আসছে পহেলা বৈশাখ। বাঙালিদের প্রাণের উৎসব। বাংলা নতুন বর্ষকে বরণ করে নিতে সবাই উন্মুখ হয়ে থাকে। এই দিনটিকে বিশেষভাবে উৎযাপন করার জন্য সবাই নিজের মতো করে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা করে নিচ্ছে। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা বুঝতে পারছেন না কিভাবে দিনটিকে উৎযাপন করবেন আর তাঁদের জন্যই আমার এই লেখার অবতারণা।
দিনের শুরুটা
পহেলা বৈশাখের সারাদিনে আর যাই করি না কেন দিনের শুরুটা পান্তাভাত-ইলিশ না খেলে কি হয়? মাছে-ভাতে বাঙালি জাতির জন্য ইলিশ-প্রীতি কোন বিষয় নয়। আবহমানকাল থেকে চলে আসছে এই রীতি। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও ধারক-বাহক। তাই নববর্ষে এখন পান্তা-ইলিশ ছাড়া বৈশাখ যেন জমেই না।
রমনা বটমূল
পহেলা বৈশাখের মূল আকর্ষণ হচ্ছে রমনা বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীদের বিভিন্ন পরিবেশনা। এখানে অংশগ্রহণ করেও আপনি পহেলা বৈশাখের দিনটিকে উৎযাপন করতে পারেন। বাংলা পঞ্জিকায় নববর্ষের প্রথম সূর্য কিরণের সঙ্গে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। বর্ষবরণে ছায়ানট বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমে এ দিনটিকে উৎসবমুখর করে তোলে। সকাল সাড়ে ছয়টায় শুরু হয় বর্ষবরণের মূল উৎসব। একক ও সম্মিলিত সঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি ও পাঠ দিয়ে সাজানো হয় পুরো আয়োজনটিকে। ভোরের মিষ্টি রোদের আলো উদিত হওয়ার সাথে সাথেই সমবেত কন্ঠে বেজে ওঠে, “এসো হে বৈশাখ এসো এসো “। অনেকেই সমবেত কন্ঠের সাথে সুর মিলিয়ে গেয়ে ওঠেন সেই গান। এটি হতে পারে আপনার পহেলা বৈশাখ উৎযাপন করার একটি চমৎকার মাধ্যম। সকালের মিষ্টি রোদ আর কোমল বাতাসের সাথে সমবেত কন্ঠে বৈশাখের গান গাওয়া সত্যিই আপনার দিনটিকে অনেক মধুর ও আনন্দময় করে তুলবে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা
আপনি চাইলে উৎসবমুখর মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেও পহেলা বৈশাখের দিনটিকে উৎযাপন করতে পারেন। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবের পাশাপাশি মঙ্গল শোভাযাত্রা নববর্ষের উৎসবকে আরো জাকজমকপূর্ণ করে তোলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন বিশ্ব ঐতিহ্যেরও অংশ। মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কো-ঘোষিত ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি ‘। এই শোভাযাত্রায় রং বেরংয়ের বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি, মুখোশ ও বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী উপকরণ বহন করা হয়। নাচে-গানে মুখোরিত হয় পুরো পরিবেশ।
বৈশাখী মেলা
নতুন বর্ষকে বরণের পাশাপাশি উৎসবকে পরিপূর্ণতা দিতে বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা প্রিয়জনের সাথে এসব মেলায় গিয়েও পহেলা বৈশাখের দিনটিকে উৎসবমুখর আঙ্গিকে উৎযাপন করা যায়। এই মেলা বাঙালির শতাব্দী প্রাচীন বিভিন্ন ঐতিহ্য বহন করে। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় এ মেলার। অনেক মেলা মাসজুড়ে চলে। তবে পহেলা বৈশাখের দিনটিতে বিভিন্ন ধরনের বিশেষ আকর্ষণ থাকে। বৈশাখী মেলায় খই-বাতাসা, হাওয়াই মিঠাই, মাটির পুতুল পাওয়া যায়। সাথে থাকে নাগরদোলা। মেলায় আরও হরেক রকম জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা।
ভ্রমণ
পহেলা বৈশাখে সাধারণত সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এই সুযোগে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন অজানা ও অদেখা প্রাকৃতিক কোন সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে। তবে এজন্য আপনাকে আগে থেকেই পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। পহেলা বৈশাখের উৎসবমুখর ভাবের সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সান্নিধ্য আপনার হৃদয়ে পরম প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে।
গ্রামে উৎযাপন
কোলাহল পূর্ণ শহরের যান্ত্রিকতা ছেড়ে যারা প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভ করে পহেলা বৈশাখ উৎযাপন করতে চান, ভ্রমণের মতো এটিও হতে পারে তাঁদের জন্য একটি যথার্থ মাধ্যম। প্রাকৃতিক গ্রাম্য পরিবেশে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দ উৎসব করা, পহেলা বৈশাখের উৎযাপনে নিয়ে আসবে নতুন মাত্রা। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে গ্রামের হাট-বাজারে বসে বৈশাখী মেলা। আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মিলনকেন্দ্র এইসব বৈশাখী মেলা। এখানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবাই মিলে আনন্দ-উল্লাস করে পহেলা বৈশাখের দিনটিকে উৎযাপন করে। মেলা থেকে মুড়ি-মুড়কি-বাতাসা-সন্দেশ-মিষ্টি কিনে খাওয়া, নাগরদোলায় চলা, লাঠিখেলা দেখা, বায়স্কোপ দেখা, সাপুড়েদের সাপ খেলা, বানরের খেলা আর ষাঁড়ের লড়াই উপভোগ করে পহেলা বৈশাখের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখা যায় এই মেলায়।
পহেলা বৈশাখ… অনেক আনন্দের দিন। তবে, এই আনন্দে ভেসে নিজেকেও নিরাপদে রাখতে হবে আমাদের। সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানীয় রাখুন। অতিরিক্ত রোদে বেশিক্ষণ না ঘোরার চেষ্টা করুন। মেয়েরা পার্সে পেপার স্প্রে অথবা শক টর্চ রাখুন, অনাকাঙ্ক্ষিত খারাপ মানুষের আক্রমণ থেকে বাঁচতে। অতিরিক্ত ভিড় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।
বৈশাখের রঙগুলো প্রত্যেকের জীবনে এনে দিক অসংখ্য সুখের কিছু কোমল ছটা।
শুভ নববর্ষ সবাইকে!
লিখেছেন- হসিয়া খংপডা