কাগজের ভাঁজে নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসায়নি কিংবা প্লেন বানিয়ে বাতাসে উড়ায়নি, এমন মানুষ মনে হয় না খুঁজে পাওয়া যাবে। এক টুকরো কাগজ ভাঁজ করে বিভিন্ন আকৃতিতে রূপ দেওয়ার এই শিল্পকে বলা হয় অরিগ্যামি। অরিগ্যামি পারে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দূর্লভ।
সেই ছোট্টবেলায় কোন একদিন হয়ত বাবা, মা, মামা, চাচা, ফুফু, খালা কিংবা বড় ভাইয়া বা আপুর কাছেই হাতেখড়ি হয়েছে অরিগ্যামি শেখার। কাগজ ভাঁজ করে করে নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া কিংবা বিমান বানিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দেয়া কিংবা বন্দুক বানিয়ে ইয়া…ঢিচুয়া…কী মজাটাই না লাগতো সেই সময়! আজ সেই অরিগ্যামি নিয়েই কিছু কথা হবে।
অরিগ্যামির সূত্রপাত
১. অরিগ্যামি প্রধানত একটি জাপানিজ শিল্প। জাপানী শব্দ অরি (Ori) মানে হচ্ছে ভাঁজ করা বা মোড়ানো আর কামি (kami) মানে হচ্ছে পেপার। পরবর্তীতে কামি (kami) থেকে শব্দটা গ্যামি (gami) হয়েছে। এইভাবে কাগজ ভাঁজ করে নতুন কিছু বানানোর শিল্পের নাম হয়েছে অরিগ্যামি।
২. অরিগ্যামির উদ্ভব বা আবিষ্কার নিয়ে কেউ আসলে সঠিক তথ্য দিতে পারেন না। তবে ইতিহাসবিদরা মনে করেন যেহেতু কাগজ নিয়ে মূল কাজ অরিগ্যামিতে তার মানে নিশ্চয়ই কাগজ আবিষ্কারের পরপরই এর উদ্ভব ঘটেছে।
৩. জাপানের আকিরা ইয়োশিজাওয়াকে আধুনিক অরিগ্যামির জনক বলা হয়।
৪. অরিগ্যামি হচ্ছে কাগজ না কেটে শুধু ভাঁজ করার মাধ্যমে কিছু তৈরি করা।
৫. কাগজ কেটে এবং আঠা ব্যবহার করে যা করা হয় তা হল কিরিগ্যামী।
৬. জাপান ছাড়াও চীন, জার্মানী, ইটালি ও স্পেনেও এটি একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প।
ওয়েট ফোল্ডিং অরিগ্যামি
অনেক সময় শুকনো কাগজ দিয়ে আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আকার আনতে পারি না। কিন্তু কাগজটা যদি একটু ভিজা থাকে তাহলে নরম কাগজ দিয়ে সহজেই ইচ্ছামত শেইপ আনা সম্ভব। আর কাগজ পরে শুকিয়ে গেলেই আমাদের মডেল তৈরি হয়ে যায়। একেই বলে ওয়েট ফোল্ডিং অরিগ্যামি।
অরিগ্যামি শিখতে গেলে যা যা লাগবে
অরিগ্যামি শিখতে গেলে বলতে গেলে কাগজ ছাড়া আর কিছুই দরকার নেই। তবে একদম নিখুঁতভাবে বানাতে গেলে একটা স্কেল আর কেঁচি বা ছুড়ির দরকার পড়তে পারে। কাগজ কী ধরনের নিবেন সেটা নির্ভর করে আপনি কী বানাতে যাচ্ছেন তার উপর। কাগজের পুরুত্ব আর রঙ এই দুটাই মূলত দেখার বিষয়। চাইলে সাদা কাগজ দিয়েই আপনি সবকিছু বানাতে পারেন তারপর তাতে ইচ্ছেমত রঙ করে কিংবা পুতি লাগিয়ে নিজের মত বানিয়ে নিতে পারেন।
জানতে হবে কাগজের ভাঁজ সম্পর্কে
পাখি বানাতে চান? নাকি প্রজাপতি? নৌকা? মাছ? প্লেন? বই? ফুল? ক্যামেরা? ল্যাপটপ? সবই বানানো যায় মাত্র একটুকরো কাগজ দিয়ে! তার জন্য অবশ্য কিছু বেসিক ভাঁজ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। নানারকম ফোল্ড বা ভাঁজ আছে। যেমন-
- ভ্যালি ফোল্ড (Valley fold)
- মাউন্টেইন ফোল্ড (Mountain fold)
- বেলুন ফোল্ড (Balloon fold)
- কাইট ফোল্ড (Kite fold)
- ফিশ ফোল্ড (Fish fold)
- নেইল ফোল্ড (Nail fold)
- র্যাবিট ইয়ার ফোল্ড (Rabbit ear fold) …… আরো কত কী!
