করেই বাচ্চারা খেলতে খেলতে কিংবা বড়রা কাজ করতে গিয়ে নাক চেপে ধরে বসে পড়েছে। দেখা গেলো হুট করেই নাক দিয়ে পানির মতো কিংবা ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে তো পড়ছেই, কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। নাক দিয়ে এই রক্ত পড়াকে বলা হয় এপিস্ট্যাক্সিস (Epistaxis)। এটি কোনো রোগ নয়, শরীরের আভ্যন্তরীণ কোনো রোগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
কেন নাক দিয়ে রক্ত পড়ে?
কেন নাক দিয়ে রক্ত পড়ে তার প্রায় ৯০% কারণ অজানা। বাকি ১০% এর মধ্যে নিচের সম্ভাব্য কারণগুলো হতে পারেঃ
শুধু নাকের কারণে (Local Cause):
- নাক খোঁচানো
- নাকে আঘাত লাগা (এক্সিডেন্ট, ঘুষি, নাকের হাড় ভেঙ্গে যাওয়া, দাহ্য কেমিক্যালের ধোঁয়া প্রশ্বাসের সাথে টেনে নেওয়া ইত্যাদি নানা কারণ)
- পুঁতি, রাবারের টুকরো, ডাল, চাল ইত্যাদি বাচ্চারা খেলতে খেলতে নাকে ঢুকিয়ে ফেলা এবং সময়মতো বের না করার কারণে যদি ইনফেকশন হয়ে থাকে
- ফাংগাল ইনফেকশন (rhinosporidiosis)
- টিউমার
- পলিপ
- উঁচু স্থান
- শুষ্ক আবহাওয়া
সিস্টেমিক কারণ (শরীরের আভ্যন্তরীণ বিষয়):
- উচ্চ রক্তচাপ
- ব্লাড ক্যান্সার
- রক্ত পড়া বন্ধ না হওয়া
- নিউমোনিয়া (সবসময় নয়)
এপিস্ট্যাক্সিস কোথায় হয়?
এপিস্ট্যাক্সিস সবচেয়ে বেশি হয় নাচের নিচের অংশে। একে বলা হয় লিটল’স এরিয়া (Little’s area)। পাঁচটি আর্টারি (artery) পরস্পর একসাথে সংযুক্ত হয়ে এই অংশ তৈরী করে।
এপিস্ট্যাক্সিস হলে যে যে লক্ষণ দেখা দেবে
এপিস্ট্যাক্সিস নিয়ে রোগী হাসপাতালে আসলে তার মধ্যে কয়েকটি লক্ষণ দেখা যাবে। সেগুলো হলোঃ
- নাক দিয়ে হঠাৎ রক্ত পড়তে থাকবে
- রোগী খুব চিন্তিত থাকবে
- রক্তবমি করতে পারে কিংবা পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে
- অতিরিক্ত রক্তপাতে রোগী শকে চলে যাওয়ার মতো লক্ষ্মণ নিয়ে আসবে
এপিস্ট্যাক্সিস হলে রোগী শকে চলে গেলে যে যে লক্ষণ দেখা যাবে
- রক্তচাপ কমে যাবে
- পালস খুব দ্রুত চলবে
- প্রচুর ঘাম হবে
- শরীরে বরফের মতো ঠান্ডা অনুভূত হবে
কী কী পরীক্ষা করতে হবে?
- রক্তের গ্রুপ জানা না থাকলে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে
- সম্ভাব্য যে কারণে রোগী নাক দিয়ে রক্ত পড়া নিয়ে এসেছে সে অনুযায়ী পরীক্ষানীরিক্ষার জন্য ল্যাবে যেতে হবে
চিকিৎসা
নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কিছু চিকিৎসা রয়েছে। যেমনঃ
১) নাক কিছুক্ষণ চেপে ধরে রাখতে হবে। তাতে বন্ধ না হলে নাক বরফ দিয়ে চেপে ধরে রাখতে হবে।
২) জলদি হাসপাতালে নেওয়া ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) দ্রুত রোগীর রক্তচাপ, পালস দেখতে হবে।
৪) অ্যানিমিয়া পরীক্ষা করতে হবে।
৫) রোগীর কতটুকু চেতনা আছে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
৬) শক (shock) এর লক্ষণ থাকলে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী স্যালাইন এবং রক্ত দিতে হবে। তাতেও বন্ধ না হলে নাকের ভেতর গজ দিয়ে ন্যাজাল প্যাক (nasal pack) (গজের ভেতর ওষুধ দিয়ে নাকের ভেতর রাখা) দিতে হবে।
৭) সাথে সাথে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে।
8) রোগীকে শান্ত রাখার জন্য অল্প ডোজে ঘুমের ঔষধ দেওয়া যেতে পারে। যদি তাতেও রক্ত বন্ধ না হয় তাহলে রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে হবে। সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে (general anesthesia) যে রক্তনালী দিয়ে রক্ত পড়ছে, তা বন্ধ করে দিতে হবে।
মূলত নাক দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধের জন্য কয়েকরকম পদ্ধতি আছে, চিকিৎসক তখন রোগীর জন্য যেটা প্রয়োজন সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন।
সতর্কতা
১। অযথা নাক খোঁচাখুঁচি করবেন না।
২। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে দেখলে সবার আগে নাক চেপে ধরে বরফ দেবেন।
৩। যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন।
৪। মনে রাখবেন, সব চিকিৎসা বাসায় বসে সম্ভব না। প্রাথমিকভাবে যতটুকু করার, ততটুকু করে আর দেরী করবেন না। এতে রোগীর শারীরিক অবস্থা আশংকাজনক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নাক দিয়ে রক্ত পড়লে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সাবধানে থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক