গহনা পরতে কে না ভালোবাসে? আর সে গহনা যদি হয় খুব ফ্যাশনেবল আর একেবারেই নিজের হাতে তৈরি করা, তবেতো কথাই নেই! চোখ জুড়ানো এমন সব গহনাই ডিজাইন করেন তাহমীনা শৈলী! পেশায় সাংবাদিক এবং আরজে এই দারুণ স্টাইলিশ, দারুণ ক্রিয়েটিভ এবং ভীষণ কাজপাগল মানুষটি নিজে নানা স্টাইলের গহনা পরতে খুব ভালোবাসেন। নিজের গহনা ডিজাইন করতে করতেই অনলাইনে তৈরি করেছেন ফ্যাশন জুয়েলারির এক অনন্য সম্ভার। চলুন জেনে নিই টুকটাক কিছু কথা।
সাজগোজের পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা। নিজের সম্পর্কে আমাদেরকে একটু বলুন।
ধন্যবাদ। আমি শৈলী। আমি কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রী ছিলাম। গ্র্যাজুয়েশান করেছি মার্কেটিং থেকে। এরপর পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম সাংবাদিকতাকে। প্রথম আলো, বণিক বার্তার মত পত্রিকায় কাজ করেছি সাংবাদিক হিসেবে। এরপর রেডিও এবিসিতে আরজে হিসেবে ছিলাম। এখন রেডিও স্বাধীনে আছি আরজে এবং প্রযোজক হিসেবে। আর পাশাপাশি আমার প্যাশন গহনা বানানোও চালিয়ে যাচ্ছি। ‘শৈলী’ নামেই আমার একটি অনলাইন ফ্যাশন জুয়েলারি স্টোর আছে। নিজেই সেখানে গহনা ডিজাইন করি।
আরও অনেক কিছুতেই আমার প্যাশন আছে। যেমন, হ্যান্ডিক্র্যাফটের জিনিস বানাতে খুব ভালো লাগে, ভালো লাগে ঘুরে-বেড়াতে। গান শুনতে প্রচন্ড ভালোবাসি, গল্প করতেও খুব ভালো লাগে। ছবিও তুলি মাঝেমধ্যে। আমি খেতে খুব ভালোবাসি, ফুডিই বলা যায় আমাকে। রান্না করতেও বেশ ভালোই লাগে। আর কাজ করতেতো ভীষণ ভালো লাগে।
গহনা বানানোর কথা মাথায় আসলো কীভাবে? উৎসাহটা কোথা থেকে এসেছিল?
আমি খুব ছোটবেলা থেকেই টুকিটাকি নিজের জিনিসপত্র নিজেই বানাতাম। বাড়িতে জামাকাপড়, পেন হোল্ডার, হাতের তৈরি নানান ধরনের জিনিস ইত্যাদি আমরা নিজেরাই বানাতাম। প্রয়োজনীয় সব কাঁচামাল বাড়িতেই থাকত। গহনা বানানোর কাঁচামাল তখন আসত না যদিও। আর আমার বাবা যেহেতু চিত্রশিল্পী ছিলেন, তার স্টুডিওতে রং, তুলি, আর্ট পেপার ইত্যাদি সবসময়ই থাকত। প্রতি ঈদে ঈদ কার্ড আমরা নিজেরাই বানাতাম। শিল্পের প্রতি আগ্রহটা এভাবেই পাওয়া।
আমি একবার আমার দাদীকে একটি শাড়ি ডিজাইন করে দিয়েছিলাম। তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। আর দাদী খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। তাঁর সেই শাড়ির সাথে মিলিয়ে ভয়ে ভয়ে একটি মালা তৈরি করে দেয়ার পর দেখলাম তিনি সেটা খুবই পছন্দ করেছেন। আর যারা দেখছে, তারা বেশ প্রশংসা করছে সেটার। আসলে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম পরিবার থেকেই।
যাত্রা শুরু হল কীভাবে?
২০০৬-৭ সালের দিকে আমি যখন পত্রিকায় কাজ করা শুরু করলাম, তখন অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হল। তখন খেয়াল করতাম মানুষ আমার হাতে তৈরি ছোট ছোট জিনিস খুব পছন্দ করত। হয়ত আমি একটি ছোট দুল বানাতাম বা পাঞ্জাবি কিংবা যেকোন কাপড় ডিজাইন করতাম। এভাবে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিজে নিজেই বানাতে বানাতে সেই ২০০৮ সালের দিকে গহনা বানানোর ব্যাপারে আমি খুব সিরিয়াস হয়ে যেতে থাকলাম। নেটের বিভিন্ন রকম টিউটোরিয়াল দেখে চর্চা করতে করতে একসময় আমার মধ্যে এক ধরনের প্রফেশনালিজম তৈরি হল। এরপর ২০০৯ সালে আমি প্রথম ফেইসবুক পেইজ দিয়ে আমার নিজের তৈরি করা গহনা বিক্রির উদ্যোগ নিলাম। শৈলীর ফেইসবুক পেইজের ঠিকানাঃ https://www.facebook.com/shoileezone
গহনাগুলো কোন নির্দিষ্ট থিমে তৈরি করেন কি?