আবার যদি একটা কাগজকে সমান তিনভাগে ভাগ করতে চান তাহলে ঐটিকে বলে জেড ফোল্ড (Z fold)। চারভাগ করতে চাইলে বলে গেইট ফোল্ড (Gate fold)। পাঁচভাগ করতে চাইলে সেটি হবে স্টেয়ার ফোল্ড (Stair fold)। পাশাপাশি কিছু শেইপের কথা জানতে হবে।
ইউটিউব ভিডিও
অরিগ্যামি শেখার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও দেখা বা ডায়াগ্রাম দেখে শেখা। ইউটিউবে নানারকম চ্যানেল পাবেন শুধু অরিগ্যামি শিখায়। যেমন, Kade Chan, Henry Pham, Jo Nakashima, Happy Folding ইত্যাদি। Kade Chan-এর কাগজের গডজিলা বা Jo Nakashima-এর ড্রাগন দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না!
কেন শিখবেন অরিগ্যামি?
অরিগ্যামি আমাদের শৈশব ও কৈশোরের অনুষঙ্গ হয়ে জড়িয়ে আছে। শৈশবের অনুষঙ্গ হলেও অরিগ্যামি যে শুধু শিশুদের বিষয় তা নয়। আপনি যদি শিল্প ভালবাসেন, সৃজনশীলতাকে ভালবাসেন তাহলে যে কোন বয়সেই এটি আপনাকে কাছে টানবে। শিশুদের প্রিয়পাত্র হতে চাইলে অরিগ্যামি হতে পারে আপনার জন্য এক মোক্ষম কৌশল। তাছাড়া অরিগ্যামি আজ আর শুধু ছেলে ভুলানো খেলনার মত গৃহবন্দী হয়ে পড়ে নেই। অরিগ্যামি আজ পৌঁছে গেছে শিল্পের পর্যায়ে। তাই এরকম একটা জিনিসের কদর না করলে শিল্পকেই যে অস্বীকার করা হবে!
হতে পারে বাড়তি আয়!
এটি একটি রিক্রিয়েশনাল জিনিস। তবে যারা প্রায়ই অর্থ সংকটে ভোগেন তাদের জন্য এটি আয়ের উৎস হিসবে কাজ করতে পারে। কারণ একদম কোনো খরচ ছাড়াই কাগজ দিয়ে জিনিস বানিয়ে সুন্দর করে ডেকোরেশন-এর কাজ সেরে ফেলা যায়। চাইলে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করতে পারেন। আর তা করতে পারেন ঘরে বসেই। আর এতে মূলধনও লাগবে অনেক অনেক কম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডেকোরেশন-এর অর্ডার নিতে পারেন। এখন অনেকেই বার্থডে পার্টি, হলুদের ফাংশন কিংবা যেকোনো পার্টিতে কাগজের বিভিন্ন থিমের নকশা দিয়ে ডেকোরেশন করেন। শুধু তাই নয় ছোটখাটো মডেল বানিয়ে তা বন্ধুদের কাছে বিক্রিও করতে পারেন।
জেনে নিলেন অরিগ্যামির সাত সতেরো! শুরু করে দিন কাগজের ভাজে ভাজে সাজানো শিল্পচর্চা!
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ; সাটারস্টক