হ্যাঁ, থিমতো একটা অবশ্যই থাকে। তবে আমি চেষ্টা করি সবসময় ট্রেন্ডি কোন একটা নকশাকে বেছে নিতে। গতানুগতিক নকশার গহনা আমি বানাতে চাই না। অনেক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করে করে আমি গহনা ডিজাইন করি। অর্থাৎ থিমগুলো সময়ভেদে বদলায়। সারা বছরই ডিজাইনে কিছু নতুনত্ব রাখার চেষ্টা করি আমি সবসময়।
কিছু নকশা থাকে সারা বছরই। আবার কিছু নকশা আছে, যেগুলো আমি বয়সভেদে তৈরি করি। যেমন, কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে তরুণ বা মধ্যবয়সিরা কী ধরনের পোশাক পরছে, সেটার উপর ভিত্তি করে আমি গহনা ডিজাইন করি। অনেকেই আমাকে বলে কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী গহনা বানাতে, কিন্তু আমি তা করি না। আমি অনেক ফোকাসড হয়ে গহনা তৈরি করি। আমি খুব বেশি কাস্টমাইজড গহনা তৈরি করি। কাস্টমার কী পছন্দ করবে, সেটা আসলে কাস্টমার নিজেও জানে না বলে আমার ধারণা। কারণ আমি নিজেও কিন্তু একজন কাস্টমার। আমি যখন শপিং করি, তখন অনেক অনেক অপশানের ভীড়ে আমার চাহিদাটা উঠে আসে। তাই কাস্টমার কী পছন্দ করবে, তার উপর নির্ভর না করে আমি কাস্টমারের পছন্দ তৈরি করে দেয়ার চেষ্টা করি। সবসময়ই আমার চেষ্টা থাকে গহনার নকশা যেন খুব ইউনিক হয় আর কখনও যেন নকশা একটির সাথে আরেকটি রিপিট না হয়।
কী কী বিষয় মাথায় রেখে গহনা ডিজাইন করেন?
গহনা ডিজাইনিঙের ব্যাপারটা খানিকটা রান্না করার মত। রান্না করার আগে আমরা সবার আগে প্রয়োজনীয় উপকরণ গুলোকে একসাথে জড়ো করি। কেউ রান্না করি ঘরোয়া উপকরণাদি ব্যবহার করেই আবার কেউ চেষ্টা করি বাড়তি কিছু উপকরণ যোগাড় করে রান্না করার। আমার গহনা তৈরির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই। অর্থাৎ সবার আগে আমি চিন্তা করি যে আমি কী বানাবো। এরপর সে মোতাবেক আমি সব উপকরণ যোগাড় করি। যেমন, একজন কর্পোরেট নারীর জন্য আমি গহনা বানাতে গেলে প্রথমেই চিন্তা করব যে কোন রঙটা এখানে ব্যবহার করা উপযুক্ত। এরপর তার সাথে মিলিয়ে যা যা উপকরণ দরকার সেসব আমি ডিজাইনে যোগ করতে থাকি।
বর্তমানে গহনা নিয়ে কী কী কাজ করছেন? কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে কি?
বর্তমানে আমি প্রচুর মেলা এবং প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করছি এবং প্রচুর সাড়াও মিলছে তাতে। গত ডিসেম্বরেই বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাবের মেলায় ‘শৈলী’ হস্ত ও কারুশিল্পে প্রথম হয়েছে এবং সেরা স্টলেরও অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। সামনেই পহেলা বৈশাখে আমার একটি সোলো এক্সিবিশান হবে। সবাইকে আগেভাগেই আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম।
অফিসার্স ক্লাব মেলায় ‘শৈলী’-র শ্রেষ্টত্ব অর্জন
গহনা নিয়ে আমার পরিকল্পনা হল এটাকে অনলাইনেই রাখার। কারণ অনলাইনে মানুষ ইদানীং অনেক বেশি কানেক্টেড এবং কম্ফোর্টেবল।
‘শৈলী’ নিয়ে আমার আরও একটি পরিকল্পনা হচ্ছে বছরে ৪টি করে প্রদর্শনী করা। মানুষ সেসব প্রদর্শনী থেকে আমার গহনা নিয়ে যাবে এবং এর বাইরে অনলাইনে সারাবছর কিনতে পারবে। আর আমার তৈরি শাড়ি বা পোশাকগুলোও এমন ভাবে তৈরি করা হবে, যেন সেগুলো গহনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। অর্থাৎ গহনাই হবে ‘শৈলী’-র মূল পণ্য।
কোন বাধা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন কখনও এই কাজে? সেগুলো মোকাবিলা করলেন কীভাবে?
তেমন কোন সমস্যা হয়নি। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করাটা কিছুটা কঠিন। এখানকার পেপারস, কোন কিছুতে এখানকার মানুষকে ইনভল্ভ করানোর ব্যাপারগুলো খুব সহজ নয়। যেমন আমি যে গহনাগুলো প্রথমদিকে বানাতাম, সেগুলো কেউ কিনতে চাইত না। গহনায় যে গতানুগতিক ধারার বাইরেও ডিজাইন হয়, কিংবা গহনায় যে এতরকম নকশা হতে পারে, এই ব্যাপারগুলোতে মানুষজনকে অভ্যস্ত করে তুলতে আমার বেশ সময় লেগেছে। তবে সবকিছুর পরেও আমার কাছে মনে হয়েছে যে, মানুষ আমাকে খুব দ্রুতই স্বাগত জানিয়েছে। আমি নিজেও শুরু থেকেই অনেক ফোকাসড ছিলাম যে গহনা ছাড়া আমি আর কিছু বানাবই না। সেজন্যই বোধ হয় মানুষ আমাকে এত প্রশংসা করেছে। আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি যে এত মানুষ আমার গহনা পছন্দ করে। আমি ‘শৈলী’ নিয়ে প্রথম অংশগ্রহণ করেছি ‘রাঙতা ঈদ মেলা, ২০১৪’-এ। আমি ভাবতেও পারিনি এত অভূতপূর্ব সাড়া মিলবে সেখানে। সবচেয়ে সুখকর স্মৃতি হচ্ছে যে, অনেক বয়স্কা নারীরাও আমার ডিজাইনের গহনা খুশি মনে কিনে নিয়ে গেছেন! মেলাটা থেকে এ শিক্ষাটাই পেয়েছি যে, মানুষ আসলে সৃজনশীল এবং অনন্য জিনিসের দাম দিতে জানে। কাজেই এখনও পর্যন্ত তেমন কোন অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হয়নি আমার।
নতুনদের জন্য কোন পরামর্শ আছে? কী ধরনের গুণ বা প্লাস পয়েন্ট থাকা জরুরি এ ধরনের কাজে? কীভাবে শুরু করতে পারে তারা?
যেকোন উদ্যোগ শুরু করার ক্ষেত্রে একটা জিনিসই সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ আর সেটা হচ্ছে লেগে থাকতে পারা! আর প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস। এ দুটো বিষয়ের কম্বিনেশানে মানুষ যেকোন কিছু করে ফেলতে পারে।
আর গহনার ডিজাইনার হওয়ার জন্য যেটা দরকার সেটা হচ্ছে উপলব্ধি। যেমন কেউ মিউজিশিয়ান হতে চাইলে শুধুমাত্র মিউজিক শিখে সে তা হতে পারবে না। মিউজিক ব্যাপারটা তার ভেতরে থাকতে হবে। প্যাশন থাকতে হবে। তেমনি কেউ গহনা ডিজাইন করতে চাইলে তার ভেতরে আগে এই উপলব্ধিটা থাকতে হবে যে সে গহনা বানাতেই চায়! তাহলেই কেবল এ বিষয়ে প্রচেষ্টা দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে। আমার কাছে মনে হয়, জীবনে ফোকাস থাকাটা অনেক বেশি জরুরি। আমি একই সাথে অনেক কাজ করি। কখনও অনুবাদ, কখনও প্রেজেন্টেশান, ইত্যাদি। কিন্তু আমি জানি যে জীবনের একদম শেষ পর্যন্ত আমি কোন জিনিসটা ধরে রাখতে চাই আর সেটা হল গহনা ডিজাইনিং।
তাছাড়া আমার পণ্যের কাস্টমার কে হবেন, সেটা জানাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে কারা আমার প্রতিযোগী, তাদের সাথে আমার ফারাক কোন জায়গায় হবে, সারা বিশ্বে গহনা কারবার কখন, কেমন হচ্ছে এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে পারার ক্ষমতাটাও থাকতে হবে।
আর নিজের স্বপ্নটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সবচাইতে যেটি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হল মূলধন। এটি যোগাড় করার জন্য পাশাপাশি অন্য ছোটখাট কোন ব্যবসা বা পার্ট টাইম কোন চাকরি অথবা অন্য যেকোন উপায়ে কিছু না কিছু সঞ্চয়ে রাখতেই হবে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে যেন কোন বিঘ্ন না ঘটে, সেজন্যই এতসব প্রস্তুতি নিয়ে এগোতে হবে।
অনেক ধন্যবাদ শৈলী আপনাকে।
সাজগোজ টিমকেও অনেক ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেনঃ নুজহাত ফারহানা